নেটফ্লিক্সের ফাঁসি চাই

  • ইমন খান, অতিথি লেখক
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

‘এক্সট্র্যাকশন’ সিনেমার পোস্টার ও নেটফ্লিক্স ,ছবি: সংগৃহীত

‘এক্সট্র্যাকশন’ সিনেমার পোস্টার ও নেটফ্লিক্স ,ছবি: সংগৃহীত

২০১৩ সালে নেটফ্লিক্স যখন তার প্রথম অরিজিনাল টিভি সিরিজ ‘হাউজ অফ কার্ডস’র জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়; তখন তারা সিরিজটির একটি পর্বও রিভিউ করেনি, তাহলে প্রশ্ন এত বড় সিদ্ধান্ত কিভাবে নিয়েছিল নেটফ্লিক্স কর্তৃপক্ষ?

উত্তর: বিগ-ডেটা...

বিজ্ঞাপন

নেটফ্লিক্সের মোটামুটি সব সিদ্ধান্তই বিগ-ডেটা আর আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স দ্বারা প্রভাবিত। গুগলের মত নেটফ্লিক্সের কাছেও ব্যবহারকারীদের বিশাল সাইজের তথ্য আছে যা তাদের যেকোন সিদ্ধান্ত নিতে দারুণভাবে সহায়তা করে।

‘হাউজ অফ কার্ডস’র পোস্টার


‘হাউজ অফ কার্ডস’র ক্ষেত্রে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ছিল নেটফ্লিক্সের কাছে

বিজ্ঞাপন

১) এই সিরিজটির ব্রিটিশ সংস্করণ- যেটা আগেই যুক্তরাজ্যে প্রচারিত হয়েছিল এবং তা যথেষ্ট দর্শক সমাদৃত হয়েছিল।
২) সিরিজটির পরিচালক ছিলেন ডেভিড ফিঞ্চার- নেটফ্লিক্সের তৎকালীন ডেটা অনুযায়ী দর্শকদের মাঝে ফিঞ্চারের নির্মিত কন্টেন্টগুলোর গ্রহণযোগ্যতা ছিল বেশ।
৩) সিরিজের কেন্দ্রীয় চরিত্রে ছিলেন কেভিন স্পেসি- যে কোন সিনেমা বা সিরিজে স্পেসি থাকা মানেই প্রোডাকশন হিট, ঠিক এমন ডেটাই নির্দেশ করেছিল নেটফ্লিক্সের এনালাইসিস।

এই তিন তথ্য থেকে সহজেই এক ভেন ডায়াগ্রাম তৈরি করে ফেলে নেটফ্লিক্স আর চোখ বন্ধ করে ১০০ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি সেরে ফেলে ‘হাউজ অফ কার্ডস’ টিমের সাথে। ফলাফল? এখনো পর্যন্ত নেটফ্লিক্সের দুর্দান্ত জনপ্রিয় সিরিজগুলোর ভেতরে ‘হাউজ অফ কার্ডস’ একটি।

এতক্ষণের পাঁচালীর উদ্দেশ্য? একটা সম্যক ধারণা পাওয়া যে নেটফ্লিক্স মূলত কিভাবে কন্টেন্ট নির্বাচন করে আর এই পুরো প্রক্রিয়াতে তাদের প্রভাব কতটুকু। নেটফ্লিক্সে দুই ধরণের কন্টেন্ট পাওয়া যায়- অরিজিনাল আর লাইসেন্সড; অরিজিনাল কন্টেন্টগুলোর প্রডাকশনে নেটফ্লিক্সের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা থাকে তবে লাইসেন্সড কন্টেন্টগুলো নেটফ্লিক্স রেডিমেড কিনে ফেলে।

নেটফ্লিক্সে ‘এক্সট্র্যাকশন’

এখন আসি আমাদের মূল আলোচনায়, সাম্প্রতিক ঢাকার প্রেক্ষাপটে নির্মিত ‘এক্সট্র্যাকশন’ চলচ্চিত্র নিয়ে দারুণ বিতর্ক তৈরি হয়েছে, কেউ কেউ নেটফ্লিক্সের মুণ্ডুপাত করেও দিচ্ছেন। তবে আমার মনে হয় আমরা উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপাচ্ছি।


‘এক্সট্র্যাকশন’ হল নেটফ্লিক্সের অরিজিনাল কন্টেন্ট, কিন্তু অরিজিনাল কন্টেন্টগুলোতেও নেটফ্লিক্সের ভূমিকা ঠিক কতটুকু থাকে? প্রথমত নেটফ্লিক্স কন্টেন্টের বাণিজ্যিক সম্ভাব্যতা নিরূপণের জন্য বিগ-ডেটার সহায়তা নিবে, সেখানে থেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে। এটার প্রযোজনা কিংবা ডিস্ট্রিবিউশনে নেটফ্লিক্স আগাবে কি আগাবে না তা ঠিক করে বিগ-ডেটা, যেমনটা হয়েছিল ‘হাউজ অফ কার্ডস’র ক্ষেত্রে। কিন্তু কন্টেন্টের শিল্প নির্দেশনা, ক্রিয়েটিভ জায়গাগুলোতে কিন্তু নেটফ্লিক্স হস্তক্ষেপ করে না। এটা সম্পূর্ণ পরিচালক আর সংশ্লিষ্ট প্রোডাকশন হাউজের উপর নির্ভর করছে।

‘এক্সট্র্যাকশন’ চলচ্চিত্রটির নির্মাণে নেটফ্লিক্স প্রধানত ডিস্ট্রিবিউটের ভূমিকা পালন করেছে। তাহলে নির্মাণে যুক্ত কারা? হলিউডের এজিবিও প্রোডাকশন হাউজ এই চলচ্চিত্রের আসল নির্মাতা আর এজিবিও এর নেপথ্যে আছে বিখ্যাত রুশো ব্রাদারস। এন্থোনি রুশো আর জোয় রুশো (রুশো ব্রাদারস) হলিউডে এখন অ্যাকশানধর্মী মোশন-পিকচার নির্মাণে দেবতা-তুল্য। তাদের সর্বশেষ ক্যাপ্টেন অ্যামেরিকা: দ্যা উইন্টার সোলজার, ক্যাপ্টেন অ্যামেরিকা: সিভিল ওয়্যার, অ্যাভেঞ্জার্স: ইনফিনিটি ওয়ার, অ্যাভেঞ্জার্স: এন্ড গেইম ইত্যাদি চলচ্চিত্রগুলো বক্স অফিসের সব হিসেব নিকেশকে এলোমেলো করে দিয়েছিল।

তো রুশো ব্রাদার্স যখন নেটফ্লিক্সের কাছে নতুন একটা ধামাকা অ্যাকশন মুভির প্ল্যান নিয়ে এলো, বলা বাহুল্য নেটফ্লিক্স এক কথাতেই রাজি হল। কেন? কারণ নেটফ্লিক্সের ডেটা নির্দেশ করে রুশো ব্রাদার্সদের নির্মিত বা সম্পৃক্ততায় নির্মিত অ্যাকশন মুভিগুলো দারুণভাবে দর্শকপ্রিয় হয়। আর সাথে থাকে ব্যাবসায়িক সাফল্য! তাই নেটফ্লিক্স ‘এক্সট্র্যাকশন’ বানানোর সিদ্ধান্তে যেতে খুব একটা সময় নেয় নি। জানিয়ে রাখা ভালো, রুশো ব্রাদার্সের সাথে নেটফ্লিক্সের এটাই ছিল প্রথম কলাবোরেশন আর এরপর তারা ‘ম্যাজিক: দ্যা গ্যাদারিং’ নামের একটা অ্যানিমেশনের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে।

গল্পের এই পর্যন্ত সব ঠিক-ঠাক ছিল, বিপত্তি বাঁধলো ঠিক পরের ধাপ থেকে। নেটফ্লিক্সের সবুজ সংকেত পেয়ে রুশো ব্রাদার্সের প্রোডাকশন হাউজ কাজে নেমে পড়ল, নিজেরা নির্দেশনার দেয়ার পরিবর্তে রুশো ব্রাদারস একজন পরিচালক নির্বাচিত করলেন যিনি ‘এক্সট্র্যাকশন’ চলচ্চিত্রটা নির্দেশনা দিবেন। তো তারা খুঁজে খুঁজে স্যাম হার্গ্রেইভ নামের এক ভদ্রলোকের হাতে এই গুরুদায়িত্ব তুলে দিলেন।

সিনেমাটির একটি দৃশ্যে ক্রিস হেমসওয়ার্থ

অবাক করা বিষয় হল, স্যাম হার্গ্রেইভ জীবনে কখনোই চলচ্চিত্র পরিচালনায় যুক্ত ছিলেন না। রুশো ব্রাদার্সের সিনেমাগুলোতে তিনি স্ট্যান্ট কোর্ডিনেটর হিসেবে বহুদিন কাজ করেছেন। সোজা বাংলায় বলতে গেলে ফাইট-ডিরেক্টরকে ধরে এনে রুশো ভাতৃদ্বয় আস্ত একটি সিনেমা পরিচালনার দায়িত্ব দিলেন, প্রশ্ন কেন?

বহুদিন বিখ্যাত পরিচালকের সাথে কাজ করে সিনেমাটগ্রাফার, স্ক্রিন রাইটার, এডিটর পরিচালনায় নেমে গেছেন এমন উদাহরণ আছে, আর এসব ক্ষেত্রে যাদের অধীনে তারা কাজ করেছেন তাদের লবিং এর ভূমিকাটাই বেশি। স্যাম হার্গ্রেইভও রুশো ব্রাদার্সের নেক নজরে পরে পরিচালনায় চলে আসাদের একজন।

হার্গ্রেইভের পুরো সিনেমা বানানোর অভিজ্ঞতা কোন কালেই ছিল না, তাছাড়া তিনি অ্যাকশন দৃশ্যগুলো নির্মাণের বাইরে রুশো ব্রাদার্সের সাথে পূর্ববর্তী সিনেমাগুলোতে কাহিনী বিনির্মাণ, শিল্প নির্দেশনাতে সম্পৃক্ত থাকতেন কম।

ফলাফলস্বরূপ যা হবার তাই হল, দুর্দান্ত অ্যাকশনে ভরপুর একটি সিনেমা আমরা ঠিকই পেয়েছি কিন্তু সিনেমার ডিটেইলিং এ ভয়াবহ কিছু সমস্যা থেকে গেল। সিনেমা আর বাস্তবতা এক না তবে এটাও ঠিক যে যখন আপনি কোন সমাজ বা সংস্কৃতিকে তুলে ধরবেন-তখন সেটার ডিটেইলিং অনেক ভাল না হলেও খারাপ না হওয়াটা জরুরী। অন্তত হলিউডি নির্মাতাদের কাছ থেকে আমরা সবাই সেই প্রত্যাশাই করে থাকি।

স্যামের জায়গাতে যদি নিয়মিত কোন পরিচালক থাকতেন অথবা রুশো ব্রাদার্স নিজেরাই যদি পরিচালনা করতেন- তাহলে হয়ত বাংলাদেশের প্রতিনিধিকারী দলটির পুরো প্রডাকশনে আরও বেশ সম্পৃক্ততা থাকত, তাহলে হয়ত ঢাকার দোকানগুলোর ব্যানারে হিন্দি লেখা থাকত না, তাহলে হয়তো প্রডাকশন ডিজাইনের সীমাবদ্ধতাগুলো এতটা দৃশ্যমান হত না।

দিনশেষে একজন নির্মাতার কাছে তার সৃষ্টি সন্তানের মত, তিনি গোঁজামিল দিয়ে কোন কিছু বানাবার আগে চেষ্টা করবেন সেটার ভেতরে ঢুকবার। অন্তত ‘এক্সট্র্যাকশন’ সিনেমায় জড়িত শিল্প নির্দেশনা প্রদানকারী টিমের কাজকর্ম একজন জাত নির্মাতা অবশ্যই দেখভাল করতেন।

সিনেমাটির একটি দৃশ্য


কিন্তু প্রথম নির্মাণেই পরিচালকের কাছ থেকে এত ডিটেইলিং আশা করাটাও আসলে বোকামি। আর তিনি যদি মৌসুমি নির্মাতা হয়ে থাকেন তাহলে সেটা ভিন্ন। মৌসুমি নির্মাতারা আসেন, জনপ্রিয়তা পেলে থাকেন না হলে হারিয়ে যান। তবে রুশো ব্রাদার্স কিছুটা হতাশ করেছেন, নেটফ্লিক্সের সাথে তাদের প্রথম কোলাবোরশনে রেগুলার কোন নির্মাতাকে দায়িত্ব দিতে পারতেন...আর স্বভাবতই প্রডাকশনের যা কিছু ব্যর্থতা তার দায় ৯৫% পরিচালক আর এজিবিও টিমের উপরেই বর্তায়।

সেই শুরুর আলোচনায় আবার ফিরে যাই, পুরো ঘটনায় আসলে নেটফ্লিক্সের দায় কতটুকু? আমি বলব ৫%, আর এই ৫% আমার দেশে যেমন প্রযোজ্য ঠিক তেমনটা প্রযোজ্য নেটফ্লিক্সের অপারেশন বিদ্যমান থাকা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের জন্যও। শিল্প নির্দেশনা, কাহিনী, ক্রিয়েটিভ এগুলোতে পরিচালককে স্বাচ্ছন্দ্যটুকু দিয়ে নেটফ্লিক্স মূলত বিগ ডেটা দিয়ে প্রজেক্টের ফিন্যানশিয়াল ভায়াবিলিটি নিরূপণ করতেই বেশি মনোযোগী থাকে!
হ্যাঁ, এখন আপনি দাবী করতে পারেন যে নেটফ্লিক্সের কন্টেন্ট মডারেশন আরও মজবুত হওয়া জরুরী। তবে নিরাশার কথা হল এতদিনের যে মডেল তারা অনুসরণ করে আসছে, খুব শীঘ্রই বড় কোন দুর্যোগ না আসলে সেটা থেকে সরে আসার কোন সম্ভাবনা নেই!
তবে আদোতে এই বিতর্কের ফলে নেটফ্লিক্সের অজান্তেই তাদের লাভ হয়েছে, গ্রামের যে ছেলেটা নেটফ্লিক্সের নাম জানত না সে বোধকরি ‘এক্সট্র্যাকশন’ বিতর্কের কারণে নেটফ্লিক্স চিনে ফেলেছে। হয়ত এই কন্টেন্ট দেখে ভালো না লাগলেও অন্য একটা কন্টেন্ট দেখে তার ভালো লাগবে আর সাবস্ক্রাইব করবে।

একটা তিতে সত্য দিয়ে শেষ করি, আমাদের দেশের অনেক ভালো কিছুই আমরা আসলে প্রচার করতে ব্যর্থ হয়েছি, পজেটিভিটিগুলোকে সেভাবে তুলে ধরতে কখনোই পারিনি, স্বভাবতই নেতিবাচক সংবাদের কারণে বার বার বিশ্ব মিডিয়াতে শিরোনামের কারণ হয়েছি। আজ যদি আমাদের বৃহৎ পরিসরে একটা পজিটিভ ইমেজ থাকত তাহলে স্যাম হার্গ্রেইভ এর মত ঠিকঠাক বাংলাদেশকে না চেনা ভদ্রলোকটিও নেগেটিভ কিছু নির্মাণের আগে পড়াশুনা করে নিতেন। সেই অব্দি আমাদের নেটফ্লিক্সের ফাঁসী চাওয়া থেকে বিরত থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।

লেখক: ইমন খান, বিজ্ঞাপন নির্মাতা