উপমহাদেশের প্রথম পত্রিকার জন্মদিন

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

জেমস অগাস্টাস হিকি সম্পাদিত উপমহাদেশের প্রথম পত্রিকা ‘হিকিস বেঙ্গল গেজেট’/ ছবি: সংগৃহীত

জেমস অগাস্টাস হিকি সম্পাদিত উপমহাদেশের প্রথম পত্রিকা ‘হিকিস বেঙ্গল গেজেট’/ ছবি: সংগৃহীত

২৯ জানুয়ারি, ১৭৮০। সময়ের হিসাবে আজ থেকে ২৪০ বছর আগে এসেছিল দিনটি। একটি ঐতিহাসিক ঘটনার জন্ম হয়েছিল এদিনে। দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশে প্রকাশ পেয়েছিল প্রথম সংবাদপত্র।

পত্রিকাটি কোনো ভারতীয় বা স্থানীয় ভাষায় প্রকাশ পায়নি। পেয়েছিল দখলদার ঔপনিবেশিক শক্তি ইংরেজদের ভাষায়। প্রকাশস্থল ব্রিটিশবাংলা তথা তৎকালীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শাসিত ভারতের রাজধানী কলকাতা।

বিজ্ঞাপন

ঐতিহাসিক পরিতাপের বিষয় এটাই যে, ‘হিকিস বেঙ্গল গেজেট’ নামে মুদ্রিত সেই পত্রিকায় বাংলা বা ভারতীয় কোনো বর্ণমালা স্থান পায়নি! সাধারণভাবে পত্রিকাটি ‘ক্যালকাটা জেনারেল অ্যাডভাইজার’ নামেও পরিচিত ছিল।

দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশে প্রথম প্রকাশিত পত্রিকাটি ছিল সাপ্তাহিক। প্রতি সপ্তাহের ব্যবসা-বাণিজ্যের খোঁজ-খবর প্রচারের উদ্দেশ্যে সীমিত আকারে তা ছাপা হতো। বিভিন্ন জাহাজের খবর, মালপত্রের বিবরণ, নিলামের আগাম সংবাদ থাকতো তাতে। কোম্পানি, ইংরেজ ও অন্যান্য ইউরোপীয় ব্যবসায়ী ও স্থানীয় বেনিয়াদের সুবিধার জন্য জেমস অগাস্টাস হিকি সাহেব উদ্যোগী হয়ে পত্রিকাটি বের করেন।

মজার ব্যাপার হলো, পত্রিকাটিতে কবিতার জন্য কিছুটা জায়গা রাখা হতো। ধারণা করা হয়, স্বদেশ থেকে দূরে ভারত ও বাংলায় অবস্থানরত ইংরেজি ভাষীদের সাহিত্য তৃষ্ণা মেটানোর জন্যই এমনটি করা হয়েছিল। পাঠকদের মধ্যে কাব্যানুশীলন বজায় রাখতে পত্রিকাটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

হিকি সাহেব খুব বেশি দিন পত্রিকা প্রকাশ করতে পারেননি। প্রাচীন ও ঔপনিবেশিক সেই যুগে পাঠক ও পৃষ্ঠপোষক পাওয়া নিশ্চয় খুব সহজ বিষয় ছিল না। কোম্পানির মুনাফালোভী প্রশাসনও এমন একটি কাজের জন্য সহায়ক ছিল না।

ফলে স্বাভাবিক কারণেই পত্রিকাটি স্বল্পায়ু হয়েছিল। ১৭৮২ সালের ২৩ মার্চ পত্রিকাটি চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু ততোদিনে ইতিহাসের পাতায় প্রথম প্রকাশিত পত্রিকা হিসাবে নিজের নামটি লিপিবদ্ধ করে হিকি সাহেবের পত্রিকা।

মি. হিকি কিন্তু ইংরেজ ছিলেন না, ছিলেন আইরিশ। অদ্ভুত চরিত্রের মানুষ ছিলেন তিনি। তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসকে সমালোচনা করতেন তিনি। গভর্নরের স্ত্রীকে ব্যঙ্গ করে নিজের পত্রিকায় নিবন্ধও প্রকাশ করেছিলেন তিনি। ফলে জেল-জরিমানা হয় তার। এমন কি, মুদ্রণযন্ত্র বাজেয়াপ্তও হয়। তার পত্রিকার অকাল মৃত্যুর পেছনে রাজ-রোষানলও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল।

অকালে বন্ধ হয়ে গেলেও হিকি সাহেবের পত্রিকা দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশের প্রথম প্রকাশিত পত্রিকার ঐতিহাসিক মর্যাদা পেয়েছে। উপমহাদেশের দেশে দেশে ও নানা অঞ্চলে পত্রিকা প্রকাশের অনুপ্রেরণার আদি উৎসরূপে কাজ করেছে হিকিস গেজেট।

উপমহাদেশের মুদ্রণ ও প্রকাশনার ইতিহাসে দেখা যায়, হিকির পত্রিকার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কয়েক বছরের মধ্যেই তৎকালের প্রধান শহর কলকাতা, মাদ্রাজ, বোম্বাই থেকে একাধিক ভাষায় একাধিক পত্রিকা প্রকাশ পায়। ধীরে ধীরে পত্রিকা প্রকাশের ধারা অন্যান্য বড় শহর ও মফস্বলেও ছড়িয়ে পড়ে।

২৪০ বছর আগে প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশের খবর এতো বছর পর কোনো আলোড়ন জাগাবে কিনা, সন্দেহ। বিশেষত মুদ্রিত পত্রিকার ক্ষয়িষ্ণু ধারার যুগে তথ্যটি ঐতিহাসিক মূল্য ছাড়া আর কিছুই দিতে পারবে না।

তবে এক্ষেত্রে একটি সত্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তাহলো, উপমহাদেশের পত্রপত্রিকা ও মিডিয়ায় সর্বদা রাজনীতি ও রাজনৈতিক বিষয় প্রাধান্য পেলেও আদিতে এই ভূখণ্ডে পত্রিকা কিন্তু রাজনৈতিক কারণে প্রকাশ পায়নি। পেয়েছিল অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কারণে।

সংবাদপত্র ও সংবাদমাধ্যমের জন্য বহুল চর্চিত রাজনীতির বাইরেও যে আর্থ-বাণিজ্যিক সুযোগ ও সম্ভাবনা নিহিত রয়েছে, এ কথাটিই মনে করিয়ে দিচ্ছে প্রথম সংবাদপত্র ‘হিকিস গেজেট’।