দরসবাড়ি মসজিদ বাংলার গৌরব

  • ইসলাম ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

দরসবাড়ি মসজিদ, শিবগঞ্জ,  চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ছবি : সংগৃহীত

দরসবাড়ি মসজিদ, শিবগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে নানা ঐতিহাসিক স্থাপত্য। যেগুলোর কোনোটি সাক্ষ্য দিচ্ছে মুঘল আর কোনোটি সুলতানি কিংবা ব্রিটিশ আমলের। সেসময় বিভিন্ন রাজা, নবাব কিংবা বাদশাহ যাই বলি না কেন। অর্থাৎ যারা দেশ শাসন করেছেন। নিজেদের অস্তিত্বের কথা জানান দিতেই তৈরি করেছেন বিভিন্ন মসজিদ এবং স্থাপত্য। এর মধ্যে অনেকগুলো এখনও টিকে আছে। কিছু আবার ধ্বংস প্রায় আর বাকিগুলো বিলীন। তবে আজ যেই মসজিদটির কথা বলছি সেটি বাংলার গৌরব দরসবাড়ি মসজিদ নামেই পরিচিত। এটি আমাদের পূর্ব পুরুষদের সৃষ্টি।

সুলতানি আমলে অবিভক্ত বাংলার রাজধানী গৌড়ে তৈরি স্থাপত্যগুলোর মধ্যে দরসবাড়ি মসজিদটি এক অপূর্ব সৃষ্টি এবং আকারের দিক দিয়ে ৩য় স্থান অধিকার করে আছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় এই মসজিদটি অবস্থিত। এই জেলার ছোট সোনা মসজিদের খুব আছেই এর অবস্থান। ৫৪০ বৎসরের পুরোনো এই মসজিদটি স্থাপত্যকলা এখনও আমাদের চোখ জুড়িয়ে দেয়। আমরা মুগ্ধ হয়ে এর নির্মাণ শৈলী দেখি।

বিজ্ঞাপন

সোনামসজিদ স্থল বন্দর থেকে মহানন্দা নদীর পাড় ঘেঁষে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশ রাইফেলস-এর সীমান্ত তল্লাশী ঘাঁটি। এই ঘাঁটির অদূরে অবস্থিত দাখিল দরওয়াজা। দাখিল দরওয়াজা থেকে প্রায় এক কিলোমিটার হেঁটে আমবাগানের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে একটি দিঘী পার হয়ে দক্ষিণ পশ্চিমে ঘোষপুর মৌজায় দরসবাড়ি মসজিদ ও দরসবাড়ি মাদ্রাসা অবস্থিত। লাল ইট আর টেরাকোটার কাজ করা মসজিদটি বহুদিন মাটির নিচে চাপা পড়েছিল।

কে, কবে তৈরি করেছিল জানা ছিল না। হঠাৎ করেই মুনশী এলাহী বক্স নামে একজন লোক একটি আরবি শিলালিপি খুঁজে পান। রহস্যের সমাধান হয়। ওই শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, ১৪৭৯ সালে সুলতান শামসুদ্দিন ইউসুফ শাহের রাজত্বকালে তারই নির্দেশে মসজিদটি তৈরি করা হয়। তখন মসজিদটির নাম ছিল ফিরোজপুর। ১৫০২ সালে সুলতান হোসাইন শাহ যখন দরসবাড়ি বিশ্ববিদ্যালয়টি নির্মাণ করেন তখন থেকে মসজিদটির নাম হয়ে যায় দরসবাড়ি মসজিদ।

মজার ব্যাপার হলো, মসজিদটির নাম অনুসারে এলাকাটিকেও সবাই দরসবাড়ি বলে থাকে। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন এটি সুলতানি আমলের শেষ স্থাপত্য।

মসজিদের ভেতরের অবস্থা

 

দীর্ঘদিন মাটিচাপা পড়েছিল এ মসজিদ। সত্তর দশকের প্রথমভাগে খনন করে এটিকে উদ্ধার করা হয়। মসজিদটি দীর্ঘকাল আগে পরিত্যক্ত হয়েছে, বর্তমানে চারপাশে গাছগাছালির ঘের। পরিচর্যার অভাবে এ মসজিদটি বিলীয়মান। এর সংলগ্ন সমসাময়িক আরেকটি স্থাপনা হলো দারাসবাড়ি মাদরাসা। দিঘীর এক পারে মসজিদ এবং অন্য পারে মাদরাসা অবস্থিত। আকারে এটি ছোট সোনা মসজিদের চেয়েও বড়।

ইট নির্মিত এই মসজিদের অভ্যন্তরের আয়তক্ষেত্র দুই অংশে বিভক্ত। এর আয়তন ৯৯ ফুট ৫ ইঞ্চি, ৩৪ ফুট ৯ ইঞ্চি। পূর্ব পার্শ্বে একটি বারান্দা, যা ১০ ফুট ৭ ইঞ্চি। বারান্দার খিলানে ৭টি প্রস্তত স্তম্ভের ওপরের ৬টি ক্ষুদ্রাকৃতি গম্বুজ এবং মধ্যবর্তীটি অপেক্ষাকৃত বড় ছিল। ওপরে ৯টি গম্বুজের চিহ্নাবশেষ রয়েছে উত্তর দক্ষিণে ৩টি করে জানালা ছিল। এর পশ্চিম দেয়ালে পাশাপাশি ৩টি করে ৯টি কারুকার্য খচিত মেহরাব বর্তমান রয়েছে। এই মসজিদের চারপার্শ্বে দেয়াল ও কয়েকটি প্রস্তর স্তম্ভের মূলদেশ ব্যতীত আর কিছুই এখন অবশিষ্ট নেই। এখানে প্রাপ্ত তুঘরা শৈলীতে উৎকীর্ণ ইউসুফি শাহী লিপিটি এখন কোলকাতা জাদুঘরে রক্ষিত আছে।

এই মসজিদটির একটি বিশেষত্ব হচ্ছে, এখানে একটি রয়েল গ্যালারি আছে। অনেকে এই রয়েল গ্যালারিকে নারীদের বসার স্থান ভেবে ভুল করে। মসজিদের উত্তর পশ্চিম কোণে এটি অবস্থিত। আসলে এটি ছিল সুলতানদের বসার নির্দিষ্ট জায়গা, যেখানে তারা সিঁড়ি দিয়ে সরাসরি উঠে যেতে পারতেন।

মসজিদটির নিখুঁত কারুকাজ করা মেহরাবগুলো চোখে পড়ার মতো। বহুদিন ব্যবহার না করার জন্য ধীরে ধীরে এর ছাদ ও বিশাল বারান্দাগুলো ধসে পড়ে। আনাচে কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে কতগুলো পিলার ও তাদের স্মৃতি। তবে এর পরিচয়স্বরূপ এখনও একটি মেহরাব রয়েছে। বাংলা ও মুসলিম স্থাপত্যকলার সংমিশ্রণ এই দরসবাড়ি মসজিদটি। বাংলায় যেহেতু পাথরের অভাব ছিল, সেই অভাব সুন্দরভাবে পূরণ করেছে অপূর্ব এই লাল টেরাকোটার নকশা।