হাইকোর্টের না সত্ত্বেও ইউনাইটেড গ্রুপের গ্যাস বিলে বিশেষ ছাড়

  • সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

আওয়ামী লীগ সরকারের ছত্রছায়ায় আইনের উপরও ছড়ি ঘুরিয়েছে ইউনাইটেড গ্রুপ। এমন সব নজির গড়েছে যা শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বে বিরল। আইনের সংজ্ঞা, ব্যাখ্যা সবই বদলে ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ইউপিজিডি) নতুন সত্তা হিসাবে আর্বিভূত হয়েছে।

যা বাংলাদেশের আইনের কোন সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা যায় না। রেগুলেটরি কমিশন যে দাবি নাকচ করে দিয়েছে, গেছেন হাইকোর্টে, সেখানে নাকচ হলে সুপ্রিম কোর্ট গিয়েও হেরেছেন। ইউনাইটেড গ্রুপের সেই চাওয়ায় পূরণ হয়েছে সকল আইন-কানুন উপেক্ষা করে।

বিজ্ঞাপন

দেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠান যারা নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করার ক্ষমতা সংরক্ষণ করে। এ ক্ষেত্রে বিইআরসির সমান্তরাল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে ইউনাইটেড গ্রুপ। অন্যান্য ক্ষেত্রে বিইআরসি বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করলেও ইউনাইটেড গ্রুপকে তাদের নির্ধারিত দরে বিক্রি করতে দিচ্ছে বিভিন্ন কোম্পানির কাছে।

বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনে দুই ধরণের বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র বিদ্যমান। একটি হচ্ছে আইপিপি, আরেকটি হচ্ছে ক্যাপটিভ। আইপিপি ক্যাটাগরিতে থাকা বিদ্যুৎ কেন্দ্র সরকারের চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করে সরকারের কাছে দেবে। তার বাইরে বিক্রি করার কোন ‍সুযোগ নেই। আবার ক্যাপটিভকে কমার্শিয়াল ক্যাটাগরি বলা হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে নিজস্ব কারখানায় ব্যবহারের পর উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ শর্তসাপেক্ষে বাইরে বিক্রি করার সীমিত সুযোগ রয়েছে। সেখানেও দর নির্ধারণের এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে বিইআরসিকে দেওয়া হয়েছে আইনে।

অথচ ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ঢাকা ইপিজেড এলাকায় ৮৬ মেগাওয়াট ও চট্টগ্রাম ইপিজেডে অবস্থিত ৭২ মেগাওয়াট গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কোন রকম আইন মানা হয়নি। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি যেহেতু সরকারের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করে না তাই ক্যাপটিভ বিবেচনায় গ্যাসের দাম ঘনমিটার প্রতি ৩০ টাকা নির্ধারণ করে বিইআরসি। একই সময়ে আইপিপির (ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) জন্য গ্যাসের দর ছিল ১৬ টাকা।

ইউনাটেড গ্রুপ ১৬ টাকায় গ্যাস পেতে তদবির শুরু করে, এই নিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগ ও বিইআরসির মধ্যে চিঠি চালাচালি শুরু হয়। বিইআরসির তৎকালীন চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল সাফ জানিয়ে দেন, আইন কোন ভাবেই আইপিপি হিসেবে কভার করে না। তাই ক্যাপটিভের দরেই তাদের গ্যাসের মূল্য দিতে হবে। বিদ্যুৎ বিভাগের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করেই আদেশ বহাল রাখে রেগুলেটরি কমিশন। কথিত রয়েছে নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে রেগুলেটরি কমিশনের দ্বন্দ্বের সূত্রপাতও এখান থেকেই। যার রেশ ধরে বিইআরসির হাত থেকে গ্যাস ও বিদ্যুতের দর নির্ধারণের প্রক্রিয়া ছিনিয়ে নেয় নির্বাহী বিভাগ। দফায় দফায় গ্যাস ও বিদ্যুতের দামও বাড়িয়ে দেয় মন্ত্রণালয়।

বিইআরসির তৎকালীন সদস্য (গ্যাস) মকবুল ই-এলাহী চৌধুরী বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, আমার কাছে বিষয়টি অষ্টম আশ্চর্য মনে হয়। কিভাবে তারা আইপিপির দর পেলো বুঝতে পারি না। তারা বিইআরসিতে এলে আমরা নাকচ করে দেই, পরে রিভিউয়ের আবেদন করে সেখানেও নাকচ হয়ে যায়। আমি যতদূর জানি হাইকোর্টও তাদের নাকচ করে দিয়েছে।

এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, তাদের প্রকল্পের শুরুই হয়েছে ক্যাপটিভ হিসেবে। আইপিপি হওয়ার কোন সুযোগ দেখি না। ইউনাইটেডের পক্ষে চাপ দিতে একজন লোক এসেছিল। আমরা তাকে স্রেফ জানিয়ে দেই ভবিষ্যতে যেনো আর কখনও নাক না গলান।

বিইআরসির তৎকালীন চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল বার্তা২৪.কমকে বলেন, আইনগতভাবে বিষয়টি আইপিপি হওয়ার কোন সুযোগ নেই। আমরা সেই রায় দিয়েছিলাম। পরে কি হয়েছে আমার জানা নেই।

বিইআরসিতে হেরে গিয়ে কোর্টের দ্বারস্থ হয় সরকারের ঘনিষ্ঠ ইউনাইটেড গ্রুপ। সেখানেও হেরে যায় তারা। তারপরও দামাবার পাত্র নন গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মঈনুদ্দীন হাসান রশীদ। মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে চিঠি বের করে আনেন।

বিদ্যুৎ বিভাগের উপসচিব সাইফুল আজাদ স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, “ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সানুগ্রহ অুনমোদনের প্রেক্ষিতে ফেব্রুয়ারি ২০২৩ মাস হতে ক্যাপটিভ শ্রেণিতে ৩০ টাকা (ঘনমিটার) হিসেবে গ্যাস ক্রয় করে তাদ্বারা বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ইউপিজিডি ক্ষতির সস্মুখীন হওয়ায় সংশ্লিষ্ট আইন, বিধি, নীতিমালা, প্রবিধানমালা, নিয়মাবলী এবং গ্যাসের সরবরাহের প্রকৃতি/ব্যবহারের ধরণ বিবেচনায় ফেব্রুয়ারি-২০২৩ মাস হতে কার্যকর করত ইউপিজিডি এর ঢাকা চট্টগ্রাম ইপিজেডে স্থাপিত দু’টি বিদ্যুৎকেন্দ্র আইপিপি হিসেবে লাইসেন্স প্রদানের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে”।

চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, বর্ণিত সিদ্ধান্তের আলোকে আইপিপি গ্যাস শ্রেণির জন্য বিদ্যুৎ ট্যারিফ নির্ধারণে বিইআরসিকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করতে নির্দেশক্রমে এ বিভাগের মতামত জানানো হলো। চলতি বছরের ২৫ মার্চ তারিখে ইস্যু করা ওই চিঠিতে আইপিপি শ্রেণির গ্যাসের দাম নির্ধারণের জন্য বলা হয়।

ক্যাবের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. শামসুল আলম বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী কি আইনের ঊর্ধ্বে, তিনি নির্দেশ দিলেই অনুমোদন দেওয়া যাবে? এটা দেওয়ার এখতিয়ার প্রধানমন্ত্রীর ছিল না। এই লাইসেন্স রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী। রাষ্ট্রের সংবিধান আইন ও নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বেসরকারি কোন কোম্পানিকে ডিস্ট্রিবিউশন লাইসেন্স দেওয়ার এখতিয়ার নেই। কিন্তু ইউনাইটেড গ্রুপ ডিস্ট্রিবিউশন করছে।

গ্যাসের দর প্রসঙ্গে বলেন, তারাতো ক্যাপটিভ শ্রেণির, তাদেরকে আইপিপির রেটে গ্যাস দেওয়ার কোন সুযোগ নেই।

ইউনাইটেড গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর মঈনুদ্দীন হাসান রশীদ বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমরা পিডিবিকে যখন দিচ্ছি সেটুকু আইপিপি দরে, আর বেপজাকে যখন দিচ্ছি ক্যাপটিভ দরে।

তার কাছে প্রশ্ন ছিল, বিইআরসি নাকচ করে দেওয়া, হাইকোট ও সুপ্রিম কোর্ট নাকচ করে দেওয়ার বিষয়টি কতটা সঠিক। এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমাদের সংশ্লিষ্ট বিভাগ বিষয়টি ভালো বলতে পারবে। এরপর আইনগতভাবে বিদ্যুতের দর নির্ধারণ করার এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন করলে, নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণে বক্তব্য ভেঙে আসছিল, পরে লাইন কেটে যায়। আরেকবার ফোন দিলে ইউনাইটেড গ্রুপ চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিসিভ করেন নি।

বিইআরসি আইনের ২৭ ধারায় ৫ ধরনের লাইসেন্সের কথা বলা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে, বিদ্যুৎ উৎপাদন, এনার্জি সঞ্চালন, এনার্জি বিপণন ও বিতরণ, এনার্জি সরবরাহ এবং এনার্জি মজুদকরণ। এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, বিপিডিবি, আরইবি, ডিপিডিসি, ডেসকো, নেসকো এবং ওজোপাডিকো ছাড়া কাউকে বিদ্যুৎ বিতরণের লাইসেন্স দেওয়া হয় নি। অথচ লাইসেন্স ছাড়াই ইউনাইটেড গ্রুপ ইপিজেডে থাকা বিভিন্ন কারখানার কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করছে। এ বিষয়টিও বিইআরসি আইনে পরিপন্থী। ভোক্তা পর‌্যায়ে বিইআরসি ছাড়া কোন প্রতিষ্ঠানের বিদ্যুতের দর নির্ধারণ করার এখতিয়ার নেই। আইনে না থাকলেও সবার নাকের ডগায় চলেছে এসব অপকর্ম। কোথাও হুমকি, কোথাও উৎকোচ, কোথাও সরকারের প্রভাব দেখিয়ে হাজার কোটি টাকা মুনাফা লুটছে ইউনাইটেড গ্রুপ। অন্যান্য কোম্পানি যখন ৩০.৭৫ টাকা ঘনমিটারে গ্যাস কিনছে ইউনাইটেড গ্রুপ বিল দিচ্ছে ১৬.৭৫ টাকা দরে। বিগত সরকারের সময়ে কোম্পানিটির একজন কর্মকর্তাকে সার্বক্ষণিক সচিবালয়ে ঘুর ঘুর করতে দেখা যেতো।

২০১৮ সালের ২ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত মন্ত্রণালয়ের সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে, ইউপিজিডিসিএলের জন্য ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের গ্যাসের দর নির্ধারণ করা হয়। আবার গ্যাসের দর বেড়ে যাওয়ায় সেই বিদ্যুৎ বিভাগ তাকে আইপিপি বানিয়ে দেয় রহস্যজনক কারণে।

২০২৩ সালের জানুয়ারিতে বিদ্যুৎ, শিল্প ও বাণিজ্যিক খাতে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়। তখন বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ৫ টাকা ২ পয়সা ইউনিট থেকে বাড়িয়ে ১৪ টাকা করা হয়। শিল্প খাতের গ্রাহকের ব্যবহৃত ক্যাপটিভ বিদ্যুতের দাম করা হয় ইউনিটপ্রতি ৩০ টাকা। পরে মাসে প্রত্যেক ধাপে ৭৫ পয়সা করে দর বাড়ানো হয়।