দিঘি, তবুও নাম নীলসাগর

  • মাহমুদ আল হাসান রাফিন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

নীলদিঘি / ছবিঃ বার্তা২৪

নীলদিঘি / ছবিঃ বার্তা২৪

দিঘির নাম নীলসাগর! কিন্ত এ দিঘির পানির রঙ নীল নয়, আকাশের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে কখনও নীল, কখনো ধূসর, কখনো বা কালো। সাগর তো নয়ই, সাগরের উত্তাল ঢেউ নেই তবুও নাম নীলসাগর। এতে সিদ্ধ-সচ্ছ জলে পূর্ণিমার রূপালি চাঁদ এসে যখন ধরা দেয়, তখন সেই চাঁদ ছুঁতে ব্যাকুল হয়ে উঠতে পারে যেকোন প্রেমিকের হৃদয়। 
 
চমৎকার এই দিঘিটির অবস্থান উত্তরবঙ্গের  সমৃদ্ধ জেলা নীলফামারীতে। শহরের চৌরঙ্গী মোড় থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে গোড়গ্রাম ইউনিয়নের ডোবাডাঙ্গা এলাকায়।
 
নীলসাগরের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ এর উদার উদাস পরিবেশ। এর পাড়ে রয়েছে নারকেল, বনবাবুল, আকাশমণি, মেহগনিসহ অজানা-অচেনা হরেকরকম ফুল ও ফলের সারি সারি বৃক্ষরাজি। 
 
শীতমৌসুমে পাখিদের উচ্ছল আগমনে নীলসাগর হয়ে ওঠে সৌখিন পর্যটকদের একটি বিনোদন কেন্দ্র। এসময় বিভিন্ন প্রজাতির হাঁস, মার্গেঞ্জার, মাছরাঙা, ভুবনচিল, সবুজ চান্দি ফুটকি, বাচাল নীল ফুটকিসহ অনেক অতিথি পাখিদের সমাগম বৃদ্ধি পায়। এছাড়া দিঘিটির পাশেই রয়েছে ছোট্ট একটি পার্ক। 
 
১৯৯৮ সালে নীলসাগর দিঘি ও এর আশপাশ এলাকাকে পাখির অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়। ১৯৯৯ সালে তৎকালীন ভূমি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী আলহাজ্ব রাশেদ মোশারফ এ অভয়ারণ্যের উদ্বোধন করেন।
 
আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীর কোনো এক সময়ে এ জলাশয়টির খননকাজ শুরু হয়েছিল। নীল সাগর ‘বিরাট দিঘি’ও ‘বিন্না দিঘি' নামেও পরিচিত। 
 
হিন্দুশাস্ত্রমতে, খ্রিস্টপূর্ব নবম হতে অষ্টম শতাব্দীতে পান্ডবরা কৌরবদের চক্রান্তের শিকার হয়ে ১২ বছরের বনবাস ও এক বছরের অজ্ঞাতবাসে যেতে বাধ্য হন এবং মৎস্য দেশের রাজা বিরাটের রাজধানীর এ স্থানটিতে ছদ্মবেশে বসবাস শুরু করেন। মনে করা হয়, সেসময় নির্বাসিত পান্ডবদের তৃষ্ণা মেটাতে বৈদিক রাজা বিরাট এ দিঘিটি খনন করেছিলেন। বিরাট দিঘির অপভ্রংশ হিসেবে কালক্রমে এ দিঘিটি বিরাট দিঘি, বিল্টা দিঘি এবং অবশেষে বিন্না দিঘি হিসেবে পরিচিতি পায়। 
 
কারো কারো মতে রাজা বিরাট তার বিশাল গরুর পালের জন্য পানির সংস্থান করতেই এ দিঘি খনন করেন এবং তার কন্যা বিন্নাবতীর নামে এর নামকরণ করেন। পরবর্তীতে ১৯৭৯ সালে নীলফামারীর তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক ও অবসরপ্রাপ্ত সচিব এম.এ জব্বার কর্তৃক এই দিঘিকে পর্যটনক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত করতে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। তাই নীলফামারীর নামানুসারে বিন্না দিঘির পরিবর্তে এর নামকরণ করা হয় নীলসাগর।
 
নীলসাগরের পাশে অতিরিক্ত আকর্ষণ হিসেবে দিঘির পূর্ব পাড়ে রয়েছে একটি মন্দির। পশ্চিম পাশে এক দরবেশের আস্তানা। প্রতিদিন এখানে দেহতত্ত্ব গানের আসর জমে ওঠে। এখানে প্রতি বছর চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে সনাতন (হিন্দু) সম্প্রদায় বারুণী স্নান উৎসবের আয়োজন করে থাকে। 
 
দিঘিটি দেখাভাল করে জেলা প্রশাসন। দিঘির পাশেই সরকারের অনুদানে একটি রেস্টহাউজ স্থাপন করা হয়েছিল। বর্তামান জেলা প্রশাসক বেগম নাজিয়া শিরিন দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে পর্যটনখাতে বিশেষ গুরত্ব দিয়ে নীলসাগরের রেস্ট হাউজটির দ্বিতীয় তলা নির্মাণ ও আধুনিকায়ন, শিশু পার্ক নির্মাণ করেন।
 
জেলা শহর থেকে আটোরিকশা বা বাসযোগে যাওয়া যায় ঐতিহ্যবাহী এ দিঘিতে। এর প্রবেশ মূল্য পাঁচ টাকা। এছাড়া অর্থের বিনিময়ে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থাও রয়েছে এখানে।