অভিযোজনের প্রবল শক্তিতে দীপ্ত বাংলা

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

বাংলা কেবল বাংলাভাষী মানুষের মাতৃভাষা নয়, বিশ্বের বহু দেশে ব্যবহারিক জীবনে কাজের ভাষায় পরিণত হয়েছে। ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে দৈনন্দিন কাজ-কর্মে বাংলা ভাষার প্রয়োজনীয়তা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অভিযোজনের প্রবল শক্তিতে দীপ্ত বাংলা বিভিন্ন ভাষার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে ও মিলেমিশে টিকে থেকে সামনে এগিয়ে চলার প্রমাণ দিচ্ছে। 
 
আশাবাদী একটি খবরের বিবরণে জানা যাচ্ছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কাজের ভাষা হিসাবে বাংলা শেখার দরকার পড়ছে সেদেশে নাগরিকদের। ক্রমবর্ধমান বাংলাভাষী মানুষের কারণেই এমনটি প্রয়োজন হয়ে পড়ছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো দেশের নির্দিষ্ট অঞ্চল, এমনকি, ইংল্যান্ড বা কানাডার কিছু এলাকার প্রধান ভাষা বাংলা। আফ্রিকার একটি দেশে বাংলা সম্মানের ভাষা। ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের রাজ্যগুলোর হাসপাতাল পাড়ায় বাংলাদেশিদের প্রচণ্ড ভিড়ে বাংলা জানা কর্মচারীদের শুধু কাজের ক্ষেত্রই বাড়েনি, কণ্নড়, তামিল, তেলেগু ভাষার মানুষও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রয়োজনে অল্প-বিস্তর বাংলা শিখছেন।
 
দেখা যাচ্ছে, বাংলাভাষী মানুষ বিশ্বায়নের এ যুগে যেখানেই সমাজবদ্ধ হয়েছেন, সেখানেই মুখরিত হয়েছে রক্ত আর আবেগ মথিত বাংলায়। এভাবেই অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেছে বাংলা ভাষা। বাংলাদেশে ও বাংলাভাষী অঞ্চলের বাইরেও প্রয়োজনের ভাষা হিসাবে ছড়িয়ে পড়ছে আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। 
  
লক্ষ করে এটাও দেখা গেছে যে, প্রবাসের মাটিতে বাংলা ভাষার চর্চা কেবল বাঙালি নরগোষ্ঠীর মানুষ নন, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সাহচর্যে ও বাণিজ্যিক প্রয়োজনে পশ্চিমা বিশ্বের অথবা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য ভাষাভাষীর অবাঙালিরাও অতীতকাল থেকে করে চলেছেন। কলকাতা বা ঢাকার মাড়োয়ারির মুখে বাংলা শুনে কে বলবে যে, লোকটির মাতৃভাষা বাংলা নয়। বাংলাদেশে বা বাংলাভাষী অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে গিয়ে ঠিকই তারা সূচারু রূপে বাংলাকে রপ্ত করেছেন।
 
ব্যবহারিক প্রয়োজন বা বাণিজ্যিক কারণে বাংলা শেখার প্রবণতা বিদেশিদের মধ্যে ক্রমেই বাড়ছে, এ খুবই আশার কথা। বেঙ্গালুরের হাসপাতালে দক্ষিণ বা উত্তর ভারতের কর্মীরা দিব্যি বাংলা বলছেন এজন্য যে, তাদের রোগিদের সিংহভাগই বাংলাদেশি। শহরের হোটেল, দোকান, বাজারেও টুকটাক বাংলা জানা লোকের দেখা পাওয়া গেছে। আরব দেশে এতো বেশি বাংলাদেশি থাকেন যে, সেখানে ভাষাটি বেশ ছড়িয়ে গেছে। কাজের মতো বাংলা অনেককেই বলতে শুনেছি। ভারতীয় বা পাকিস্তানি ড্রাইভার বা দোকানিরা তো বেশ বাংলা বলতে পারেন।
 
তবে দুঃখে বিষয় হলো, বরং প্রমিত মাতৃভাষা শিক্ষার প্রতি প্রবাসী ইমিগ্রান্ট বাংলাভাষীদের আগ্রহ তুলনামূলক কম। তারা নিজেদের আঞ্চলিক কথ্যভাষাটিকেই চর্চা করতে পছন্দ করেন, যা তাদের নিজস্ব জেলার বাইরের মানুষের কাছে অনেক সময় বোধগম্যও হয় না। বিলেতে ও মধ্যপ্রাচ্যে এমন অনেকেই আছেন, যারা সমগ্র বাংলাভাষীদের সঙ্গে যোগাযোগের সমস্যায় আক্রান্ত। 
 
একইভাবে অনেকেই পুরনো ধ্যান-ধারণায় নিজেদের উত্তরাধিকারদের বাংলা ভাষা শিক্ষাদানের উৎসাহ ও আন্তরিকতা দেখাতে পারেন না। তারা বরং চেষ্টা করেন, আঞ্চলিক ভাষাটিকেই চর্চার অংশ হিসেবে ধরে রাখতে। একই ভাষার অঞ্চলে অঞ্চলে প্রভেদ থাকবেই এবং সেটাকে ঘুচিয়ে ফেলাও সম্ভব নয়। এই বৈচিত্র্য বজায় রেখেই প্রমিত বা মান্য ভাষাটিতে আয়ত্ত করারও যে দরকার আছে, এই বোধোদয় সৃষ্টি হওয়া খুবই জরুরি। 
 
এতো কিছুর পরেও আশার কথা হলো প্রবাসে বাংলা চর্চার গণ্ডি বাড়ছে। প্রবাসীদের মধ্যে মাতৃভাষা বাংলা চর্চার বিদগ্ধ চেতনা তখন থেকেই সক্রিয় হতে শুরু করে যখন বিশ্বায়ন যুগের সভ্যতায় বিপুল ও বিশাল সংখ্যক বাংলাভাষী মানবগোষ্ঠী পৃথিবীর নানা প্রান্তে জড়ো হন এবং আধুনিক প্রযুক্তি সেই সভ্যতার সঙ্গে নিজের সংযুক্তিসাধন সম্পন্ন করে।
 
এমনই বাস্তব প্রেক্ষিতে প্রবাসে নানা অঞ্চলের বাংলাভাষীর মধ্যে যোগসূত্র রচনার জন্য প্রমিক বাংলার গুরুত্ব বাড়তে থাকে।  কারণ, মাতৃভাষা চর্চার প্রয়োজনে দরকার হয় এমন একটি সুষ্ঠু পারিপার্শ্বিকতা, যার প্রভাবে ভাষা চর্চার আবহ তৈরি হয়। একুশ শতকের প্রযুক্তি-সভ্যতা এবং অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিশ্বায়ন সৃষ্টি করে দিয়েছে এমনই আবহ ও প্রয়োজনীয়তা। 
 
পণ্ডিতরা জানিয়েছেন যে, পৃথিবী জুড়ে বিস্তীর্ণ বিশ্বায়ন ও হাইটেক সভ্যতা প্রসারিত হওয়ার সহস্র বছর পূর্বেও প্রবাসে মাতৃভাষা চর্চা ছিল। নানা পরিস্থিতির কারণেই তা চলছিল। যদিও প্রতিটি মাতৃভাষার জন্ম সুনির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমানা ও সাংস্কৃতিক অঙনে, তথাপি সে ভাষার একটি গতিশীলতা আছে। মাতৃভূমির বাইরে যেখানেই কোনও ভাষা গোষ্ঠীর মানুষ একত্রিত হন, সেখানেই ভাষাটি একটি ভাষিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল রচনা করতে সক্ষম হয়।
 
অতএব দেশে বা প্রবাসে, যেখানেই মানবশিশু জন্মগ্রহণ করুক না কেন, মাতৃভাষার মাধ্যমেই তার সেতুসংযোগ রচিত হয় নিজস্ব মানুষ, যথা পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন, সমাজসংস্কৃতি, ব্যবহারিক জীবনের বিবিধ রীতিনীতি ও ধর্মাচারের সঙ্গে।  মানসিক গঠনেও সেই ভাষিক ঐতিহ্য আজীবন বজায় থাকে তার মধ্যে। এ কারণেই মানুষ প্রবাস জীবনের কঠিন পরিস্থিতিতেও মাতৃভাষা পরিত্যাগ করতে চায় না। চাপের পরেও ব্যক্তিগত জীবনে হলেও ভাষাটিকে ধরে রাখে। 
 
অতীতে রাজভাষা গ্রহণ করার একটি বাধ্যবাদকতা ছিল বিজিত জাতির মানুষের জন্য। এভাবেই বাংলাদেশ অঞ্চল সংস্কৃত, ফারসি, ইংরেজিকে পেয়েছে। রাজশক্তির জোরে ভাষিক আধিপত্যের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রয়োজনে বাণিজ্য উপলক্ষে দেশান্তরে গিয়ে বণিক সওদাগররাও করেছেন সেটা। আবার ধর্ম প্রচারকরাও করেছেন ধর্ম প্রচারের প্রয়োজন সূত্রে। এভাবেই এক ভাষার শব্দ আরেক ভাষায় ঠাঁই পেয়েছে। ভাষা ছড়িয়ে গেছে ভাষাভাষী মানুষের মাধ্যমে এবং আদি ভাষাটি মুছে যায় নি। 
 
ইতিহাস বলছে, অপ্রতিরোধ্য বাংলা ভাষা অতীতে নানা ভাষার আগ্রসনে মুছে যায়নি। বিশ্বায়নের তাণ্ডবেও বিপথগামী হবে না। বরং অতীতে যেমন সংস্কৃত, আরবি, ফার্সি, ইংরেজি, তুর্কি শব্দ গ্রহণ করেছে নিজের কাঠামোতে, বর্তমানেও বহু শব্দ গ্রহণ করবে। কিন্তু নিজের মৌলিক সত্ত্বা ও স্বাতন্ত্র্য মোটেও নষ্ট করবে না। বরং যেখানেই বাঙালি যাবে, সেখানেই ছড়িয়ে দেবে বাংলা ভাষার অম্লান বর্ণমালা। এখানেই নিহিত রয়েছে বাংলা ভাষার অপ্রতিরোধ্য শক্তিমত্তা ও আত্মনির্ভরশীলতা, যা এ ভাষাকে বেঁচে থাকতে ও ক্রমবর্ধিষ্ণু হতে নিত্য প্রাণিত করছে।