পুরনো ফৌজি পথেই মিয়ানমার

  • মায়াবতী মৃন্ময়ী, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

পুরনো ফৌজি পথেই মিয়ানমার। ছবি: সংগৃহীত

পুরনো ফৌজি পথেই মিয়ানমার। ছবি: সংগৃহীত

মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থান ১৯৮৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বরের কথা মনে করিয়ে দেয়। সোমবার (১ ফেব্রুয়ারি) প্রত্যুষে একই চিত্র দেখা গেলো। সংক্ষিপ্ত গণতান্ত্রিক সময়কাল পেরিয়ে মিয়ানমার পুরনো ফৌজি পথেই হাঁটছে।

গণতন্ত্রের বাতাবরণে থাকলেও মিয়ানমার নামক দেশটি পরিচালিত হচ্ছিল প্রচ্ছন্ন সামরিক হস্তক্ষেপে। শুধু সামরিক নয়, মিয়ানমানের সেনাবাহিনী দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্তৃত্বের অধিকারী ছিল। কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষেই সেনাবাহিনীকে সন্তুষ্ট না করে ক্ষমতায় আসা ছিল অসম্ভব।

বিজ্ঞাপন

অং সান সুচিও ক্ষমতায় আসেন সেনাবাহিনীকে রাজি-খুশি করেই। রোহিঙ্গা গণহত্যাসহ সেনাদের মানবাধিকার বিরোধী সকল অপকর্মকেও সমর্থন করতে হয়েছিল তাকে। 'গণতন্ত্রের নেত্রী' থেকে 'গণহত্যার দোসর' হয়েও সু চি সেনাবাহিনীর মন রক্ষা করতে পারেন নি। ক্ষমতা হারিয়ে বন্দি হয়েছেন তিনি।

গত বছর (২০২০) নভেম্বরের করোনা মহামারির মধ্যে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অং সান সু চির দল এনএলডি সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও সেনাবাহিনী নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ তোলে। সোমবার (১ ফেব্রুয়ারি) নব-নির্বাচিত সংসদের প্রথম বৈঠক হবার কথা, কিন্তু সেনাবাহিনী অধিবেশন স্থগিত করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়।

রাজধানী ন্যাপিড এবং প্রধান শহর ইয়াঙ্গুনের রাস্তায় সেনাবাহিনী টহল দিচ্ছে। ন্যাপিডসহ আরো দু’একটি শহরে ইন্টারনেট ও টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে। সৈন্যরা দেশের বিভিন্ন প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর বাসায় গিয়ে তাদের আটক করে নিয়ে যায় বলে পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছে।

এনএলডি মুখপাত্র মিও নয়েন্ট রয়টার্স সংবাদ সংস্থাকে জানায়, প্রেসিডেন্ট মিন্ট এবং অন্য নেতাদের ভোরে আটক করা হয়। 'আমি জনগণকে বেপরোয়া কিছু না করার অনুরোধ করছি, আমি চাই তারা আইন মেনে চলবে,' মিও নয়েন্ট রয়টার্সকে বলেন।

অর্থাৎ, সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলকে চ্যালেঞ্জ করার সাহস ও শক্তি রাজনৈতিক নেতারা দেখাতে পারছেন না। এতেই অনুমান করা যায় মিয়ানমারের রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর প্রবল প্রতাপের বিষয়টি।

পক্ষান্তরে, সেনাবাহিনী অতি অল্প সময়ের মধ্যেই পুরো দেশের কর্তৃত্ব করায়ত্ত করেছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের বিবরণে সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে যা জানা গেছে, তা হলো, রক্তপাতহীন এক সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী।

সোমবার (১ ফেব্রুয়ারি) খুব ভোরে অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অং সান সু চি ও দেশটির প্রেসিডেন্টসহ বিপুল সংখ্যক রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে সেনাবাহিনী।

সেনাবাহিনী এক বিবৃতিতে বলেছে, নভেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে ব্যাপক জালিয়াতির প্রেক্ষাপটে এসব নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে তারা। আর এর মধ্য দিয়ে তারা ক্ষমতা হস্তান্তর করেছে সেনাবাহিনী প্রধান অং মিং হ্লাইংয়ের কাছে। একই সাথে দেশে এক বছরের জন্য ঘোষণা করেছে জরুরি অবস্থা।  সেনাবাহিনী মালিকানাধীন টেলিভিশনে এ ঘোষণা দেয়া হয়।

এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হলেও তা যে অতীতের মতো প্রলম্বিত হবে, সে ব্যাপারে বিশ্লেষকরা নিশ্চিত। জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর নিজস্ব স্বার্থগত এজেন্ডা বাস্তবায়নের পরই সেনাশাসক ক্ষমতা ত্যাগ করবেন বলে মনে করা হচ্ছে। হয়ত অচিরেই প্রকাশ পাবে তাদের ক্ষমতা দখলের আসল উদ্দেশ্য।

মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান ও পাইকারি গ্রেফতারের নিন্দায় তাৎক্ষণিকভাবে কয়েকটি পশ্চিমা দেশ মুখ খুললেও আশেপাশের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশীরা দৃশ্যত নিরব। চীন, ভারত, উত্তর কোরিয়া মিয়ানমানের সামরিক অভ্যুত্থানের ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেনি।

সন্দেহ নেই, দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সংযোগকারী ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ দেশ মিয়ানমানে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখল আঞ্চলিক রাজনীতিতে বিরাট প্রভাব বিস্তার করবে। ভারত মহাসাগরে চীন ও ভারতের আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়েও নতুন মেরুকরণের সৃষ্টি করবে। চলমান রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে নতুন প্রতিবন্ধকতা দেখা যাবে। কারণ, মিয়ানমানের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা গণহত্যার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে দোষী এবং প্রচণ্ডভাবে রোহিঙ্গা বিরোধী। ফলে মিয়ানমারের ক্ষমতায় সামরিক বাহিনীর অধিষ্ঠান শুধু সেই দেশের জন্যেই নয়, আঞ্চলিক শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্যেও উদ্বেগের কারণ বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।