জাতির প্রধান চালিকাশক্তি শিক্ষক সমাজ

  • এইচএম মুশফিকুর রহমান, অতিথি লেখক, ইসলাম, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

আল্লাহতায়ালা নিজে এবং তার ফেরেশতাগণ, আসমান ও জমিনের সব অধিবাসী এমনকি গর্তের পিপীলিকা ও (পানির) মাছ পর্যন্ত মানুষকে কল্যাণপ্রসূ শিক্ষকের জন্য দোয়া করেন। -তিরমিজি

আল্লাহতায়ালা নিজে এবং তার ফেরেশতাগণ, আসমান ও জমিনের সব অধিবাসী এমনকি গর্তের পিপীলিকা ও (পানির) মাছ পর্যন্ত মানুষকে কল্যাণপ্রসূ শিক্ষকের জন্য দোয়া করেন। -তিরমিজি

শিক্ষক শব্দটার মধ্যে অমিত শক্তি ও মর্যাদা সুপ্ত আছে। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে এ পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা সম্মান ও মর্যাদা পেয়ে থাকেন। শিক্ষকরা হলেন সেই সব ব্যক্তি, যারা শিখন ও শিক্ষাদান কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত। শিক্ষা-পরিবারে নিয়োজিতরা শিক্ষার্থীদের কর্মদক্ষতা অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে আত্মমর্যাদা, দায়িত্ব সচেতনতা ও কর্তব্যবোধের শিক্ষা দিয়ে থাকেন।

শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। আর সেই মেরুদন্ডকে সোজা রাখতে শিক্ষকের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। ইসলাম শিক্ষককে উচ্চমর্যাদায় ভূষিত করেছে। ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন শিক্ষানুরাগী। তিনি বলেছেন, ‘আমাকে শিক্ষক হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে।’ -ইবনে মাজাহ : ২২৯

বিজ্ঞাপন

তাই তিনি শিক্ষা, শিক্ষা উপকরণ, শিক্ষক ও শিক্ষার ব্যাপকীকরণে সদা সচেষ্ট ছিলেন। বদরের যুদ্ধবন্দীদের তিনি মদিনার শিশুদের শিক্ষা দেওয়ার বিনিময়ে মুক্তির ব্যবস্থা করেছিলেন, যা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। জ্ঞানান্বেষণের গুরুত্ব ও শিক্ষকের মর্যাদা প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেছেন, ‘যারা জানে এবং যারা জানে না তারা কি সমান হতে পারে?’ -সুরা জুমার : ৯

সাহাবি হজরত আনাস বিন মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা বলতে পারো কি, দানের দিক দিয়ে সর্বাপেক্ষা বড় দাতা কে? সাহাবারা উত্তর বললেন, আল্লাহ ও তার রাসুলই (সা.) অধিক অবগত। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, দানের দিক দিয়ে আল্লাহ হচ্ছেন সর্বাপেক্ষা বড়। অতঃপর বনি আদমের মধ্যে আমিই সর্বাপেক্ষা বড় দাতা। আর আমার পর বড় দাতা হচ্ছে সেই ব্যক্তি, যে ইলম (জ্ঞান) শিক্ষা করবে এবং তার প্রচার-প্রসার করতে থাকবে। কেয়ামতের দিন সে একাই (দলবলসহ) একজন আমির অথবা (হাদিস বর্ণনাকারীর সন্দেহ) একটি উম্মত হয়ে উঠবে।’ –মিশকাত

বিজ্ঞাপন

নবী মুহাম্মদ (সা.) আরও ইরশাদ করেন, ‘তোমরা জ্ঞান অর্জন করো এবং জ্ঞান অর্জনের জন্য আদব-শিষ্টাচার শেখো এবং তাকে সম্মান করো, যার থেকে তোমরা জ্ঞান অর্জন করো।’ –আল মুজামুল আউসাত : ৬১৮৪

খেলাফতের যুগে ইসলাম প্রত্যেকের জন্য শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছিল। তৎকালীন সময়ে শিক্ষাকে সহজলভ্য করতে এখাতে সম্মানজনক পারিশ্রমিক নির্ধারণ করা হয়েছিল। যদিও দ্বীনি শিক্ষার শিক্ষকরা কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জ্ঞান বিতরণ করে থাকেন। তবুও তারা যেহেতু নিজেদের জীবিকার পেছনে জীবনের ঘোড়া না ছুটিয়ে জ্ঞান বিতরণের পবিত্র কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন, তবে তাদের এ কাজকে সম্মান জানিয়ে তাদের ও তাদের পরিবার-পরিজনের দায়িত্বভার নেওয়া নিজেদের ওপর ফরজ করে নিয়েছিল তৎকালীন খেলাফত (সরকার), যাতে শিক্ষকদের জীবনের তাকিদে কোনো ভিন্ন পথে পা বাড়াতে না হয়।

ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর (রা.) ও তৃতীয় খলিফা হজরত উসমান (রা.) তাদের শাসনামলে শিক্ষাখাতকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। তারা শিক্ষক ও ধর্মপ্রচারকদের জন্য বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা করেছিলেন। যেমন হজরত ইবনে জাউজি (রহ.) তার গ্রন্থ ‘সিরাতুল উমরাইনে’র মধ্যে উল্লেখ করেন, ‘হজরত উমর (রা.), হজরত উসমান (রা.)-এর যুগে মুয়াজ্জিন, ইমাম ও শিক্ষকদের সরকারি ভাতা দেওয়া হতো।’ -কিতাবুল আমওয়াল : ১৬৫

মুসলিম সমাজে শিক্ষক মাত্রই বিশেষ মর্যাদার অধিকারী। তাই শিক্ষকদের প্রতি আমাদের সবার সর্বোচ্চ সম্মান দেখানো উচিত। কারণ শিক্ষকেরা মানুষ তৈরির কারিগর। শিক্ষকেরা জাতির প্রধান চালিকাশক্তি। এককথায় বলা যায়, শিক্ষক মানুষ চাষ করেন। যে চাষাবাদের মধ্য দিয়ে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটিয়ে নীতি-নৈতিকতা ও জীবনাদর্শের বলয় একজন শিক্ষার্থী তার ব্যক্তিগত ও কর্মময় জীবনকে মুখরিত করে। পাশাপাশি পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র তার দ্বারা উপকৃত হয়।

যুগে যুগে শিক্ষকরা মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবেই কাজ করে আসছেন। অতীতে শিক্ষানুরাগীদের শিক্ষকের বাড়ি গিয়ে শিক্ষা গ্রহণ করতে হতো। এতে শিক্ষাগুরুরা তাদের জ্ঞান, সঞ্চিত অভিজ্ঞতা, দর্শন, মন-প্রাণ-অন্তর, এমনকি ভরণ-পোষণসহ শিক্ষানুরাগীদের শিক্ষা দিয়ে এমনভাবে গড়ে তুলতেন যেন এরা বড় হয়ে উন্নততর ও উচ্চতর জীবনবোধ এবং বিবেকবোধ নিয়ে সমাজ ও সংস্কৃতির ধারক-বাহক হয়।

শিক্ষকরা সবসময়ই আর্থিকভাবে দুর্বল। তাই পরবর্তীতে সময় ও জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম হিসেবে শিক্ষাদান পদ্ধতি গড়ে ওঠে এবং শিক্ষা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। এই প্রতিষ্ঠানগুলো স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত। শিক্ষকরা যেন নির্বিঘ্নে ও স্বাধীনভাবে শিক্ষাদান করতে পারেন সেজন্য সমাজহিতৈষী, সরকার, এমনকি সমাজের সাধারণ মানুষের সহযোগিতায় এসব অলাভজনক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে।

সামাজিক দায়িত্ব ও মর্যাদার দিক থেকে শিক্ষকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও জাতীয়ভাবে শিক্ষকদের তেমন সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় না। দেশের অন্যান্য পেশার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র মনোযোগী হলেও শিক্ষকদের ক্ষেত্রে বেশ অবহেলা আর উদাসীনতার পরিচয় দেয়। যুগের পর যুগ অতিক্রান্ত হয়েছে কিন্তু শিক্ষকদের নির্মম ভাগ্য আজও বদলায়নি।

শিক্ষাদানের পাশাপাশি আদমশুমারি, ভোটার তালিকাভুক্তি, টিকাদান, শিশু জরিপ, উপবৃত্তি বিতরণ, স্যানিটেশনসহ বিভিন্ন সামাজিক উদ্বুদ্ধকরণ কার্যক্রমে শিক্ষকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

শিক্ষকরা সমাজ বিনির্মাণে বিশেষ ভূমিকা রাখার পরও শিক্ষকতার মতো মহান পেশাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের নজরে দেখা হয়। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

শিক্ষকের জীবনধারণের জন্য যথেষ্ট অর্থের প্রয়োজন হয়। অথচ এই পেশায় যারা নিয়োজিত, তাদের নেই কোনো অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা। সামাজিক মর্যাদা ও সম্মানজনক জীবনধারণ উপযোগী বেতন-ভাতা না থাকায় মেধাবীরা শিক্ষকতায় আকৃষ্ট হচ্ছেন না। শিক্ষকদের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার অভাব, এ দুর্মূল্যের বাজারে বেতন-ভাতার অপ্রতুলতা, শিক্ষাকে রাজনীতিকরণ এবং বাণিজ্যিকীকরণের উদ্ভট মানসিকতা, শিক্ষকদের প্রতি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সীমাহীন ঔদাসীন্য ও অবহেলাই যেন এ পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য বহুলাংশে দায়ী।

বলতে লজ্জা হয়, দেশের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষকদের লাঞ্ছিত ও শারীরিকভাবে নিগৃহীত হতে দেখা যায়। এটা অত্যন্ত ঘৃণ্য ও অমানবিক কাজ।

অবশ্য বর্তমান সমাজব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন ঘটেছে, বিশেষ করে বাংলাদেশে। এখানে নীতি, আদর্শ, দায়িত্ব ও কর্তব্য ইত্যাদি শব্দের প্রকৃত ব্যাখ্যার পরিবর্তন ঘটেছে এবং তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যে পরিণত হয়েছে। অতীতের মতো শিক্ষকরা বিভিন্ন কারণে তাদের স্বতন্ত্র ও স্বাধীন অবস্থান ধরে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। শিক্ষকতা একটি মহৎ পেশা হলেও অনেকেই অনন্যোপায় ও বাধ্য হয়ে জীবিকার তাগিদে বেছে নিয়েছে এই পথ। শুধু জীবিকার তাগিদে যারা আসে, তারা মেধা মননশীলতা, দায়িত্ব-কর্তব্য, যোগ্যতা ইত্যাদি উপেক্ষা করে রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে, প্রভাবশালীদের প্রভাবে অথবা অর্থের বিনিময়ে ও উভয়ের সহযোগিতায় শিক্ষক হচ্ছে। এরা শিক্ষকতাকে পুঁজি করে অর্থবিত্ত-বৈভবের পেছনে ছুটে চলেছে। এদের চাতুর্যপূর্ণ চটকদারি প্রচারণা ও দৌরাত্ম্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক সমাজ অসহায় হয়ে পড়েছে।

বিশ্ব শিক্ষক দিবস (৫ অক্টোবর) বিকশিত অবদানের মাধ্যমে সচেতনতা, সমঝোতা এবং উপলব্ধির বহিঃপ্রকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। যা শিক্ষকদের শিক্ষার প্রগতিকে আরও প্রসারিত করবে নিঃসন্দেহে।

দেশব্যাপী শিক্ষকদের বৈধ অধিকার ও মর্যাদা সুরক্ষা, শিক্ষকদের জীবনের মানউন্নত করার ব্যাপারে বিভিন্ন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা , আদর্শ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে সুন্দর সম্পর্ক তৈরি করা এবং শিক্ষাঙ্গনে সুষ্ঠু শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টি করা, বিশেষ করে ফুরকানিয়া মাদরাসা, ইবতেদায়ী মাদরাসা, হাজার হাজার কওমি মাদরাসা, নূরানি মাদরাসা ও হিফজ মাদরাসার শিক্ষকদের সমাজের মূল স্রোতের সঙ্গে একীভূত করে তাদেরও বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদানে সরকারের মনোযোগ কার্যকর মনোযোগ দরকার। এটাই হোক এবারের বিশ্ব শিক্ষক দিবসের প্রত্যাশা।