উত্তম বলেছিলেন সুচিত্রাকে- রমা, তোমার সঙ্গে যদি আমার বিয়ে হতো!

  • পান্থ আফজাল, অতিথি লেখক
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ফিল্ম ফেয়ার ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে রঙিন সুচিত্রা সেন

ফিল্ম ফেয়ার ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে রঙিন সুচিত্রা সেন

সালটা ১৯৫২। ‘শেষ কোথায়’ ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্র অঙ্গনে পদার্পণ মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের। তবে নিরাশার বিষয় ছিল যে, ছবিটি শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি।

পরবর্তীতে তার দ্বিতীয় ছবি ‘সাত নম্বর কয়েদী’ মুক্তি পায় ১৯৫৩ সালে। মুলত এই ছবির মাধ্যমেই রমা নামের মহানায়িকার আবির্ভাব। শুরুটা ‘শেষ কোথায়’ ছবির মাধ্যমে হলেও জনপ্রিয়তা পান আরেক মহানায়ক উত্তম কুমারের বিপরীতে অভিনয়ের মাধ্যমে। সেটা ছিল ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিতে অভিনয়। এই ছবিটি তুমুল সাড়া ফেলে দেয় এবং সেইসাথে শুরু হয় উত্তম-সুচিত্রা জুটির যুগ।

বিজ্ঞাপন

বাংলা ছবির এই জনপ্রিয় জুটি পরবর্তী ২০ বছর ছিলেন ভক্তদের কাছে আইকন। সমানতালে এই জুটি একসাথে অভিনয় চালিয়ে যান দীর্ঘ ২২ বছর। তাদের দুইজনের মধ্যে সম্পর্কটা এতটাই গভীর ছিল যে, সুচিত্রা উত্তমকে ‘উতু’ আর উত্তম সুচিত্রাকে ‘রমা’ বলে ডাকতেন। এ সম্পকের্র মধ্যেও মান-অভিমান, ঝগড়াঝাটি চলত। মাঝে দুইজন একসঙ্গে অনেকদিন কাজও করেননি। দুইজনের ভুল বোঝাবুঝির ‘সপ্তপদী’ ছবির শুটিং দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল।

সুচিত্রা সেনের বাড়িতে এক সন্ধ্যায় উত্তম যখন সুচিত্রাকে বলেছিলেন, “রমা, তোমার সঙ্গে যদি আমার বিয়ে হতো!’ প্রতিত্তরে সুচিত্রা বলেছিলেন, ‘একদিনও সেই বিয়ে টিকত না। তোমার আর আমার ব্যক্তিত্ব অত্যন্ত স্বতন্ত্র। সেখানে সংঘাত হতোই। তার ওপর, তুমি চাইবে তোমার সাফল্য, আমি চাইব আমার। এ রকম দুজন বিয়ে করলে সে বিয়ে খুব বাজেভাবে ভেঙে যেত।”


তাদের দুইজনের এই ব্যাপার নিয়ে সে সময় কলকাতার এক সাংবাদিক একটি সিনে ম্যাগাজিনেও লিখেছিলেন। উত্তম যেদিন মারা যান সেদিন মধ্যরাতে মালা হাতে তাকে শেষ অর্ঘ্য দিতে এসেছিলেন সুচিত্রা। সেটা এখনও সবার কাছে এক বেদনা বিধুর পুরাণ কাহিনী। তবে সুত্র মারফত জানা যায়, চলচ্চিত্রে অভিনয়ের বাইরে ব্যক্তি জীবনেও প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে উত্তম-সুচিত্রার মধ্যে।

১৯৫৪ সালে একটি পোস্টার ঝড় তোলে উত্তম-সুচিত্রার সংসার জীবনে। ঝড় তোলা ওই পোস্টারে সুচিত্রার স্বাক্ষরসহ লেখা ছিল ‘আমাদের প্রণয়ের সাক্ষী হলো অগ্নিপরীক্ষা।’ ১০টি ছবিতে চুক্তিবদ্ধ ছিলেন দু’জনে। ১৯৫৪ সালেই এ জুটির ৬টি ছবি দারুণ জনপ্রিয় হয়। স্বাভাবিক কারণেই অভিনয় ছাড়তে রাজি হননি সুচিত্রা। সুচিত্রা উত্তমকে মুল্যায়ন করতো নিবিড়ভাবে। উত্তম কুমার তার প্রযোজিত ‘হারানো সুর ছবিতে নায়িকা হওয়ার প্রস্তাব দিলে সুচিত্রা বলেছিলেন, ‘তোমার জন্য সব ছবির ডেট বাতিল করব।’


তবে, শেষ ছবি ‘প্রণয়’ করার পর মনে হয়েছিল যে তিনি আর দিতে পারছেন না। বহু পরিচালক-প্রযোজক স্ক্রিপ্ট নিয়ে গেছেন তার কাছে। মহানায়িকা মন দিয়ে স্ক্রিপ্ট পড়েছেন, পছন্দ না হওয়ায় ফিরিয়ে দিয়েছেন। এরপর তিনি সিদ্ধান্ত নেন আধ্যাত্মিকতায় তন্ময় হবেন। সেই থেকে তিনি আর প্রকাশ্যে আসেননি।

ছবিতে অভিনয় করে শুধু দর্শকপ্রিয়তা কিংবা জনপ্রিয়তায় নয়, রমা পেয়েছিলেন অসংখ্য পুরস্কারও। ২০০৫ সালে সুচিত্রা সেনকে ভারতের চলচ্চিত্র অঙ্গনের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কার দেওয়ার প্রস্তাব করা হলেও সুচিত্রা সেন দিল্লিতে গিয়ে ওই সম্মান গ্রহণ করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। সর্বশেষ ১৯৭৮ সালে ‘প্রণয় পাশা’ ছবিতে অভিনয় করার পর হঠাতই অন্তরালটা বেছে নিয়েছিলেন তিনি।


ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি নিজেকে রেখেছিলেন লোকচক্ষুর অন্তরালে। যার অবসান হয় ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি কলকাতার বেলভিউ হাসপাতালে। নীরবে নিঃশব্দে ৮৩ বছর বয়সে সকলকে কাঁদিয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন তিনি। তবে মৃত্যুতেও শেষ হয়নি সেই রহস্যময় সুচিত্রার গল্প। মহাপ্রস্থানের পরও সবার মনে জায়গা পেয়েছেন তার সেই মন ভোলানো হাসি।

আজ মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের অষ্টম প্রয়াণ দিবস। ভক্তের মনে এখনও সুচিত্রা সেন রূপকথার গল্পের মতোই চিরভাস্বর ।