কবি আল মাহমুদের তৃতীয় মৃত্যু বার্ষিকীতে লন্ডনে কোরআন খতম

  • সাঈদ চৌধুরী
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সাঈদ চৌধুরী

ছবি: সাঈদ চৌধুরী

পবিত্র কোরআন খতম ও মোনাজাতের মাধ্যমে পালিত হয়েছে কালজয়ী কবিতার স্রষ্টা আল মাহমুদের তৃতীয় মৃত্যু বার্ষিকী। আল মাহমুদ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে পবিত্র কোরআন খতমের পর লন্ডনের গ্রীনলেন কমিউনিটি সেন্টার মসজিদে মোনাজাত করা হয়।

আল-মাহমুদ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান কবি-সংবাদিক সাঈদ চৌধুরী কোরআন তেলায়াত এবং মোনাজাতে অংশ গ্রহন করেন। মোনাজত পরিচালনা করেন শায়েখ ওয়াকার। বিশিষ্ট জনের মধ্যে আরো ছিলেন শায়েখ মো: ইয়াসিন, মাওলানা মো: আব্দুল কুদ্দুস ও মো. রাহমান। সুললিত কন্ঠে কেরাত পড়েন ক্বারী রাইয়ান চৌধুরী। এ সময় আবেগে আপ্লুত মুসল্লিরা চোখের জলে প্রিয় কবির জন্য জান্নাতুল ফেরদৌস কামনা করেন।

বিজ্ঞাপন

অনুষ্ঠানে স্মৃতিচারণ করে সাঈদ চৌধুরী বলেন, আল মাহমুদ ছিলেন একাধারে কবি, সাংবাদিক. ঔপন্যাসিক, ছোটগল্প লেখক, প্রাবন্ধিক ও শিশুসাহিত্যিক। মহান মাবুদের কাছে তিনি প্রত্যাশা করেছিলেন কোন শুভ শুক্রবারে বিদায় নিতে। কবির সে প্রত্যাশা পূর্ণ হয়েছে। ২০১৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার রাত ১১টায় ইন্তেকাল করেন আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এই বরেণ্য ব্যক্তিত্ব। স্মৃতির মেঘলাভোরে’ কবিতায় আল মাহমুদ লিখেন- কোনো এক ভোরবেলা, রাত্রিশেষে শুভ শুক্রবারে/ মৃত্যুর ফেরেস্তা এসে যদি দেয় যাওয়ার তাকিদ;/ অপ্রস্তুত এলোমেলো এ গৃহের আলো অন্ধকারে/ ভালোমন্দ যা ঘটুক মেনে নেবো এ আমার ঈদ।/ … আমার যাওয়ার কালে খোলা থাক জানালা দুয়ার/ যদি হয় ভোরবেলা স্বপ্নাচ্ছন্ন শুভ শুক্রবার।

অনুষ্ঠানে আল মাহমুদকে নিবেদিত সাঈদ চৌধুরীর কবিতা ‘রুপালি আলোয়' আবৃত্তি করা হয়। ‘তুমি এলে আগুনের ফুলকির মতো/ রৌদ্র কিরণে ঝলসিত চারিদিক/ উচ্ছ্বাস আনন্দ ছড়িয়ে মুখরিত/ ছেলেবুড়ো আনন্দে দিক-বিদিক।/ উনুনের ধার ঘেঁষে দাই মা/ আয়াতুল কুরছি পড়ে/ আগুনের আঁচে বসে তা দেয়/ সফেদ কাপড়ের ভাজে, জিন-ভূত/ যেন আসেনা ঘরে।/ ছায়ারৌদ্র মেঘের খেলা/ বনশ্রী প্রফুল্ল হয়ে ওঠে/ দীপ্ত রাঙ্গা উদয়ের বেলা।/ গ্রীষ্মের দাবদাহ মুছে যায়/ সোনার রবি ছড়ায় কিরণ/ মরু মুষিকের উপত্যকা’য়।/ যেভাবে বেড়ে ওঠি প্রাণের স্পন্দনে/ জ্যোতিস্রোতে মিশেছে প্রিয় স্বদেশ/ জীবন্ত মুক্তিসংগ্রামে কাবিলের বোন/ স্বাধীনতার স্বপ্ন জাল বোনে উপমহাদেশ।/ কবির আত্মবিশ্বাস কবির কররেখা/ আগুনের মেয়ে অর্ধেক মানবী/ নিশিন্দা নারী যতই হোক দেখা।/ কবির সৃজন বেদনা কবিতার আঁচল/ দশ দিগন্তে উড়াল ডাহুকী দিনযাপন/ কবিতার জন্য বহুদূর কবি ও কোলাহল।/ তুমি, আরব্যরজনীর রাজহাস/ আমি, দূরগামী/ প্রহরান্তের পাশ ফেরা এক চক্ষু হরিণ/ পাখির কাছে ফুলের কাছে/ কালের কলস- কিরণ ছড়ায়।/ তুমি, সোনালি কাবিন/ মায়াবী পর্দা দুল ওঠো/ বখতিয়ারের ঘোড়া’য়।/ তুমি, অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না/ প্রহরান্তের পাশফেরা, দোয়েল ও দায়িতা/ লোক লোকান্তর- বিদ্যুৎ চমকায়।/ তোমার ভরাট গলার সুকন্ঠ উচ্চারণ/ মেঘমালা হয়ে উড়ছে হাওয়ায়/ শ্যামল শ্যামল নীলিমায়।/ সৌরভসিক্ত আল মাহমুদ/ বাংলাভাষা হয় গতিময়/ তোমার দৃপ্ত রুপালি আলোয়।’

উল্লেখ্য, কবি আল মাহমুদ ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মৌড়াইল গ্রামের মোল্লাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। এ যাবৎ তাঁর শতাধিক গ্রন্থ বেরিয়েছে। মোট ১৩ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে ‘আল মাহমুদ রচনাবলি’।

বিজ্ঞাপন

প্রথম কবিতার বই ‘লোক লোকান্তর’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে এবং ‘কালের কলস’ ও ‘সোনালি কাবিন’ ১৯৬৬ সালে। সোনালি কাবিনে নদীর মতো কবিতার ঢেউয়ে প্রবাহিত রোমাঞ্চকর অনুভূতি প্রকাশ করেছেন সনেট ছন্দের মেলবন্ধনে। চিত্রকল্পে আত্মিকতার দারুণ খোরাক জুগিয়েছেন পাঠক মহলে। এই গ্রন্থ তাঁকে নিয়ে যায় অনন্য উচ্চতায়। এছাড়াও আল মাহমুদের ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’, ‘অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না’, ‘একচক্ষু হরিণ’, ‘মিথ্যাবাদী রাখাল’ ও ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। ‘কাবিলের বোন’, ‘উপমহাদেশ’, ‘ডাহুকি’, ‘আগুনের মেয়ে’, ‘চতুরঙ্গ’ ও ‘পোড়ামাটির জোড়া হাঁস’ ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। ‘পানকৌড়ির রক্ত’সহ বেশ কিছু গল্পগ্রন্থও রচনা করেছেন তিনি।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের লিফলেটে কবিতা ছাপার কারণে ফেরারি হওয়া আল মাহমুদ একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামে মুজিবনগর সরকারের স্টাফ হিসেবে কাজ করেছেন, যুক্ত ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সাথেও। প্রত্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতায় রচনা করেছেন কালজয়ী দু’টি উপন্যাস ‘কাবিলের বোন’ ও ‘উপমহাদেশ’। ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’ ও ‘বিচূর্ণ আয়নায় কবির মুখ’ আল মাহমুদের উল্লেখযোগ্য আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ।

তৎকালীন দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক কবি আল মাহমুদ এক সময় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতেও কাজ করেছেন। সেখানে পরিচালক হিসেবে অবসর নিয়েছেন। সৃজনশীল সাহিত্য রচনার জন্য অসংখ্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৮), জয়বাংলা পুরস্কার (১৯৭২), হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭৪), ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৬), একুশে পদক (১৯৮৭), নাসিরউদ্দীন স্বর্ণপদক (১৯৯০), সমান্তরাল (ভারত) কর্তৃক ভানুসিংহ সম্মাননা পদক-২০০৪ উল্লেখযোগ্য।

অনুষ্ঠানে কবি আল মাহমুদকে ব্যাপকভাবে অধ্যয়ন ও তার মাগফিরাতের জন্য দেশ-বিদেশের সকল পাঠকের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়। মহান আল্লাহ যেন তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন। আমীন।