কলকাতা, পুরনো বই, করোনাকালে বেঁচে থাকা
বাংলাদেশের মানুষ কলকাতায় এলে সাধারণত মার্কুইস স্ট্রিটের যে পাড়াটায় বেশি থাকেন, সেই মহল্লা ছেড়ে কস্তুরী রেস্তোঁরা পেরিয়ে আবার যদি মির্জা গালিবের নামাঙ্কিত রাস্তায় এসে পড়ি, তাহলে নিউ মার্কেট পর্যন্ত যেতে গেলে অনেকগুলো বইয়ের দোকান। আসলে যেখানে পুরনো বই আর ম্যাগাজিন পাওয়া যায়। প্রাক ইন্টারনেট এর যুগে যে দোকানগুলো মনে হত আফ্রিকার হিরের খনি, একটু খোঁজাখুঁজি করলেই কত যে হিরের সন্ধান পাওয়া যাবে! খালিল জিব্রান থেকে মিলান কুন্দেরা, টমাস হার্ডি থেকে জেমস জয়েস এর বই, কত কিছু যে খুঁজে পেয়েছি ফ্রি স্কুল স্ট্রিট বা আজকের মির্জা গালিব স্ট্রিটের ওই সব বইয়ের দোকান থেকে।
এক্কেবারে স্কুলে পড়ার সময় থেকে আমাদের যাদের গ্লোব কিংবা যমুনায় সিনেমা দেখতে যাওয়ার অভ্যাস কিংবা পাকামি ছিল, তাদের সঙ্গে 'বনিএম' বা 'অ্যাবা'র মতো গ্রুপের পরিচয় করিয়েছিল তালতলা, মির্জা গালিব, রাফি আহমাদ কিদোই স্ট্রিটের দোকানগুলো। তখনই তো প্রথম বাড়িতে রাসপুটিন বাজিয়ে হাত পা ছোঁড়ার মকশো করা, থোড়াই তখন জানা ছিল চার দশকের ব্যবধানে 'বনিএম'র সেই হিট তথ্যপ্রযুক্তির নেটদুনিয়ায় এইরকম আলোড়ন তুলবে বা ঘৃণার বিরুদ্ধে ভালবাসার ক্যাচলাইন হয়ে দাঁড়াবে।
আমি নিজে এই জীবনের হাফ সেঞ্চুরিতে পৌছে বিশ্বাস করি যে কোনো শহরকে বুঝতে গেলে, সেই শহরের আত্মাটাকে চিনতে গেলে তার কোনো বাজার আর পানাহারের এলাকায় যেমন ঢুঁ মারতে হবে, তেমনই পুরনো বইয়ের দোকানে যেতে হবে। আর নেশা থাকলে অবশ্যই পুরনো রেকর্ড বা ক্যাসেট যেখানে বিক্রি হয় সেখানে। তাহলে শহরটার রুচি, সংস্কৃতি এবং মেজাজকে চেনা যাবে। কারণ পুরনো হিসেবে আবার বিক্রির জন্য চলে এসেছে মানে কোনোদিন কেউ ভালবেসে,শখ করে তাকে হৃদয়ে, বাড়ির বুকশেলফে বা বেডসাইড টেবিলে রেখেছিল তো! সেটা শহরটার ভালবাসার ধরনকে চিনিয়ে দেয়। যে লংপ্লেয়িং রেকর্ড কারো ড্রইংরুমে বাজতো, শুনতে শুনতে মাথায় খেলে যেত 'তুমি সন্ধ্যার মেঘমালার' মতো অমোঘ উচ্চারণ, সেই রেকর্ডে আসলেই ভালবাসা লেপ্টে থাকে। সেই রেকর্ড সংগ্রহে রাখাটাই আসলেই কারো হৃদয়ের টুকরোকে সযত্নে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া। যাঁর ভালবাসায় কেউ কোনোদিন মজেছে, তাঁর ভালবাসায় আবার আকন্ঠ ডুবে যাওয়ার অনুরুপ। ডায়ানা হন কিংবা তাঁর বহুবিতর্কিত পুত্রবধু মেগান মার্কেল কে নিয়ে এইজন্যই তো এত আলোড়ন, তার তুলনায় কেট মিডলটন কেমন যেন পানসে, ম্যাড়মেড়ে!
নিউইয়র্ক হোক কিংবা ইস্তাম্বুল বা ঢাকা, পুরনো বইয়ের দোকান খুঁজে যাওয়াটা তাই আমার জন্য অবশ্য কর্তব্য। সেই কৈশোরে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় যে স্যারদের কাছে গল্প শুনেছিলাম এক প্রবাদপ্রতিম শিক্ষক নাকি কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাথেই পেয়েছিলেন জন স্টুয়ার্ট মিলের 'অন লিবার্টি' নামক সেই আইকনিক বইয়ের প্রথম সংস্করণের কপি, সেই থেকেই তো অভ্যাস হারানো মানিক খুঁজে ফেরার! আমার সহধর্মিনী এবং সহপাঠিনী তো কলেজ স্ট্রিটের পুরনো বইয়ের দোকান থেকেই পেয়েছিলেন বিপিন চন্দ্র পালের সেই বিখ্যাত আত্মজীবনী, যা আজও খানদানি রইস 'আমাজন'র কাছে কিনতে চাইলেই বলে 'আউট অফ স্টক'।
উত্তরে যদি হয় কলেজ স্ট্রিট, তাহলে মধ্য কলকাতায় মির্জা গালিব স্ট্রিট আবার দক্ষিণে গড়িয়াহাট থেকে গোলপার্ক। কলকাতায় পুরনো বই খুঁজে পাওয়ার সেরা তিন ঠিকানা। আমার ব্যক্তিগতই যে কতো দুর্দান্ত স্মৃতি আছে এই হিরের খনি থেকে ঝুলিঝালি মাখা হিরে উদ্ধার করে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার। গত শতকের আশির দশকের শেষে যখন পিটার ব্রুকের মহাভারত মঞ্চায়ন নিয়ে চারপাশ তোলপাড়, তখনই গড়িয়াহাটে ঠিক মেঘমল্লার এর উল্টোদিকের ফুটপাথে পেয়ে গিয়েছিলাম ৯ ঘন্টার সেই নাটকের লাইটিং নিয়ে একটি অসাধারণ বই। এবং সেই কৈশোরে মহার্ঘ ১০ টাকার নোটের বিনিময়ে এইরকম কোহিনূর পেয়ে গেলে নিজের কাছেই নিজের গুরুত্ব বেড়ে যেত অভিজাত মুঘলের মতো। অদৃশ্য হেডফোনে মাথার ভিতরে বাজতে থাকতো, 'গজব কা হ্যায় দিন, দেখো জারা'।
এই করোনা, এই অতিমারির পৃথিবী কলকাতা শহরে সেই পুরনো বইয়ের ঘ্রাণ আর নিতে দিচ্ছে না। নিত্যদিনের অভ্যাসে জানি কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাথে পুরনো বই বিক্রি হচ্ছে না, গড়িয়াহাটও আর স্বমহিমায় নেই। কলকাতায় লকডাউন উঠে গেছে, শহরটা আবার নিজের ছন্দে সত্যিই ফিরে গেছে, এটা নিশ্চিত হব যখন দেখব ফুটপাথে আবার পুরনো বই বিক্রি হচ্ছে, মির্জা গালিব স্ট্রিটে ডাঁই করে রাখা টাইম এর সংখ্যাগুলো থেকে মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিয়ে তিন দশকের পুরনো ইস্যুটা খুঁজে পাচ্ছি। পুরনো বইয়ের গন্ধে ফিরে পাচ্ছি ঔপনিবেশিক তিলোত্তমা কলকাতাকে। তখন গঙ্গার জল ছুঁয়ে ভেসে আসা ভেজা বাতাস তাপিত হৃদয়ে মিশিয়ে অনিন্দ্য আনন্দে বলবো, 'ভালো আছি'।
সুমন ভট্টাচার্য, কলকাতার বিশিষ্ট সাংবাদিক। কবি, কথাশিল্পী ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।