রাসূলের আদর্শ অনুসরণেই সম্ভব দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন
দুর্নীতি বাংলাদেশের অন্যতম সমস্যা। প্রতিদিনই এ সংক্রান্ত নানা খবর আমরা পাই। অবশ্য সবাই দুর্নীতি করেন না। প্রচুর সৎ মানুষও আছেন। তবে যারা সৎ পথে চলতে চান, তারা কিন্তু দুর্নীতিবাজদের কারণে শান্তির সঙ্গে চলতে পারেন না। এ ধরণের উদাহরণ আমাদের চারপাশে হরহামেশাই নজরে আসে। দেশের উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা, আইনের শাসন থেকে শুরু করে সার্বিকভাবে ইতিবাচক সমাজ পরিবর্তনের পথে দুর্নীতি কঠোর প্রতিবন্ধক।
দেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আইন থাকা সত্ত্বেও একশ্রেণির দুর্নীতি করে যাচ্ছে। সেদিন ডাক্তারের কাছে যাওয়ার জন্য সিএনজি নেই। জেলা শহরে ঢুকতেই দায়িত্ব পালনরত পুলিশ সিএনজি আটকে দেয়। একটু বিচলিত হলাম। তেমন কোনো সমস্যা দেখলাম না। চালক আর পুলিশ একটু দূরে যেয়ে কিছুক্ষণ কথা বলে কোথায় যেন ফোন করল, ব্যস! সমস্যা কেটে গেলো। ছাড়া পেলো সিএনজি। কিছুই বুঝলাম না। সিএনজি চালককে আগ্রহ নিয়ে ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে, সে বলে; অবৈধ পথেই আরাম! তার মন্তব্য শুনে আমি হতবাক। সে বলতে থাকে, তার সিএনজির কাগজপত্র নেই। তাই তাকে আটকানো হয়েছে। কিন্তু অন্য এক পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে তার চুক্তি আছে। ফোনে সে কথা বলে দিয়েছে। তাই সিএনজিটি ছেড়ে দিয়েছে। আমি জানতে চাইলাম, সিএনজির কাগজপত্র করেন না কেন? সে বলল, কাগজপত্র করতে আমাদের দেশে যে ঝামেলা, এরচেয়ে এভাবে চালানো অনেক সহজ ও নিরাপদ। কাগজ করতে যদি কোনো ঝামেলা না থাকতো তাহলেই আমি কাগজ করে নিতাম। আমার মতো এরকম অনেক আছে।
তার কথা শুনে এটা স্পষ্ট বুঝা গেলো, লোকটি অবৈধপন্থা এমনিতে অবলম্বন করেনি। অবৈধ পদ্ধতি বেশ সহজলভ্য এবং সে পথ খোলা রয়েছে। তাই সে এ পথ বেছে নিয়েছে।
অথচ ইসলাম অবৈধপথে অর্থ উপার্জন ও সে পথে চলার ব্যাপারে কঠিন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে। তিক্ত হলেও সত্য, ইসলামি জীবনবোধ ও জীবনব্যবস্থার অনুসরণের অভাব আমাদেরকে নানা সমস্যায় ঘিরে রেখেছে। এ জাতীয় সমস্যা থেকে মুক্তির যথার্থ ও স্থায়ী উপায় হচ্ছে, সমাজের সর্বস্তরে ইসলামি জীবনবোধের বিস্তার ও ইসলামি জীবনব্যবস্থার অনুসরণ।
হজরত নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যখন কোনো অন্যায় (পাপাচার, দুর্নীতি) হতে দেখে, সে যেন সম্ভব হলে তা হাত দ্বারা রুখে দেয়। আর এটা সম্ভব না হলে প্রতিবাদী ভাষা দিয়ে তা প্রতিহত করে। আর তা-ও না পারলে সে যেন ওই অপকর্মকে হৃদয় দ্বারা বন্ধ করার পরিকল্পনা করে (মনে মনে ঘৃণা করে), এটি দুর্বল ঈমানের পরিচায়ক।’ –সুনানে তিরমিজি: ২১৭২
নবী করিম (সা.) আজ থেকে সাড়ে চৌদ্দশ’ বছর আগে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। তার পর চার খলিফাও ন্যায়নিষ্ঠার সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। সে গৌরবগাঁথা ইতিহাসের সোনালী অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত। দুর্নীতিতে নিমজ্জিত একটি সমাজকে উদ্ধারের জন্য কী ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছিলেন তা লক্ষণীয়। ওই শিক্ষা ব্যবস্থার মূলে ছিল কোরআন ও হাদিস। এ শিক্ষাগ্রহণ করে গড়ে উঠেছিলেন হজরত আবু বকর (রা.), হজরত উমর (রা.), হজরত উসমান (রা.) ও হজরত আলী (রা.)-এর মতো শাসক। এ ব্যবস্থা আত্মস্থ করে এমন একদল মানুষ তৈরি হলেন, যারা অপরাধের পর বিবেকের কশাঘাতে টিকতে না পেরে নিজেদের অপরাধের বিচার প্রার্থনার জন্য রাসূলের বিচারালয়ে হাজির হতেন। নিজে ক্ষুধার্ত থেকে অভূক্তকে নিজের খাদ্য বিলিয়ে দেওয়ার মানসিকতা তৈরি হতো সে শিক্ষা দ্বারা।
ইসলাম মানুষকে অন্তঃকরণের পরিশুদ্ধতা ও পরিচ্ছন্নতা শেখায়। যাতে তার মাধ্যমে ব্যক্তিসত্ত্বার পরিচ্ছন্নতা ও পরিশুদ্ধতা অর্জিত হয়। কারণ যে ব্যক্তির অন্তর বিশুদ্ধ হয়ে যাবে, তার সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সোজা পথে চলবে। তার বিশ্বাস থাকবে একদিন আমাকে আমার রবের সামনে দাঁড়াতে হবে। এই বিশ্বাসের কারণে সে যাবতীয় অনিয়ম থেকে দূরে থাকবে। কারণ সে বিশ্বাস করে দুর্নীতি করে দুনিয়ার আইনকে ফাঁকি দিলেও পরকালে আমাকে এর জন্য কড়ায়-গণ্ডায় হিসাব দিতে হবে। এ সবকিছু আমার কাছে আমানত। এর খেয়ানত করলে কঠিন শাস্তি পেতে হবে।
এ প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা জেনে-শুনে আল্লাহ ও রাসূলের সঙ্গে এবং নিজেদের পারস্পরিক আমানতের খেয়ানত করো না।’ –সূরা আনফাল: ২৭
আমাদের দেশে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ হলো, অযোগ্য ও অসৎ ব্যক্তিদের অসদুপায়ে নিয়োগ ও পদোন্নতি। কর্মকর্তাদের কাছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পবিত্র আমানত। এ ব্যাপারে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) এ দায়িত্ব আমানত হিসেবে সাব্যস্ত করে বলেছেন, ‘আমানত নষ্ট হতে থাকলে তোমরা কিয়ামতের অপেক্ষায় থেকো।’ সাহাবি হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেছেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! কীভাবে আমানত নষ্ট হবে? তিনি বলেন, যখন অযোগ্য, অদক্ষ ব্যক্তিদের কোনো কাজের দায়িত্ব দেওয়া হবে, তখন তোমরা কিয়ামতের অপেক্ষায় থেকো।’ –সহিহ বোখারি: ৫৯
শুধু আইন প্রয়োগ করে বা শাস্তি দিয়ে দুর্নীতির পাহাড়কে টলানো যাবে না। দুর্নীতি দূর করতে হলে এই সংস্কৃতির পরিবর্তন দরকার, প্রয়োজন আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন আর নিজের সুবিধা অনুযায়ী ন্যায়-অন্যায়ের সংজ্ঞা ঠিক না করে ভেজাল-দুর্নীতি-ঘুষসহ সবধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া।
হাদিসে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘মানবদেহে রয়েছে একটি মাংসপিণ্ড, যা সুস্থ থাকলে সারাদেহ সুস্থ থাকে। আর তা অসুস্থ হলে সারাদেহ অসুস্থ হয়ে পড়ে। সেটি হচ্ছে, কলব বা অন্তর।
তাই চলুন, রাসূলের আদর্শকে আকড়ে ধরে দুর্নীতেকে বিদায় জানাই। ব্যক্তি, পরিবার সমাজ ও সর্বোপরি রাষ্ট্র যদি রাসূলের দেখানো ও বলা নীতি বাস্তবায়নে সচেষ্ট হয় তাহলে খুব সহজেই দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়া সম্ভব।
মুফতি জাওয়াদ তাহের: সিনিয়র শিক্ষক, জামিয়া বাবুস সালাম, বিমানবন্দর, ঢাকা-১২৩০।