বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে ওঠা এনডিই (ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড) ভ্যাটের চালান জালিয়াতিতে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) লাইসেন্স ফির বিপরীতে জমা করা ভ্যাটের চালান ভুয়া বলে নিশ্চিত করেছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক।
বিইআরসি সুত্র জানিয়েছে, এনডিই নামে বিটুমিন মজুদের লাইসেন্স রয়েছে। কোম্পানিটি ৯ জানুয়ারি নবায়ন ফি ৭০ হাজার টাকার পে অর্ডার এবং ভ্যাট বাবদ ১০ হাজার ৫০০ টাকার চালান জমা দেন। ভ্যাটের চালান হিসেবে অনলাইন ব্যাংকিং অর্থ জমা গ্রহণ স্লিপ জমা দেন। কোম্পানিটির খোদ ব্যবস্থাপনা পরিচালক রায়হান মোস্তাফিজ ফরোয়াডিংসহ ওই চালান জমা দেন।
সোনালী ব্যাংক কারওয়ান বাজার শাখার ওই ভ্যাট চালানটি সন্দেহ হলে যাচাই করার জন্য চিঠি প্রেরণ করে বিইআরসি। সেই চিঠির জবাবে চালান টি ভূয়া বলে প্রত্যায়ন করেছে সোনালী ব্যাংক। তারা বলেছে, তাদের ব্যাংক থেকে সেটি ইস্যু করা হয়নি। আর স্বাক্ষরও সঠিক নয়।
ওই ঘটনা ধরার পড়ার পর বিইআরসি তাদের আগের ভ্যাটের চালানগুলো যাচাই-বাছাই করা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সোনালী ব্যাংকের চিঠি পাওয়ার পর এনডিইকে শোকজ করেছে বিইআরসি। এতে বলা হয়েছে, লাইসেন্স ফির সঙ্গে জমা করা ভ্যাটের চালান জমা দিয়েছেন। উক্ত রশিদের উপর সোনালী ব্যাংক কারওয়ান বাজার শাখার সিল রয়েছে (২৬/১২/২০২৪)। উক্ত সিলটি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের শাখার নয় বলে ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে অবহিত হওয়া গেছে। বিধায় রশিদটি জাল বলে প্রতীয়মান হয়।
বর্ণিতাবস্থায় লাইসেন্স নবায়ন আবেদনের সাথে ভ্যাট বাবদ টাকা জমা প্রদানের জাল রশিদ দাখিল করায় কেন আপনার বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না সে বিষয়ে ৭ দিনের মধ্যে লিখিত ব্যাখ্যা প্রদানের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।
বিইআরসি চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ শোকজ করার তথ্য নিশ্চিত করেছে বার্তা২৪.কমকে। তিনি বলেছেন, আমরা শোকজ করেছি। কি জবাব দেয় দেখি তারপর পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অবশ্যই এই জালিয়াতির দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। এখানে কোন রকম তদ্বীর করে পার পওয়ার সুযোগ নেই।
বিইআরসির একটি সুত্র জানিয়েছে, জালিয়াতির দায়ে ধরার পড়ার পর এখন নানান তদ্বীর অব্যাহত রেখেছে। তারা নানান দিক থেকে নানান কায়দায় বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। বিইআরসির দু’একজন অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী তাদের পক্ষে লবিং তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা শোকজ ঠেকানোর জন্য অনেক চেষ্টা করেছেন, তবে কমিশনের চেয়ারম্যান কঠোর অবস্থানের কারণে সুবিধা করতে পারেন নি। তদবিরবাজরা এখনও হাল ছেড়ে দেয়নি, তারা লুঘু শাস্তি দিয়ে এনডিইকে বাঁচিয়ে দিতে তৎপর রয়েছে।
ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের এজিএম (মার্কেটিং) আব্দুর রশিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি বার্তা২৪.কমকে বলেন, এ বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই, তাই কোন মন্তব্য করতে পারছি না।
তার মাধ্যমে কোম্পানির যথাযথ কর্তৃপক্ষের কোন বক্তব্য পাওয়ার সুযোগ আছে কি না। অথবা যথাযথ কর্মকর্তার ফোন নম্বর সরবরাহ করার কোন সুযোগ আছ কি-না। জবাবে বলেন আমি চেষ্টা করে দেখবো, আমি কোম্পানিকে আপনার বিষয়টি অবগত করবো। এরপর এক সপ্তাহ গত হলেও তিনি কোন রিপ্লাই দেননি।
বৃহস্পতিবার (৩০ জানুয়ারি) তাকে (আব্দুর রশিদ) আবার ফোন দেওয়া হলে বলেন, আমি আপনার নম্বরটি কর্তৃপক্ষকে দিয়েছি, তারা প্রয়োজন মনে করলে ফোন দেবে।
অনেক চেষ্টা করেও এনডিই লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রায়হান মোস্তাফিজের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। যিনি নিজে ওই ভ্যাটের চালান জমার সঙ্গে চিঠি দিয়ে ছিলেন বিইআরসিতে। পরিচালক পেট্রোলিয়াম বরাবরে দাখিলকৃত পত্রের সঙ্গে তিনি ওই ভূয়া চালান সংযুক্ত করে জমা দেন বলে বিইআরসি সুত্র নিশ্চিত করেছে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে একচেটিয়া ব্যবসা করেছে এনডিই। অখ্যাত এই প্রতিষ্ঠানটি কয়েক বছরে রাঘোব বোয়ালে পরিণত হয়ে ওঠে। উচ্চদরে কাজ পাওয়া, কাজের পর বিল বাড়িয়ে নেওয়া, নিম্নমানের কাজ করে টাকা তুলে নেওয়ার বিষয়টি ছিল ওপেন সিক্রেট। শেখ পরিবারের বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলতে সক্ষম হন। পরিচয় দিতেন নূরে আলম চৌধুরীর আত্মীয় বলে। পাশাপাশি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সামরিক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকীর নামও ভাঙ্গাতের বিভিন্ন জায়গায়। যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুযোগে তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয় নি। ব্যাপক দুর্নীতি অনিয়ম করলেও তার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস দেখাননি আমলারা। সময়ের ব্যবধানে তারা টু-পাইস হাতিয়ে স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছেন। কাজ শেষ হওয়ার আগেই রাস্তার বিটুমিন উঠে যাওয়া, বিশাল বিশাল গর্তের সৃষ্টি হলেও এনডিই ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরে।
সওজ সুত্রে জানা গেছে, ২০১১-১২ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত ঠিকাদারি কাজের ৯০ শতাংশ পেয়েছে এনডিই সিন্ডিকেট ভুক্ত ১৫টি প্রতিষ্ঠান। এক যুগে সড়ক ও সেতু নির্মাণ এবং রক্ষণাবেক্ষণে ৮৩ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় করেছে সরকার। যার মধ্যে প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকার কাজ একক ও যৌথভাবে পেয়েছে ওই ১৫টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরের পর থেকে প্রতিষ্ঠানটি সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরে ১১৩টি কার্যাদেশ পেয়েছে। এসব কাজের চুক্তি মূল্য ৫ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকার বেশি। সড়ক, সেতুর পাশাপাশি বিদ্যুৎ, আবাসনসহ বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো নির্মাণের কাজও করে এনডিই।