মাদরাসাতুর রহমান আল আরাবিয়া

অন্ধ ও বধিররা যেখানে কোরআন শিখছেন

  • মুফতি এনায়েতুল্লাহ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

মাদরাসাতুর রহমান আল আরাবিয়া, দক্ষিণখান, উত্তরা, ঢাকা, ছবি: বার্তা২৪.কম

মাদরাসাতুর রহমান আল আরাবিয়া, দক্ষিণখান, উত্তরা, ঢাকা, ছবি: বার্তা২৪.কম

দেশে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৫০ লাখ। এর মাঝে শারীরিক প্রতিবন্ধীর সংখ্যা বেশি হলেও দৃষ্টি ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের সংখ্যা ৩০ লাখের মতো। প্রতিবন্ধী হওয়ার কারণে তাদের ৯৮ শতাংশ কোনো না কোনো সময় বৈষম্যমূলক আচরণ ও নানাবিধ নিগ্রহের শিকার হন। বাংলাদেশের ভিক্ষুকদের বড় একটি অংশ প্রতিবন্ধী। সমাজের অনেকেই প্রতিবন্ধীদের নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেন। সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও প্রতিবন্ধীদের প্রতি মানুষের সহনশীল মনোভাব গড়ে ওঠেনি। সমাজের মূল স্রোতে সেভাবে তাদের অংশগ্রহণ এখনও দেখা যায় না।

সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে অন্ধ ও বধিরদের জন্য বিশেষায়িত বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকলেও সেভাবে ইসলাম শেখানো কিংবা পবিত্র কোরআন শেখানোর মতো কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। অথচ যথাযথ উদ্যোগ নিলে তারা ইসলাম শেখার পাশাপাশি কোরআনের হাফেজ ও আলেম হয়ে সমাজে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি অন্যের বোঝা না হয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখবে।

বিজ্ঞাপন

এই বাস্তবতা উপলব্ধি করে এগিয়ে আসেন মুফতি বখতিয়ার হোসাইন সরদার। তিনি মাদরাসাতুর রহমান আল আরাবিয়ার প্রতিষ্ঠাতা ও মুহতামিম। রাজধানীর দক্ষিণখানের সরদার বাড়িতে বাবা-চাচাদের দেওয়া ওয়াকফ জায়গায় তিনি ১৯৯৭ সালে মাদরাসাটি প্রতিষ্ঠা করেন। এখন সেখানে ৬ তলা ভবন হয়েছে। শিক্ষা কার্যক্রমের পরিধি বেড়েছে। মক্তব থেকে শুরু করে দাওরায়ে হাদিস পর্যন্ত পাঠদানসহ আরও কয়েকটি বিভাগ রয়েছে। এই মাদরাসায় ২০০৮ সালে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বিভাগ চালু করা হয়। এই বিভাগে ব্রেইল পদ্ধতিতে মক্তব, নাজেরা, হেফজ ও কিতাব বিভাগের মেশকাত জামাত পর্যন্ত নিয়মতান্ত্রিকভাবে পাঠদান করা হয়।

মাদরাসাতুর রহমান আল আরাবিয়া, দক্ষিণখান, উত্তরা, ঢাকা, ছবি: বার্তা২৪.কম


বর্তমান অন্ধ ছাত্রসংখ্যা ১০০, তাদের আবাসন, খাবার, পোশাক ও চিকিৎসা মাদরাসার পক্ষ থেকে বিনামূল্যে দেওয়া হয়। খরচ বহন করেন শুভাকাঙ্ক্ষীরা। এখান থেকে হিফজ শেষ করে ৭০ জন অন্ধ হাফেজ দেশের বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষকতা করছেন। হাফেজ হওয়ার পাশাপাশি অন্ধদের জন্য দাওরায়ে হাদিস (মাস্টার্স) পড়ারও সুযোগ রয়েছে এখানে। কিতাবগুলোও ব্রেইল পদ্ধতির। ২০২৫ সালে দুইজন অন্ধ ছাত্র আলেম হবেন বলে জানালেন প্রিন্সিপাল মুফতি বখতিয়ার।

তিনি জানান, ‘পুরো পৃথিবীতে এই দুইজন হবেন ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়াশোনা করা প্রথম আলেম।’ মাদরাসাতুর রহমানে অন্ধ শিক্ষক আছেন ৭ জন, তাদের সহযোগী শিক্ষক আছেন আরও ৫ জন। অন্ধরা ২-৩ বছরের মধ্যে হাফেজ হতে পারে। ‘আমরা অন্ধদের সর্বোচ্চ সম্মান দিই। এতে অন্ধরা খুশি হয়। ফলে এখান থেকে কেউ সহজে যেতে চায় না’- বললেন মুফতি বখতিয়ার।

তিনি জানালেন, অন্ধ শিক্ষার্থীরা কোনোভাবেই পিছিয়ে নেই। গত রমজানে আন্তঃমাদ্রাসা বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের (দৃষ্টি প্রতিবন্ধী) নিয়ে হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিযোগিতার অধিকাংশ বিজয়ীই ছিল মাদরাসাতুর রহমানের ছাত্র। বিজয়ীদেরকে শারজাহ চ্যারিটি ইন্টারন্যাশনাল (এসসিআই) বাংলাদেশ অফিস পবিত্র উমরাপালনের ব্যবস্থা করে।

ছেলেদের পাশাপাশি ১৫ জন অন্ধ মেয়ে পড়েন এখানে। তাদের জন্য আলাদা ভবন রয়েছে। এভারকেয়ার হাসপাতালের ডাক্তারদের পরামর্শ অনুযায়ী তাদের জন্য অবকাঠামো তৈরি করেছেন মুফতি বখতিয়ার। কম্পিউটার ল্যাব, ব্রেইল পদ্ধতির কিতাবাদি প্রিন্টের জন্য আলাদা প্রিন্টার, প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্র ও কাপড় ধোয়ার মেশিনও রয়েছে।

বধির ছাত্ররা পড়াশোনা করছেন, ছবি: বার্তা২৪.কম

দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বিভাগের পর মাদরাসাতুর রহমানে ২০২৩ সালে অক্টোবর মাসে বাকপ্রতিবন্ধী বিভাগ চালু করা হয়। বর্তমানে ৮ জন ছাত্র এই বিভাগে পড়াশোনা করছে। দুইজন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। মাদরাসার উদ্যোগে একজন শিক্ষককে সৌদি আরবের তায়েফ থেকে বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে আনা হয়েছে।

বোবাদের আরবি শিক্ষক মুফতি রেদওয়ান রাশেদি জানান, ‘ইশারা ভাষা বা সাংকেতিক ভাষা বা প্রতীকী ভাষা বা ইংরেজি Sign language বলতে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিশেষ করে হাত ও বাহু নাড়ানোর মাধ্যমে যোগাযোগ করার পদ্ধতিকে বোঝানো হয়। মুখের ভাষায় যোগাযোগ করা অসম্ভব বা অযাচিত হলে এই ভাষা ব্যবহার করা হয়। সম্ভবত মুখের ভাষার আগেই ইশারা ভাষার উদ্ভব ঘটে। মুখের বিশেষ ভঙ্গিমা, কাঁধের ওঠানামা কিংবা আঙুল তাক করাকে এক ধরনের মোটাদাগের ইশারা ভাষা হিসেবে গণ্য করা যায়। তবে প্রকৃত ইশারা ভাষাতে হাত ও আঙুল দিয়ে সৃষ্ট সুচিন্তিত ও সূক্ষ্ম দ্যোতনাবিশিষ্ট সংকেত সমষ্টি ব্যবহৃত হয় এবং এর সঙ্গে সাধারণত মুখমণ্ডলের অভিব্যক্তিও যুক্ত করা হয়। বাক শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিগণ নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য ইশারা ভাষার ব্যবহার করে থাকেন। এটা সময়সাপেক্ষ বিষয়, তার পরও আমরা চেষ্টা করছি।

দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বিভাগ, ছবি: বার্তা২৪.কম

মাদরাসাতুর রহমান আল আরাবিয়ায় ভাইস-প্রিন্সিপাল ও এয়ারপোর্ট জামে মসজিদের খতিব মাওলানা আখতারুজ্জামান বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ, আমরা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ছাত্র-ছাত্রীদের অন্তর চক্ষু খুলে দেওয়ার মেহনতের সঙ্গে যুক্ত আছি। আমাদের এই কাজকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য ধর্মপ্রাণ মানুষ নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করে আসছেন। আল্লাহতায়ালা তাদের এই মহৎ কাজকে কবুল করুন, এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে উত্তম বিনিময় দান করুন।’

তিনি আরও বলেন, ‘অন্ধ ও বোবা ছাত্ররা প্রায়ই অসহায় ও গরিব ঘরের হয়। তাদের কাছ থেকে টাকা নিলে পড়তে চাইবে না। আমরা চাই, তারা দ্বীন শিখুক, ভালো মানুষ হোক। ভালোবাসা আর মায়া দিয়ে তাদের পড়াই।’