‘উল্টো আমাকেই ভয় দেখাচ্ছে তদন্ত কমিটি’
‘বিদ্যুৎ চুরি ধরে ফেলায় কাল হলো ইউসুফ আলীর’ শিরোনামে বার্তা২৪.কম এ নিউজ প্রকাশের পর তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ (নবায়নযোগ্য জ্বালানি-১ শাখা)। তদন্ত কমিটি গঠনে আশাবাদি হয়ে উঠলেও তাদের কর্মকাণ্ডে চরম হতাশা ও শঙ্কা ব্যক্ত করেছেন ইউসুফ আলী।
ইউসুফ আলী বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, তদন্ত কমিটির সদস্যরা আমার কোনো কথাই বিশ্বাস করল না এবং আমার কোন কথা পাত্তাও দেয় নি, বরঞ্চ আমাকে আরো ভয় দেখায় মিটার কোথায় রাখছেন বের করেন তা না হলে আপনার বিরুদ্ধে মামলা করা হবে, তখন বুঝবেন কেমন লাগে। এই তদন্ত কমিটি হয়েছে জাস্ট একটা বাহানা তা ছাড়া অন্য কিছু নয়। তা না হলে আমাকে ভয় দেখাবে কেন, তাছাড়া আমার কাছে সঠিক প্রমাণ আছে বলা সত্ত্বেও কেন কমিটির সদস্যরা কোন প্রমাণই নিল না কেন!
আমি প্রথমে সালাম দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম, ঢোকার পর আমাকে বসতে বলল, আমি বসলাম, বসার পর আমাকে জিজ্ঞাসা করল আপনি গ্রাহকের স্থাপনায় কিভাবে গেলেন, আপনি আগে গেলেন না কেন, আমি তখন বললাম স্যার আমি ওখানে প্রথমত যাই নাই। ওখানে পাঠাইছি আমার দুজন লোক দিয়ে লোড বৃদ্ধির চিঠি দিতে নাম হচ্ছে নিজামুদ্দিন এবং ফরিদ দফাদার। তারা হচ্ছেন লাইনম্যান ওরা গ্রাহকের মিটার নাম্বার মিল করতে গিয়ে দেখে মিটার দুটি ডাউন এবং সিল নাই। তখন ওরা আমাকে ফোন দেয়, আমি তখন গ্রাহকের স্থাপনায় যাই।
যাওয়ার পর মিটারের বেসপ্লেট, সিল নাই এবং মিটার দুটি ডাউন তখন আমি অফিসে আসি নির্বাহী প্রকৌশলী স্যারকে জানাই। তখন স্যার বিলের দুটি স্টিমেট দেখে আমাকে লাইন কাটতে বলল। তখন আমি বললাম স্যার আমি একা লাইন কাটতে পারব না। আপনার ডিপিডিসি টিম পাঠান, তখন কন্ট্রোলে ফোন দেয় এবং লোকমানের টিম পাটায়। লোকমানের টিম সহ আমি গ্রাহকের স্থাপনায় যাই। যাওয়ার পর প্রথমে মিটারের সিল লাগায় তারপর পোল থেকে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করি। আমি নিজামুদ্দিন আর গ্রাহক একটা স্বীকারোক্তি লেখি। তারপর গ্রাহকের স্বাক্ষর নেই। মিটার গ্রাহকের হেফাজতে রেখে এসেছি, সিল লাগায়। প্রতি মাসে মিটার রিডার আব্বাসকে ১০ হাজার করে টাকা দেয়, একটা স্বীকারোক্তি নেই। তারপর আমরা সবাই অফিসে চলে আসি।
তখন আমাকে প্রশ্ন করল, আপনি কেন চিঠি দিতে গেলেন আপনার উপর কেন দায়িত্ব দিল। আমি বললাম ওটা নির্বাহী প্রকৌশলী স্যার বলতে পারবেন, আমি জানিনা, আমাকে বলল গ্রাহকের স্থাপনায় সবাই আপনার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়েছে যে, আপনি মিটার খুলে নিয়ে এসেছেন, আমি তখন বললাম কে কে সাক্ষী দিয়েছে, তখন বলল গ্রাহকরা দিছে এবং আপনার লাইনম্যানরাও দিছে,তখন আমি বললাম আমার কোন লাইনম্যান স্বাক্ষর দিয়েছে! টিম লিডার লোকমানকে ফোন দিয়ে দেখতে পারেন। তখন নুরুল আফসার (তদন্ত কমিটির সদস্য, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম পরিদপ্তরের পরিচালক) স্যার লোকমানকে ফোন দিলেও। ফোন দেওয়ার পর লোকমান বলল প্রথমে মিটারে সিল করি তারপর পোল থেকে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করি। একটা স্বীকারোক্তি নিয়ে ওখান থেকে চলে আসি।
আমাকে জিজ্ঞেস করল রেজিস্টার খাতায় সিল এন্ট্রি করেছে কে এবং কে সিল বুঝে নিয়েছে। আমি বললাম স্যার মিটার তো রেজিস্টার খাতায় এন্ট্রি হয়েছে, এই তার ডকুমেন্ট, তখন নুরুল আফসার স্যার বলে এটা রেজিস্টার খাতা এন্টি খাতা নয়,আমি আবার বললাম এটাই রেজিস্টারের এন্ট্রি খাতা। তখন আমার কথা বিশ্বাস করলো না বলল এটা খাতা নয়, আমি বললাম স্যার মিটার গ্রাহকের স্থাপনা থেকে মিটার খুলে আনার পর, এখানে এন্ট্রি করা হয় এবং মিটারে কত ইউনিট আছে সেটা এখানে এন্ট্রি করা হয়। তারা কোন কথায় আমার শুনলো না। তারা বলে এটা রেজিস্টার এন্টি খাতা নয় কিন্তু আমি চ্যালেঞ্জ দিলাম এটা রেজিস্টার এন্ট্রি খাতা। তারপরও তারা বিশ্বাস করল না।
আমি বললাম সার গ্রাহকের সাথে আমি কথা বলেছি আমার কাছে গ্রাহক স্বীকার করেছে সে আমার সম্পর্কে কোন কথাই বলে নাই। মিটার আমি খুলে আনি নাই, বিদ্যুৎ অফিস এর লোক খুলে এনেছে। তাও আমার কথা বিশ্বাস করতেছে না। আমি বললাম যে আমার কাছে কল রেকর্ড আছে। তখন সে বলল যে কল রেকর্ড বাদ দাও। আমি বললাম গ্রাহক নিজে লাইন লাগাইছে, তার ভিডিও আমার কাছে আছে। একই কথা বারবার সিনিয়র সহকারী সচিব স্যার বলে সবাই আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিচ্ছে যে, আপনি মিটার খুলো নিয়ে এসেছেন। আমি বললাম যে, স্যার আমি যদি মিটার খুলে নিয়ে আসি তাহলে কোন ভিডিও প্রমাণ আছে, তখন সিনিয়র সহকারী সচিব (বিদ্যুৎ বিভাগ) মাজহারুল ইসলাম স্যার আমাকে বলল যে, সূর্য পূর্ব দিক থেকে ওঠে , আর পশ্চিম দিকে ডুবে, তার কোন প্রমাণ আছে!
আমি বললাম স্যার আমার কাছে কল রেকর্ড আছে, ভিডিও ফুটেজ আছে, এগুলো আপনি দেখেন সিনিয়র সচিব স্যার বলল এগুলোর কোন ভ্যালু নাই। এগুলো বাদ দাও। এগুলো দেখতে হবে না। কল রেকর্ড, ভিডিও ফুটেজ, মিটার স্টোর জমা পড়ছে তার কাগজ, গ্রাহকের স্বীকারোক্তিসহ সব তথ্য জমা দিতে চাইলাম রাখল না।
চুরির দায়ে অভিযুক্ত গ্রাহকের শাস্তি আর কর্মী হিসেবে ইউসুফ আলীর পুরস্কার পাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) করেছে উল্টো। বিদ্যুৎ চুরির সঙ্গে জড়িত সিন্ডিকেট ধরা পড়ার ভয়ে টেকনিক্যাল সুপারভাইজার ইউসুফ আলীকেই চাকরি থেকে বরখাস্ত করে দিয়েছে। আর এতে সব হাস্যকর অভিযোগ আনার হয়েছে তার বিরুদ্ধে। যেগুলো তার কর্তৃত্ব কিংবা দায়ের মধ্যে পড়ে না। চাকরি চ্যুতির কারণ উল্লেখ করা হয়েছে, গ্রাহকের প্রকৃত বিদ্যুৎ ব্যবহার মিটারের প্রকৃত রিডিং সংগ্রহ না করা, অস্পষ্ট স্ক্রিনশর্ট গ্রহণ করা।
ইউসুফ আলীও দমবার পাত্র নন, তিনিও চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন। লিখিত আবেদন দিয়ে বলেছেন, মিটার রিডিং নেওয়া এবং স্ন্যানশর্ট গ্রহণ করা আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। এগুলো কর্মাশিয়াল সুপারভাইজারের কাজ। তিনি এও লিখেছেন আমার দায় থাকলে অবশ্যই শাস্তি মাথা পেতে নেবো। যদি না থাকে তাহলে আমার চাকরি ফেরত চাই।
যেভাবে ঘটনার সূত্রপাত
ইস্কাটন এলাকা প্রবাসী মুসা মজিদ (৪৩/এ) মিটারের রেকর্ড অনুাযায়ি বাড়তি লোড ব্যবহার করছিলেন। অনুমোদনহীন বাড়তি লোড বৃদ্ধির জন্য চিঠি দিতে গেলে দু’টি মিটারেই (বিলের তুলনায় অনেক কম রিডিং) টেম্পারিং ধরা পড়ে। টেম্পারিং ধরা পড়ার পুর্বে (১৯২৬৬২২৬) মে (২০২৪) মাসে ব্যবহার দেখা যাচ্ছে ২৪৬ ইউনিট। তার আগের মাসে ছিল ২৬২ ইউনিট। সর্বোনিম্ন ১৪৪ থেকে সর্বোচ্চ ৪৭৭ ইউনিটের বিল করা হয়েছে। এরমধ্যেই বিল ওঠানামা করেছে। আর টেম্পারিংয় ধরার পড়ার পরে নতুন মিটার বসানোর ফলে অক্টোবর (২০২৪) মাসে ২৯৪০ এবং নভেম্বর ২৫০১ ইউনিট বিদ্যুতের বিপরীতে বিল এসেছে যথাক্রমে ৪২ হাজার ২৩৮ টাকা এবং ৩৬ হাজার ৫৬ টাকা। ওই মিটারে বিপরীতে ৮ বছর আগে (টেম্পারিংয়ের পুর্বে) ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকার বিলের রেকর্ড পেয়েছে ডিপিডিসি। যা আগের মাসগুলোতে ২ থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ৪ হাজার টাকায় ওঠানামা করেছে। নতুন মিটার বসানোর পর শীতকালেও বিল এসেছে ৪২ হাজার টাকা অর্থাৎ প্রতিমাসে প্রায় ৪০ হাজার টাকার বেশি বিদ্যুৎ চুরির ঘটনা ঘটেছে।
অভিযোগ উঠেছে অভিযুক্ত মুসা মজিদকে বাঁচাতে ডিপিডিসির আউটসোর্সিং কোম্পানির (মুন পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং) কোঅর্ডিনেটর মমিনুল হক, ডিপিডিসির কাকরাইল জোনের তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হানিফ উদ্দিন ও ডিপিডিসির পরিচালক (এডমিন) সোনামনি চাকমা নানা রকম ষড়যন্ত্রে চালিয়ে যাচ্ছেন। ডিপিডিসির কাকরাইল জোন ও প্রধান কার্যালয়ে অনেকেই জড়িত রয়েছেন।
তদন্ত কমিটির সদস্য নুরুল আফসার (বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম পরিদপ্তরের পরিচালক) বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, আমরা রিপোর্ট জমা দিয়েছি। এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে পারছি না। আপনার কোন কথা থাকলে তদন্ত কমিটির প্রধানের সঙ্গে কথা বলেন।
ইউসুফ আলীর অভিযোগ প্রসঙ্গে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বলেন, যে কেউ যে কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ দিতেই পারে। এর বেশি আমি কোন মন্তব্য করতে চাচ্ছি না।