মুমিনের সফলতা ও শয়তানের ব্যর্থতা
শয়তানের ধোঁকা আর ভালো কাজের মধ্যে পার্থক্য খুব সূক্ষ্ম। উভয়টির মধ্যে ভেদ এতই অস্পষ্ট যে, নিগূঢ় চিন্তাভাবনা ও আল্লাহতায়ালার রহমত ছাড়া তা বুঝতে পারা অসম্ভব! এটা বুঝার জন্য ছোট্ট একটা দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যেতে পারে।
এক ব্যক্তি হজরত হাসান বসরি রহমাতুল্লাহি আলাইহির কাছে জানতে চাইলো, কেউ একজন গুনাহ করলো, অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে মাফ চাইলো। আবার গুনাহ করলো এবং আবার মাফ চাইলো। ফের গুনাহে লিপ্ত হলো। এই ব্যক্তির কি এখন আবার মাফ চাওয়া থেকে লজ্জিত হওয়া উচিত না। আপাতঃদৃষ্টিতে কথাটি খুবই যৌক্তিক। বারবার কথার বরখেলাফ করে কোন মুখে আবার মাফ চাওয়া! শয়তানের খেলটা এখানেই। সুন্দর যুক্তির ফাঁদে ফেলে মানুষকে ধোঁকা দেওয়া। কিন্তু যারা আল্লাহতায়ালা সম্পর্কে জানেন, আল্লাহর জাত ও সিফাত সম্পর্কে অবগত- তারা কিন্তু শয়তানের ধোঁকা সম্পর্কে পূর্ণ অবগত। তারা জানেন, রহমানের রহমত যুক্তির আওতায় আনা অসম্ভব! অসংখ্যবার গুনাহে লিপ্ত ব্যক্তির জন্যও রয়েছে ক্ষমার ঘোষণা।
তাই তো হাসান বসরি (রহ.) বললেন, শয়তান এ যুক্তি দিয়েই তোমাদের ওপর বিজয় লাভ করতে চায়, যেন তোমরা ইস্তিগফার না করো।
মানুষ মাত্রই ভিন্ন চিন্তার হয়ে থাকে। এর প্রভাবে মুমিনের অন্তরেও বিভিন্ন ধরণের চিন্তা, অবস্থা ও ভাব উঠানামা করে। কখনও ইবাদত-বন্দেগি ও আমলের প্রতি থাকে পূর্ণ আবেগ-উদ্যম। আবার কখনও মন দুনিয়ার প্রতি বেশি ঝুঁকে যায়। মানুষের মনের এই দুই অবস্থায়ই শয়তান সুযোগ খুঁজে। চেষ্টা করে পথভ্রষ্ট করার।
যখন দুনিয়ার দিকে মন ঝুঁকে যায়, শয়তানের প্ররোচণায় সে ভাবে- হায়! আমি তো দুনিয়াদার হয়ে গেছি। আমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। সব আমল সব নষ্ট হয়ে গেছে। ভাবনাটি অতি উত্তম। আসলেই তো কোনো মুমিন কি দুনিয়াদার হতে পারে? এই ভাবনা অন্তরে গেঁথে দিতে পারলেই শয়তান সফল। সে আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠে। অথচ দুনিয়ার দিকে ঝুঁকে যাওয়ার পর যদি মন আবার আমলের প্রতি উৎসাহী হয়, সেটাও কিন্তু সফলতা। এটাতে আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি আসে।
বস্তুত কোনো আমল কখনোই বিনষ্ট হয় না। আল্লাহতায়ালা কারও সৎ কাজ নিষ্ফল করেন না। তা যখনই করুক না কেন। তাই হতাশা নয়, আল্লাহতায়ালার আহ্বান আলোর দিকে। আশার পথে, ক্ষমার পথে।
মানুষ দুনিয়ার পেছেনে ছুঁটতে পারে, এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। ওই সময়টাতে মুমিনের উচিত অধিকহারে আঊজুবিল্লাহ ও ইস্তিগফার পড়তে থাকা। দুনিয়াদার হয়ে গেছি, এই ভাবনাকে দূরে ঠেলে ইবাদত-বন্দেগিতে মনোযোগী হওয়া। মনে এমন ভাবনা যত প্রসারিত হবে, শয়তান ততই চেপে বসবে। তাই নিজেকে নিয়ে না ভেবে, কিভাবে আল্লাহতায়ালার কাছ থেকে ক্ষমা পাওয়া যায়, তার প্রিয়পাত্র হওয়া যায়- সে চেষ্টা করা আবশ্যক।
আবার মুমিন অনেক সময় ইবাদত-বন্দেগি ও আমলের প্রতি বেশি ঝুঁকে যায়। তখন শয়তানের কুমন্ত্রণার ধরণ বদলে যায়। মনের প্রশ্নের উদ্রেক ঘটায়, ‘আরে, আমি তো লোক দেখানো ইবাদত করছি, এসবে তো রিয়া (লোক দেখানো) হচ্ছে! তবে আর আমল করে কী লাভ?
রিয়ার আশঙ্কায় সব আমল ছেড়ে দিয়ে মুমিন বসে থাকে। তখনও শয়তান ব্যাপক খুশি হয়। অথচ আমল এমন এক বিষয়, যা সব সময় সর্বাবস্থায় গোপন রাখা সম্ভব না। যদি সব আমল গোপনে পালন করা হতো, তবে তো আমরা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমল সম্পর্কে জানতে পারতাম না, শিখতে পারতাম না সাহাবাদের থেকে, পূর্ববর্তী পীর-বুজুর্গদের থেকে।
ইসলামি স্কলারদের অভিমত হলো- আমল প্রকাশ হয়ে যাওয়া কোনো রিয়া নয়। প্রকৃত অর্থে রিয়া হলো- নিজেকে বড় ভেবে আমল বলে বেড়ানো অথবা রবের সন্তুষ্টির সঙ্গে সঙ্গে লোকদের বাহবা কুড়ানোর নিয়ত ও অভিলাষ থাকা। যদি আমলের ক্ষেত্রে নিয়ত থাকে শুধুমাত্র আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি, আর নিজের অজান্তে প্রকাশিত আমলের জন্য লোকের প্রশংসা অন্তরে তৃপ্তির না আসে- তাহলে তা রিয়া হবে না। কিন্তু আমার আমল রিয়া হচ্ছে, এই ভেবে আমল ছেড়ে দেওয়াটা শয়তানের কাছে পরাজয়। এটা মনে রেখে আমল জারি রাখতে হবে।
বস্তুত সৃষ্টির শুরু থেকে শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু। এই অভিশপ্ত শয়তান আল্লাহতায়ালার কাছে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে এসেছে মানুষকে পথভ্রষ্ট করবে বলে। সে তার সংকল্প পূরণে মানুষের আমলের পথে নানাভাবে, নানাপন্থায় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।
আলেমের কাছে আসে বিভিন্ন বিষয়ের খুটিনাটি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিয়ে, আবেদের কাছে ইবাদতের লেবাসে, সাধারণ মুসলিমের কাছে ঠুনকো অজুহাতে। সেসবে কর্ণপাত করা মানে অর্ধেক বিপথে চলে যাওয়া। তাই সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে শুধু শরীয়তের দিকে দৃষ্টি রেখে, একমাত্র আল্লাহতায়ালা সন্তুষ্টির জন্য আমল ও ইবাদত-বন্দেগি করে যাওয়াই মুমিনের সফলতা ও শয়তানের ব্যর্থতা। আর এ পেথেই মিলবে আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি।