নবী করিম সা.-এর জীবনাদর্শ যুগে যুগে সবার জন্য

  • ইসলাম ডেস্ক, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

নবী করিম সা.-এর জীবনাদর্শ যুগে যুগে সবার জন্য, ছবি: সংগৃহীত

নবী করিম সা.-এর জীবনাদর্শ যুগে যুগে সবার জন্য, ছবি: সংগৃহীত

৫৭১ খ্রিস্টাব্দের ২০ বা ২২ এপ্রিল। সোমবার প্রভাতের সময় পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে। এ সময় জন্মগ্রহণ করেছেন নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। সাহাবি হজরত আবদুর রহমান বিন আউফ (রা.)-এর মা শিফা বিনতে আসওয়াদ (রা.) নবী করিম (সা.)-এর জন্মের সময় দাই হিসেবে মা আমেনার সঙ্গে ছিলেন।

তিনি নবী করিম (সা.)-এর জন্মের সময়ের বিস্ময়কর কিছু ঘটনা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, নবী করিম (সা.) যখন এলেন, গোটা কামরা আলোকময় হয়ে গেলো। তিনি দেখলেন, সদ্য ভূমিষ্ঠ এ সন্তান একেবারে পরিষ্কার-পরচ্ছিন্ন অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেছে। কোনো ধরনের ময়লা-আবর্জনা, রক্ত-শ্লেষ্মা তার শরীরে নেই। অন্য যেকোনো নবজাতক ভূমিষ্ঠ হলে তার শরীরে মায়ের পেট থেকে বিভিন্ন বস্তু লেগে থাকে। কিন্তু নবী করিম (সা.) জন্মগ্রহণ করেছেন সম্পূর্ণ পবিত্র হয়ে। অন্যান্য শিশুর আঁত ও নাভি একসঙ্গে থাকে। পরে সেটা কাটতে হয়, নবী করিম (সা.) ভূমিষ্ঠ হয়েছেন নাভি কাটা অবস্থায়। অন্যদের বেলায় দেখা যায়, মুসলিম ছেলে শিশু বড় হলে তাদের মুসলমানি করাতে হয়। কিন্তু নবী মুহাম্মদ (সা.) জন্মগ্রহণ করেন মুসলমানি করা অবস্থায়।

বিজ্ঞাপন

এ বিষয়ে হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, মহান আল্লাহ আমার প্রতি যে সম্মান দেখিয়েছেন তার অন্যতম হলো- আমি খতনাবিশিষ্ট অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেছি, যাতে আমার লজ্জাস্থান কেউ যেন না দেখে। -মুজামে আওসাত: ৬১৪৮

আবদুর রহমান বিন আউফের আম্মা বিষয়টি দেখে অভিভূত হয়ে যান। তিনি বিষয়টি মা আমেনাকে দেখান, তিনিও অভিভূত হয়ে যান। মা আমেনা নবী করিম (সা.)-কে কোলে নিতে চেষ্টা করেন। কিন্তু নবী করমি (সা.) পার্শ্ব পরিবর্তন করে সেজদায় অবনত হন। এ দৃশ্য দেখে তারা উভয়ে ভীত হয়ে যান। এরপর নবী করিম (সা.) উভয় হাতে ভর করে সেজদা থেকে ওঠে ডান হাতের শাহাদাত বা তর্জনী আঙুল দিয়ে আসমানের দিকে ইশারা করেন। হঠাৎ পুরো ঘর আলোতে ভরে যায়। মা আমেনা বলেন, আমি ওই আলোতে ইরান, সিরিয়া ও হীরার রাজপ্রাসাদ দেখতে পেলাম।

বিজ্ঞাপন

ইমাম কাজি আয়াজ বলেন, আবদুর রহমান ইবনে আউফের মা শিফা থেকে বর্ণিত। তিনি তার ধাত্রী ছিলেন। তিনি বলেন, যখন তিনি তার হাতে এলেন তখন চিৎকার করলেন। তিনি এক ঘোষককে বলতে শুনেছেন, আল্লাহ তোমার ওপর অনুগ্রহ করুন। সে জায়গা থেকে একটি নূর বের হলো, যা দ্বারা রোমের প্রাসাদ দেখা গেল। -তাফসিরে ইবনে কাসির: ২/৩২৪

ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, একসময় শয়তান আসমানে যেতে পারত। সেখানে যেয়ে ফেরেশতাদের গায়েবি সংবাদ শ্রবণ করত। এরপর তাদের গণকদের কাছে তা পৌঁছে দিত। যখন হজরত ঈসা (আ.) জন্মগ্রহণ করেন তখন তাদের তিন আসমান থেকে বহিষ্কার করা হয়। আর যখন নবী করিম (সা.) জন্মগ্রহণ করেন, তখন তাদের সব আসমান থেকে বহিষ্কার করা হয়। এর পর থেকে তাদের কেউ যখন কিছু শ্রবণ করার জন্য আসমানে যায় তখন তাদের আগুনের গোলক নিক্ষেপ করে বিতাড়িত করা হয়। -তাফসিরে কাবির: ১৯/১৩০

যে রাতে নবী করিম (সা.) জন্মগ্রহণ করেন, সেই রাতে পারস্য ও ইরানের রাজপ্রাসাদে কম্পন উঠে। সেখান থেকে ১৪টি গম্বুজ ভেঙে পড়ে। এর মাধ্যমে তাদের ১৪ জন বংশধর ক্ষমতাবান হওয়ার ইঙ্গিত দেওয়া হয়। তাদের ১০ জন পরবর্তী চার বছরে ক্ষমতায় আসে, আর বাকিরা ইসলামের তৃতীয় খলিফা হজরত উসমান (রা.) শহীদ হওয়া পর্যন্ত ছিল। নবী করিম (সা.)-এর জন্মের দিন পারস্যের আগুন নিভে যায়, যা হাজার বছর ধরে প্রজ্বলিত ছিলো। সে দেশের ছোট ছোট নদীর পানি শুকিয়ে যায়। -বায়হাকি. দালাইলুন নবুয়্যাহ: ১/১২৬

নবী করিম (সা.)-এর পবিত্র জন্মে গোটা বিশ্বে সাড়া পড়ে যায়। তার জন্মের পর তিন দিন পর্যন্ত কাবা শরিফ দুলতে থাকে। এটা দেখে গোটা আরবের লোকেরা হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্ম সম্পর্কে জানতে পারে। সিরাতে হালবিয়া নামক গ্রন্থে এসেছে, ‘যে রাতে নবী করিম (সা.) জন্মগ্রহণ করেন, সেই রাতে কাবা শরিফে কম্পন শুরু হয়। সেটি তিন দিন তিন রাত চলতে থাকে। সেটি ছিল প্রথম নিদর্শন, যা নবী করিম (সা.)-এর জন্মের পর গোটা কোরাইশ গোত্র দেখতে পেয়েছিল।’ -সিরাতে হালবিয়া, নবী (সা.)-এর জন্ম অধ্যায়

নবী করিম (সা.)-কে সোমবারের রোজা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘এই দিনে আমি জন্মগ্রহণ করেছি এবং এই দিনে আমাকে নবুওয়ত দান করা হয়েছে।’ –সহিহ মুসলিম শরিফ: ১১৬২

মুসলিম শরিফে বর্ণিত বিশুদ্ধ এই হাদিসের আলোকে জানা যায়, নবী করিম (সা.)-এর জন্মদিনে উম্মতের করণীয় কী? এই দিনে উম্মতের করণীয় হলো- রোজা রাখা। তার প্রতি অধিক পরিমাণে দরূদ ও সালাম পাঠ করা। অন্য হাদিসে নবী করিম (সা.) বলেন, ‘সোমবার ও বৃহস্পতিবার বান্দার আমলনামা আল্লাহর দরবারে উপস্থাপন করা হয়। সুতরাং রোজা অবস্থায় আমার আমলনামা উপস্থাপন করা হোক, এটা আমি পছন্দ করি।’ –সুনানে তিরমিজি: ৭৪৭

তাই নবী করিম (সা.)-এর জন্মের দিনে নফল রোজা রাখা প্রকৃত নবীপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ। সবচেয়ে বড় কথা হলো- নবী করিম (সা.)-এর জন্মের ঘটনার চেয়েও তার সর্বব্যাপ্ত জীবনাদর্শ আমাদের জন্য অধিক প্রয়োজনীয়। নবী করিম (সা.)-এর জন্মের বিষয়টি একান্ত তার ব্যক্তিগত। কিন্তু তার সিরাত বা জীবনাদর্শ সব যুগের, সব মানুষের জন্য। বিশ্বমানবতার মুক্তির জন্য। আর নবীপ্রেমের প্রথম শর্ত হলো- নবীর আনুগত্য। বাস্তব জীবনে এর প্রতিফলন না ঘটলে নবীপ্রেমের দাবি অর্থহীন।