বিনিয়োগ ও বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে ঢাকা আঙ্কারা সম্পর্কের নতুন মোড়

  • মাহমুদ হাফিজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, আঙ্কারা থেকে
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

আঙ্কারায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আলহাজ্ব মসয়ূদ মান্নান।

আঙ্কারায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আলহাজ্ব মসয়ূদ মান্নান।

বাংলাদেশ তুরস্ক সম্পর্কের সাম্প্রতিক উষ্ণতার সুবাদে দু’দেশের জাতির পিতার নামে ঢাকা ও আঙ্কারায় পার্ক ও ভাস্কর্য স্থাপন হচ্ছে। দুই দেশের বাণিজ্যের পরিমাণ অতীতের স্থবিরতা কাটিয়ে পৌঁছেছে এক দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে।

আঙ্কারায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আলহাজ্ব মসয়ূদ মান্নানের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় এসব কথা জানা গেছে।

বিজ্ঞাপন

ভ্রামণিক হিসাবে তুরস্ক ভ্রমণের অংশ হিসাবে আঙ্কারায় পৌঁছে গত সোমবার রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। শহরের চেঙ্কায়ার ডিপ্লোম্যাটিক জোনে নবনির্মিত দূতাবাস কমপ্লেক্সে মঙ্গলবার রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় দু’দেশের উষ্ণ সম্পর্ক ও এর বাঁকবদলের কথা উঠে আসে। যুদ্ধাপরাধের বিচার ও ফাঁসিকে কেন্দ্র করে ঢাকা-আঙ্কারা সম্পর্কের কিছুটা ভাটা দেখা গিয়েছিল। দেশ দুটির শীর্ষনেতৃত্বের সদিচ্ছায় একে উষ্ণতায় উন্নীত করতে সময় লাগেনি। বাংলাদেশ দূতাবাসের পরিপক্ক দূতিয়ালি, তুরস্কের এশিয়ামুখী কূটনীতি, প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে সমঝোতাস্মারক ও সামরিক কেনাকাটা উষ্ণতায় উৎসাহের যোগান দিয়েছে।

জানা গেছে, বাংলাদেশ-তুরস্ক ভাতৃপ্রতিম দেশ দুটির মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা নীবিড়তার দিকেই অগ্রসর হচ্ছে। 

বিজ্ঞাপন

আলাপকালে রাষ্ট্রদূত সামরিক ও প্রতিরক্ষা সম্পর্কের বিস্তারিত আলাপে যাননি। তিনি বলেন, তুরস্ক সামরিক ড্রোন প্রযুক্তিতে অনেক উন্নতি করেছে অস্বীকার করার উপায় নেই। এক্ষেত্রে সহযোগিতার অনেক সম্ভাবনাও রয়েছে। দু’দেশের উষ্ণ সম্পর্কের ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতি, শিক্ষা ও বিনিয়োগ। আগামীতে চিকিৎসাবিজ্ঞান, পর্যটন ও কৃষি যুক্ত করার চেষ্টা চলছে।

তিনি আরও বলেন, নিকট ভবিষ্যতে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেসিপ তাইয়েপ এরদোয়ানের বাংলাদেশ সফর হতে পারে সম্পর্কের নতুন আরেকটি বাঁক।

তুরস্কে নিযুক্ত বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূত মসয়ূদ মান্নানের মুখোমুখি।

গত বছর বাংলাদেশ ও তুরস্কের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ ৯২০ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত পৌঁছেছিল। এ বছর যা ৩০ মিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে এক বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। আগামী দুয়েকবছরে তা দুই বিলিয়নের কোঠা ছোঁবে বলে আশা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ তুরস্কে পাট, চামড়া, সিরামিক, হিমায়িত চিংড়ি, তামাক, সূতা, জুতা, ভ্রমণ সামগ্রী, ক্ষুদ্র প্রকৌশল যন্ত্রপাতি রফতানি করে। আমদানি করে অর্গানিক ও ননঅর্গানিক রাসায়নিক, বয়লার, ইস্পাত, লোহা, সূতা, ডাই, পেয়াঁজ ও গম।

রাষ্ট্রদূত মসয়ূদ মান্নান বলেন, ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে বিশ্বমারী চলাকালীন দায়িত্ব গ্রহণ করি। মধ্য ডিসেম্বরে তুরস্কের প্রেসিডেন্টের কাছে পরিচয়পত্র পেশ করতে গেলে তিনি দু’দেশের সম্পর্কোন্নয়নে উদ্ভাবনী ক্ষেত্র চিহ্নিত করে কাজ করা এবং তুরস্ক ঘুরে দেখে মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক নীবিড় করার পরামর্শ দেন ।

তিনি আরো বলেন, দায়িত্ব নেয়ার পর পরই ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে বাংলাদেশ কমিউনিটি ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিজয় দিবস উদযাপন করি। এর পরপরই তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর অনুষ্ঠিত হয়। কোভিড মহামারীর মধ্যেই চ্যালেঞ্জ নিয়ে পাঁচতারকা হোটেল জেডি মেরিয়টে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উদযাপন করি, যা তুরস্কের সুধি ও কূটনীতিকমহলে সাড়া ফেলে। ১৩৫টি দেশের দূতাবাসের মধ্যে বাংলাদেশ ২০২০ সালে প্রথম স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস আয়োজন করতে সক্ষম হয়।

রাষ্ট্রদূত মসয়ূদ মান্নান বলেন, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি ৩ তারিখে ব্যবসা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে এফবিসিসিআই ও তুরস্কের ডিইআইকের মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এ বছরের মে মাসে দু’দেশের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মাস্টার্স পর্যায়ে যৌথ ডিগ্রি প্রদানের বিষয়েও একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। জুন মাসে জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে স্মারক ডাকটিকেট প্রকাশ দূতাবাসের আরেকটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য। 

তিনি বলেন, এখানে আমার প্রথম কাজ ছিল আঙ্কারায় নবনির্মিত বাংলাদেশ দূতাবাস কমপ্লেক্সের ভবনের অবকাঠামোকে প্রাণদান করা। নতুন কমপ্লেক্স ভবনে মানানসই সকল ফার্ণিচার ও প্রযুক্তিগত সেটআপ, শিল্পকর্মে দেয়াল সজ্জিতকরণ, বাগান তৈরি করা। এক্ষেত্রে কাজে লাগাই নিজস্ব শিল্পসংস্কৃতির পূর্ব অভিজ্ঞতা। বিদেশী অতিথি ও শিক্ষার্থীদের যথাযথ পরিবেশে আপ্যায়নের মধ্য দিয়ে দেশকে তুলে ধরার বিকল্প নেই বলে তিনি উল্লেখ করেন। এখন আমরা কৃষি, চিকিৎসা বিজ্ঞান ও শিক্ষাবৃত্তি ইত্যাদি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি বলে মসয়ূদ মান্নান উল্লেখ করেন।

আঙ্কারাস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস কর্তৃক প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর স্মারক ডাকটিকেট।

লাল সিরামিক ইটে দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যে নির্মিত বাংলাদেশ দূতাবাস কমপ্লেক্স ডিপ্লোম্যাটিক জোনের একটি উল্লেখযোগ্য স্থাপনা। দূতাবাসের বিভিন্ন বিভাগের নজরকাড়া সজ্জার পাশাপাশি ভবনপ্রাঙ্গণে নির্মিত জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ ম্যুরাল, শহীদ মিনার, ভবনের অভ্যন্তরে দেয়ালজুড়ে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের চিত্রকল্প আলো ছায়া ও শিল্পকর্মের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। দূতাবাসের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থানে পরিণত হয়েছে বঙ্গবন্ধু কর্ণার। এই কর্ণারে বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু ও বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস, সংগ্রাম ও সাহিত্যের ওপর বহু বইয়ের সম্ভার ও পাঠের উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলা হয়েছে। শো কেসে বাংলাদেশের বিলীয়মান নানারকমের বাদ্যযন্ত্র, ঐতিহ্যবাহী জামদানী শাড়ি এসব সাজিয়ে রাখা হয়েছে।

রাষ্ট্রদূত মসয়ূদ মান্নানের পরিচিতি

মসয়ূদ মান্নান ১৯৬১ সালের ২১ এপ্রিল ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। গর্ভমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক, ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিকের পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ এলএলবি ও অর্থনীতিতে এমএসএস পাস করে ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। পরে যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে এম. এ ডিগ্রি এবং ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ থেকে এনডিসি কোর্স সম্পন্ন করেন। জাতিসংঘ সংস্থা ইউএনআইটিএআর ও আইসিআরসির মাধ্যমে তিনি জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেন।

পেশাগত জীবনে লন্ডন, মাস্কাট, নিউইয়র্ক ও বেইজিংয়ে নানাপদে দায়িত্ব পালনের পর তিনি মরক্কো, বার্লিন ও তাসখন্দে রাষ্ট্রদূত হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি তুরস্কে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসাবে কর্মরত। মান্নান প্রয়াত নিউরোলজিস্ট প্রফেসর এম এ মান্নান এমপি ও প্রয়াত প্রফেসর বশিরা মান্নান এর ছেলে। ব্যক্তিগত জীবনে মসয়ূদ মান্নান ও প্রফেসর ড. নুজহাত আমিন মান্নান দম্পতি এক পুত্রসন্তানের জনক। তাদের পুত্র ব্যারিস্টার মোরশেদ মান্নান ইউরোপের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট ডক্টরেট পর্যায়ে গবেষণা করছেন।