ওগো বিদেশিনী!

  • কণা ইসলাম, অতিথি লেখক, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

এ্যালিস রায়, ছবি: সংগৃহীত

এ্যালিস রায়, ছবি: সংগৃহীত

স্টুটগার্ট (জার্মানি) থেকে: বিদেশি অথবা বিদেশিনীদের সম্পর্কে বাঙালি তথা পুরো ভারতবর্ষের মানুষের একটা ভুল ধারণা আছে। সাধারণ ধারণা হলো, ইউরোপ-আমেরিকানরা সংসারি কম, সংসার পরিবর্তন করেন বেশি, পুরো জীবন একজন স্ত্রী অথবা একজন স্বামীর সঙ্গে কাটানো এরকম সংসারি জীবন ইউরোপ-আমেরিকানদের মধ্যে কম দেখা যায় ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এসব ভ্রান্ত ধারণা।

ইউরোপ-আমেরিকান সংখ্যাগরিষ্ঠ নারী-পুরুষ সংসার ভালোবেসে একজন স্বামী অথবা একজন স্ত্রীর সঙ্গে সারাজীবন কাটান। অনেক ইউরোপ, আমেরিকান নারী-পুরুষ আছেন, যারা ভারতীয় উপমহাদেশের নারী, পুরুষের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পুরো জীবন আনন্দে কাটাচ্ছেন।
তুলনামূলকভাবে মিশ্র সংস্কৃতির বিবাহিত যুগলগণ এতটাই নমনীয়, ধৈর্যশীল, সংসারি, ত্যাগী, উপকারী মনোভাবের যে তারা বাঙালিদের কাছেও দৃষ্টান্তস্বরূপ।

বিজ্ঞাপন

তেমন একজন গুণি রমনী এ্যালিস রায় ( Alice Ray)। তিনি যেমন একজন খাঁটি মানুষ। আমরা তাকে একেবারে খাঁটি বাংলায় সম্বোধন করে এ্যালিস বৌদি ডাকি। তখন খুব খুশি হন তিনি। তাকে মনে হয় শত জনমের স্বজন।

এ্যালিস রায় প্রসংগে বলার আগে তার কর্তা রবি রায়কে নিয়ে কিছু কথা বলে নেওয়া দরকার। এ্যালিস রায়, রবি রায় বাবুর জার্মান স্ত্রী, যদিও। রবি রায় বাবুর জন্ম কলকাতায়। তিনি জার্মানিতে এসে বসবাস শুরু করেন ১৯৬১ সালে। সুদীর্ঘ এত বছর জার্মানিতে বসবাসের পরেও জীবন-যাপনে রবিদা সেই বাঙালিটিই রয়ে গেছেন।

প্রকৃত শিল্পীরা যেমন হয়ে থাকেন, রবি বাবু ঠিক তেমনি। শিল্পীরা পৃথিবীর যেখানেই বসবাস করেন না কেন, তারা নিজস্ব সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরেই বেঁচে থাকেন। এ্যালিসের সঙ্গে রবি বাবুর পরিচয় ১৯৬৪ সালে এবং দু’জনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ১৯৬৭ সালে।

এ্যালিস জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৭ সালে জার্মানির বার্লিনে। বিয়ের পর ১৯৬৮ সালে রবি রায় বাবুর হাত ধরে চলে আসেন স্টুটগার্টের লিওনবার্গ এলাকায়। সেই থেকে আজ পর্যন্ত রবি রায়ের সুখ-দুঃখের সঙ্গী হয়ে আছেন তিনি।

সুখী দম্পতির একটি মাত্র কন্যা, নাম ইন্দিরা রায়। তাদের কন্যা পেশায় একজন কেমিস্ট্র। বসবাস করেন জার্মানির মিউনিখ শহরে। আমার সংগীত জীবনের সূত্র ধরে রবি দা ও এ্যালিসের সঙ্গে পরিচয় অনেক বছরের। এত বছরের পরিচয়ে আমার কখনও মনে হয়নি রবিদা কলকাতার আর আমি বাংলাদেশের। মনে হয় আমরা একই জাতি বাঙালি। স্বভাবে তিনি যেমন উদার তেমনই আন্তরিক। এ্যলিসও ঠিক তাই।

লিওনবার্গে তিন তলার খুব সৌখিন একটি বাড়ি তাদের। এ্যালিস বৌদির সখ বাড়ি গোছানো। তার বাড়িতে ঢুকলেই বুঝতে পারি বাড়ির সর্বত্র এ্যালিসের সৌখিন হাতের ছোঁয়া। রবি রায় বাবু প্রফেশনাল বাঁশি শিল্পী। বংশী বাদনকে তিনি জনপ্রিয় করেছেন জার্মানিতে। জবের পাশাপাশি ছোট, বড় বহু অনুষ্ঠানে বাঁশি বাজান তিনি। সিডিও বের করেছেন কয়েকটি।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Nov/18/1542527416022.jpg

আমার সঙ্গে পরিচয়ের পর থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রবিদার বাঁশির সঙ্গে তানপুরাতে আমি তাকে সাহায্য করে থাকি। জার্মানিতে বাঙালি কমিউনিটিতে এত ভালো বংশীবাদক আর কেউ নেই। আমাদের যে কোনো সংগীত অনুষ্ঠানে এই বয়সেও তার উদার সাড়া পাই সবসময়। বয়সের ছাপ দু’জনের মধ্যে একেবারেই নেই।

আমার এবং রবিদার যে কোনো অনুষ্ঠানে এই বিদেশিনী রমণী এ্যালিসের উৎসাহ সীমাহীন। প্রতিটি মানুষের জীবনেই তার জীবনসঙ্গীর একে অপরের প্রতি সহযোগিতার মনোভাব না থাকলে চলার পথে অনেক সমস্যা ও বাঁধার সৃষ্টি হয়। আর লেখক, কবি, বিভিন্ন ক্ষেত্রের শিল্পীদের বেলায় এই সহযোগিতা অত্যন্ত জরুরি। জীবন সঙ্গীর সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব না থাকলে তাদের সামনে চলার পথটি বাঁধাগ্রস্থ হয়। শিল্পী সত্বা বিকশিত হয় না।

রবি দা আর এ্যালিস বৌদির সাথে যখন সময় কাটিয়েছি প্রায়ই রবিদার মুখে বলতে শুনেছি, তার জীবনে এ্যালিসের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা। তার জীবনের সর্বক্ষেত্রে এই বিদেশিনী রমনীর অনেক অবদান। রবিদা বলেন, ওর উৎসাহ আর সহযোগিতা না থাকলে বাঁশির সঙ্গে তার এই সম্পর্কটা এতদিনে শেষ হয়ে যেত। ছোট বড় নানান ধরনের তানপুরা, কত যে বাঁশি, হারমোনিয়াম, ডুগি-তবলা, আরও নানান ধরনের বাদ্যযন্ত্র রয়েছে তার এই জার্মানির বাড়িতে। এগুলো সংগ্রহে কোনো বাঁধা তো নয়ই বরং বৌদির উৎসাহ তার সঙ্গে সমান।

প্রতিটি অনুষ্ঠানে রবিদার সঙ্গে শাড়িতে বাঙালি সাজে তাকে উপস্থিত হতে দেখি। বহুদূরের যে কোনো অনুষ্ঠানে সাংসারিক কাজের ব্যস্ততায় এ্যালিস নিজে যেতে না পারলেও রবিদাকে তৈরি করে পাঠিয়ে দেন। রবি দার বাঁশি বাজানো, অনুশীলন বাঁধাগ্রস্থ হোক তেমন কোনো আচরণ এ্যালিস কখনোই করে না। রবিদার মুখে এরকম কথা অনেক শুনেছি। অথচ বাঙালি দম্পতিদের মধ্যে অনেক বধু কিংবা স্বামীর নিরুৎসাহে অনেক প্রতিভা মুখ থুবড়ে পড়ে যেতে দেখেছি।

স্বভাবে এ্যালিস খাঁটি বাঙালি বধুর মতো নমনীয় আর ধৈর্যশীলা। রবিদাকে বলতে শুনেছি, এ্যালিস এতটাই সংসারি যে জীবনে সংসার ছাড়া বাইরে তেমন কোনো বিশেষ জবও তিনি করেননি। বিদেশিনীদের ক্ষেত্রে এ যেন ভাবাই যায় না। শাড়ির মতো আমাদের দেশি খাবার যেমন ডাল, শব্জি, ছোটমাছ ভাঁজা তার দারুণ পছন্দের। সব্জির মধ্যে পটল ও লাউ তার অনেক পছন্দ। বাড়িতে তার বড় গার্ডেনে সামারে দেশি-বিদেশি শাক-শব্জি, ফলমূল ও ফুলের চাষ করেন রবি রায় দম্পতি। বাগানেও রবিদাকে এ্যালিস অনেক সাহায্য করে থাকে।

এ্যালিস এতটাই স্নেহময়ী যে যখনই দেখা হয় অথবা বাড়িতে গিয়ে বৌদি বলে ডাক দিতেই ছুটে আসেন। দু’হাতে জড়িয়ে বুকে টেনে নেন। এ যেন কোনো বাঙালি মায়ের মমতা মাখা আলিঙ্গন। রবি দাকেও এই আলিঙ্গনে তিনি বেঁধে রেখেছেন আজীবন।