কাকে শিল্পী বলছেন?
দেশজুড়ে আলোচনা-সমালোচনার তুঙ্গে অভিনয়শিল্পীদের নির্বাচন। অন্যদিকে সংসদে সুবর্ণা মুস্তাফা শিল্পীদের পক্ষে দাঁড়িয়ে বক্তব্য রেখেছেন। এমন পরিস্থিতিতে জনপ্রিয় নির্মাতা সুমন আনোয়ার প্রশ্ন তুলেছেন ‘কাকে শিল্পী বলা হচ্ছে?’। গতকাল (২৯ জানুয়ারি) বিষয়টি নিয়ে একটি দীর্ঘ ফেসবুক পোস্ট মনোযোগ কেড়েছে নেটিজেনদের। সমসাময়িক বাস্তবতায় তার এ পোস্টের প্রশংসা করছেন অনেকেই। অনেকেই ভাবছেন চিন্তার খোরাক যোগাবে তার এমন বয়ান। পাঠকদের জন্য নির্মাতা সুমন আনোয়ারের লেখাটি তুলে ধরা হল।
গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত অডিও-ভিজুয়াল পেশার লোকেরা (শিল্পী শব্দ ব্যবহারের মতো শিল্পী খুঁজে পাইনি মার্জনা করবেন) একটা আধুনিক ইনস্টিটিউট করতে পারেনি অথবা ভাবেনি- যেখান থেকে অভিনয়শিল্পী-নির্মাতা-টেকনিশিয়ান তৈরি হওয়ার চর্চা ও রিসার্চ হবে, পক্ষান্তরে তারা মসজিদ,মন্দির, শপিং কমপ্লেক্স তৈরী করেছেন নয়তো ক্ষমতার লোভে রাজনীতিতে নাম লিখিয়েছেন। আর যারা এগুলোর কোনোটি পারেন নি তারা পুঞ্জি নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন।
ধরা যাক, ব্যক্তি অথবা সংগঠনের পক্ষে একটা আধুনিক ইনস্টিটিউট করা সম্ভব না যদি সরকার উদ্যোগ গ্রহণ না করে, বাংলাদেশের যতগুলো সংগঠন অভিনয়কে কেন্দ্র করে বিরাজমান- রেডিও টেলিভিশন থিয়েটার চলচ্চিত্র, এই সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিরা সরকারের কাছে ত্রাণ অনুদান চিকিৎসা সাহায্য পেনশন তহবিল সরকারি আবাসন প্লট এর বাইরে কোন দাবি-দাওয়া নিয়ে হাজির হয়েছে বলে আমার জানা নেই।
আপনি যে সেক্টরেই কাজ করেন তার ইনস্টিটিউশনাল স্ট্রাকচার তৈরী না হলে সেই ইন্ডাস্ট্রি মুখ থুবড়ে পড়বেই। আজকে বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি সেলাই কর্মী আর প্রবাসী শ্রমিক, শত শত বৎসরের ধারাবাহিক ঐতিহ্যে আমাদের সেলাই কর্মীদের এই সমৃদ্ধি, কারণ এই অঞ্চলের মানুষ একসময় মসলিনের মত কাপড় তৈরি করতো।
এ অঞ্চলের কামার কুমার তাঁতি জেলে কৃষক প্রতিদিন শিল্পীর মতো করে ফসল বুনে জমিতে আর সেই ধারাবাহিকতায় মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের শ্রমবাজার, আমরা কি পেরেছি আমাদের সেলাই কর্মী আর শ্রমিকদের এই দক্ষতাকে বিশ্ববাজারে ব্র্যান্ডিং করতে?
বায়ার অর্ডার না দিলে সেলাই বন্ধ হয়ে যাবে, কিন্তু কাস্টমার যদি জানতো কেন এই অঞ্চলের শ্রমিকদের সেলাই করা কাপড় মূল্যবান, তার পেছনের ঐতিহ্য বা দর্শন তাহলে সে এটাই খুজবে, ফিলোসফিক্যালি কাস্টমারকে রিচ করার কোনো আয়োজন এত বড় গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রির আমি দেখিনি। যেমন দেখিনি সাইমন ড্রিং চলে যাওয়ার পরে এদেশে কোন টেলিভিশনকে টেলিভিশন হয়ে উঠতে, কারণ তারা বারবার নির্মাতা কে বলেছে ভাই এটাতো টেলিভিশন-টেলিভিশনের মতই করেন।
গত ২০ বছরে টেলিভিশনে নতুন কোন একটা আইডিয়া দেখিনি, সেখানে কর্মরত লোকেরা নতুন আইডিয়াকে এপ্রিশিয়েট করার মত সাহস অথবা জ্ঞান রাখে না, তারা শুধু চাকরিই করে, সেই দেশে ডাবিং সিরিয়াল চলবে না তো আর কি চলবে?
প্রসঙ্গে আসা যাক ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই অঞ্চলে অডিও-ভিজুয়াল ইন্ডাস্ট্রি বিরাজমান, একজন সুপারস্টারের একথা বলেন যিনি জেনে বুঝে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ক্রিয়েটিভ জার্নির মধ্যে ছিলেন, অথবা স্টারডমটা মেন্টেন করেছে, প্রতিষ্ঠিত পরিচালক অভিনেতা অভিনেত্রীদের ইন্টারভিউতে আমি কখনো শুনিনি মহেন্দ্র সিং ধোনির মত ডেফিনেটলি উনি শুধু ক্রিকেটটাই খেলতে চেয়েছে।
বেশিরভাগ লোকেরা অন্য জায়গায় ব্যর্থ হয়ে এখানে এসেছেন, একজন অভিনেত্রীকে ইন্টারভিউতে বলতে শুনেছি তিনি তার মামার সাথে কারণ বাজারে মাছের বাজারের পাশে সিনেমার শুটিং দেখতে এসেছিলেন- তারপর কেউ একজন বলল তুমি পারবা? অন্য একজন পরিচালক ইন্টারভিউতে বলেছিলেন ইন্ডিয়া থেকে আমরা পাঁচটার সিনেমা কিনে আনছি সেগুলোর নায়ক খুঁজতে গিয়ে নবাগত অভিনেতা বলেছিলেন আমি অমুক সিনেমাটা আমি ২৭ বার দেখেছি তাই তিনি সেটা নির্মাণ করেছিলেন...
ভাই, ক্রিয়েটিভিটি অন্য জিনিস, সেটার জন্য সাধনা করতে হয় জেনে বুঝে।
শিল্পীর বড় সংকট আজকে বাংলাদেশে। হাসি তামাশা ইয়ার্কি ট্রল করতে যেয়ে পপুলার করে ফেলছেন অযোগ্য একজন মানুষকে পরবর্তীতে তিনি ‘শিল্পী’ বলে হাজির হয়ে দেশ ও জাতির প্রতিনিধিত্ব করছেন, বিশ্ববাজারে আপনার কয়জন শিল্পী আধুনিক শিল্পীসত্তা নিয়ে তার দর্শনের কথা বলতে পারবে অথবা বাংলাদেশকে রিপ্রেজেন্ট করতে পারবে?
হ্যাঁ পারবে, পরচর্চা আর বিচার সালিশ করতে, এখনো সময় আছে বাংলা কন্টেন্টের গ্লোবাল বাজার তৈরি করতে হলে প্রকৃত শিল্পী হয়ে ওঠার জন্য অবকাঠামো তৈরি করুন অথবা শিল্পী হয়ে উঠুন, সম্ভাবনার এক অপার বিশ্ব অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।