আজমির শরিফ: উপমহাদেশের আধ্যাত্মিক কেন্দ্র

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

আজমির শরিফ: উপমহাদেশের আধ্যাত্মিক কেন্দ্র

আজমির শরিফ: উপমহাদেশের আধ্যাত্মিক কেন্দ্র

শরতের মেঘমুক্ত আকাশ প্রগাঢ় উজ্জ্বল নীলে ভরিয়ে দিয়েছে উত্তর-পশ্চিম ভারতের পুরোটা দিগন্ত। 'মওসুম আচ্ছা হ্যাঁয়', বলে রাজপুত ড্রাইভার সুখবিন্দ জানালো, 'রাজস্থানের ঊষর মরুময় অঞ্চলে এমন মখমল মসৃণ আবহাওয়া খুব কমই পাওয়া যায়।' রাজধানী জয়পুরের প্রাচীন গোলাপি শহরের আভা মেখে আমরা চলেছি পাশের শহর আজমিরে, যার অন্য নাম উপমহাদেশের আধ্যাত্মিক কেন্দ্র।

রাজস্থানের মূল শহর পেরুতেই দিগন্ত বিস্তৃত শস্যক্ষেত্রের মধ্যে দিয়ে পথ চলতে শুরু করেছে। চারপাশে গম, যবের ক্ষেতে আলোর নৃত্য তুলে বয়ে যাচ্ছে মনোহর বায়ুপ্রবাহ। মাঝে মাঝে রাজপুত গ্রাম, চা-নাস্থা খাওয়ার 'ধাবা'। ঐতিহ্যবাহী বাহারি পোষাকের রঙিন ঝলকে রাজপুতানা নারীদের আসা-যাওয়া চোখে পড়ছে কখনো কখনো।

বিজ্ঞাপন

জয়পুর-আজমির হাইওয়ের মাঝখানে পড়লো কিষাণগড় শহর, যাকে বলা হয় 'স্টোন সিটি'। মার্বেল, গ্রানাইট, পাথরের ছড়াছড়ি। রঙে কত শত বিন্যাস আর শ্যাড। উত্তর ভারতের পৃথিবীখ্যাত মুঘল প্রাসাদ ও ইমারতগুলো নির্মিত হয়েছে রাজস্থানের যোধপুর, উদয়পুর, মাকরানের বেলে ও মার্বেল পাথরে। কিষাণগড় পাইকারি ও খুচরা পাথরের মশহুর মার্কেট। শত শত ট্রাকে পিস পিস পাথর আনা-নেওয়া হচ্ছে। দামও খুবই কম।

 

কিষাণগড় থেকে একটানে আজমির পৌঁছে গেলাম। প্রাচীন রাজপুত রাজধানী শহরটিতে শাসক পৃথ্বীরাজ চৌহানের অনেক ভাস্কর। চৌহানকে পরাজিত করে মুহাম্মদ ঘুরি ভারতে মুসলিম শাসনের পত্তন করেন আর রাজধানী বানান দিল্লিতে। পরে মুঘলরা ক্ষমতা দখল করে আগ্রায় রাজধানী করেন। তথাপি রাজস্থান ও উত্তর প্রদেশের সীমান্ত ঘেঁষা আজমিরের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব মোটেও কমেনি। বিশেষ করে খাজা মইনুদ্দিন চিশতি (রহ.)- এর মাজার ও দরগাহের জন্য আজমির পরিণত হয়েছে উপমহাদেশের আধ্যাত্মিক রাজধানীতে।

মূল শহরের এক পাশে কিঞ্চিত উচ্চভূমিতে দরগাহ শরিফ। গাড়ি রেখে কয়েকটি গলিপথ পেরিয়ে ও ভিড় ঠেলে পৌঁছানো সম্ভব হলো মূল দরগাহে। বছরের সব সময়ই এখানে ভক্তদের ভিড় লেগে থাকে। ওরস ও বিশেষ বিশেষ উপলক্ষে সৃষ্টি হয় জনসমুদ্রের।            

খাজা মইনুদ্দিন চিশতি হলেন ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে বিখ্যাত সুফি সাধক। তিনি ১১৩৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন মধ্য এশিয়ায় ও ১২৩৫ সালে পরলোকগমন করেন আজমিরে। তিনি গরিবে নেওয়াজ এবং সুলতানুল হিন্দ নামেও পরিচিত। তিনি ভারতে চিশতি তরিকা বা ধারার মাধ্যমে আধ্যাত্মিক ধারা বা সিলসিলা এমনভাবে পরিচিত করেন, যা সাধারণ মুসলামনের আত্মবিকাশে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে।

চিশতিয়া ধারায় আরও অনেক বুজুর্গের নাম রয়েছে, যারা এই ধর্মীয় পরিশুদ্ধির ধারাকে পুরো উপমহাদেশে চড়িয়ে দেন বিভিন্ন দরগাহের মাধ্যমে। এজন কয়েকজন হলেন কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী (রহ.), বাবা ফরিদ (রহ.), নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রহ.) প্রমুখ।

দরগাহ ও মাজারের আশপাশের স্থাপত্য বিন্যাস ও নির্মাণ দেখে প্রাচীনত্ব বোঝা যায়। ধারণা করা হয়, খাজা মইনুদ্দিন চিশতি (রহ.) ৫৩৭ হিজরী/১১৩৮ সালে আফগানিস্তান সংলগ্ন  পূর্ব পারস্যের শকস্থান রাজ্যের চিশতি নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পারস্যেই বেড়ে উঠেন। পনেরো বছর বয়সে তাঁর পিতা-মাতা মৃত্যুবরণ করেন। তিনি তাঁর পিতার কাছ থেকে একটি বাতচক্র (উইন্ডমিল) ও একটি ফলের বাগান উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেন।

কিংবদন্তী অনুসারে, একদিন তিনি তার ফলবাগানে জল দিচ্ছিলেন তখন তার ফলবাগানে আসেন বিখ্যাত সুফি শেখ ইবরাহিম কুন্দুজি (কুন্দুজী নামটি জন্মস্থান কুন্দুজ থেকে এসেছে)। যুবক মইনুদ্দিন তটস্থ হয়ে যান এবং কুন্দুজিকে কিছু ফল দিয়ে আপ্যায়ন করেন। এর প্রতিদানস্বরূপ কুন্দুজি খাজা মইনুদ্দিনকে এক টুকরা রুটি দেন ও তা খেতে বলেন। এরপর তিনি তার সম্পত্তি এবং অন্যান্য জিনিসপত্র গরীবদের মাঝে বিতরণ করে দেন এবং জাগতিক বিশ্বের মায়া ত্যাগ করে জ্ঞানার্জন ও উচ্চ শিক্ষার জন্য তৎকালের আলোকিত শহর বুখারার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।

খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি অতঃপর বহু দেশ ভ্রমণ করেন। তৎকালীন বিভিন্ন জ্ঞানী, গুণী, পন্ডিত, দার্শনিকসহ অসংখ্য সুফি সাধকের সাথে সাক্ষাত করেন বলে নানা গ্রন্থে তথ্য পাওয়া যায়। তিনি ইরাকের বাগদাদে বড়পির হযরত আবদুল কাদির জিলানি (রহ.)- এর সাহচর্যে ৫৭ দিন অবস্থান করেন বলেও বর্ণিত আছে।

খাজা সাহেবের  জীবনীতে আরও বর্ণিত আছে যে, এ সময় আব্দুল কাদির জিলানি (রহ.) তাকে উদ্দেশ্য করে বলছিলেন, ইরাকের দায়িত্ব শায়েক শিহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দীকে আর হিন্দুস্থানের দায়িত্ব আপনাকে দেওয়া হলো। একই সংবাদ নিজ পির খাজা ওসমান হারুনির সাথে মদীনায় অবস্থান ও জিয়ারতকালে পেয়েছিলেন। ফলে তিনি আরব হতে ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান হয়ে প্রথমে লাহোর এবং পরে দিল্লি হয়ে আজমিরে বসতি স্থাপন করেন।

খাজা সাহেব ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারে কিংবদন্তিতুল্য একজন ঐতিহাসিক সুফি ব্যক্তিত্ব। তিনি স্বীয় পির খাজা ওসমান হারুনির নির্দেশে ভারতে আগমন করে মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দেন এবং তারই মাধ্যমে বহু লোক ইসলাম গ্রহণ করেন। তার বিখ্যাত একটি গ্রন্থ হল "আনিসুল আরওয়াহ"।

খাজা সাহেব কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকিকে খিলাফতের দায়িত্ব অর্পণ করে সিলসিলার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখেন। খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি ৬৩৩ হিজরীর ৫ রজব দিবাগত রাত অর্থাৎ ৬ রজব সূর্যোদয়ের সময় ইনতিকাল করেন। তখন তার বয়স হয়েছিল ৯৭ বছর। বড় ছেলে খাজা ফখরুদ্দিন চিশতি তার নামাজে জানাজায় ইমামতি করেন। প্রতিবছর ১লা রজব হতে ৬ রজব পর্যন্ত আজমির শরীফে তার সমাধিস্থলে ওরস অনুষ্ঠিত হয়। নানা ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ হতে সমবেত হয়।

আজমিরে খাজা সাহেবের দরগাহে বিরাজ করে এক আধ্যাত্মিক পরিবেশ। খাজা সাহেবের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সমবেত হয় ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে শত শত নারী ও পুরুষ। কাঁচা ও তাজা ফুলের ঢালি দিয়ে বক্তরা নিবেদন করে শ্রদ্ধা। বিতরণ করা হয় তবারুক। অবিরাম চলে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত, যিকর ও তাসবিহ।

মহান স্রষ্টা ও পরিপালক আল্লাহর গুণকীর্তন, তৌহিদের পুনরুচ্চারণ আর নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালতের পবিত্র ধ্বনি গুঞ্জরিত হয় উপমহাদেশের আধ্যাত্মিক কেন্দ্র আজমির শরিফের খাজা সাহেবের দরগাহ ঘিরে। মানুষ তার তাপিত ও পীড়িত হৃদয় নিয়ে আসে আল্লাহর রহমত, বরকত, মাগফিরাতের আশায়। তৌহিদের রশ্মিতে মুসলমান এবং সমগ্র ভারতবাসীকে ইসলামের প্রেম, সৌহার্দ্য, ভালোবাসা, মানবসেবার শিক্ষা দেয় খাজা সাহেবের আজমির শরিফ।