অর্থনৈতিক কুটনীতি জোরদারের তাগিদ ড. মোস্তাফিজের

  • আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

নতুন অন্তবর্তী সরকারকে অর্থনৈতিক কুটনীতিকে আরও জোরদারের তাগিদ দিয়েছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি খাতের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান।

তিনি মনে করেন, গেল দু’বছরের নাজুক অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যেই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতার পালাবদলে দেশের বর্তমানে অর্থনীতি বেশ সংকটে রয়েছে। এই সংকট থেকে উত্তরণে এ সরকারকে তাদের কুটনীতিকে মুখ্যত অর্থনৈতিক কুটনীতি হিসেবে বিবেচনা করে সেইভাবেই নীতিকৌশল বাস্তবায়ন করতে হবে।

বিজ্ঞাপন

বার্তা২৪.কম-কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ এসব কথা বলেন।

নাতিদীর্ঘ আলাপচারিতায় তিনি কথা বলেছেন দেশের স্বল্প ও মধ্যমেয়াদী সংকট এবং উত্তরণের উপায়, অভ্যন্তরীন সম্পদ আহরণ, রেমিটেন্স, জনশক্তি রপ্তানি, বৈদেশিক ঋণসহ নানা প্রসঙ্গে।

অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে কথা বলেছেন পরিকল্পনা সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম

বার্তা২৪.কম: বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীন অর্থনৈতিক সংকটের মাঝেই বাংলাদেশে শাসন ক্ষমতার পালাবদলে নতুন অন্তবর্তী সরকার এল। সন্দেহ নেই যে বর্তমানে দেশের অর্থনীতি আরও সংকটের আবর্তে। এ থেকে উত্তরণে কি করণীয়?

অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান: অর্থনীতি তো গত দুই বছর ধরেই বিভিন্ন চাপের মধ্যে আছে। সুতরাং এটা নতুন কিছু না। বলা যায়, একটা ধারাবাহিক চাপের মধ্যেই আছে দেশের অর্থনীতি। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভের উপরে চাপ, বাজারব্যবস্থা থেকে শুরু করে বিনিয়োগের উপর নেতিবাচক প্রভাব ক্রমান্নয়ে পূঞ্জীভূত হচ্ছিল। অবশ্যই গত কয়েক সপ্তাহে ছাত্র-গণআন্দোলন চলছিল, সেটা নিঃসন্দেহে অর্থনীতির উপরেও চাপ সৃষ্টি হয়েছে। এখন আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। বিভিন্ন খাতে আমাদের যে সমস্যা পূঞ্জীভূত হয়ে আছে, তারমধ্যে ব্যাংকিং সেক্টর, অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় আহরণ, বাজারব্যবস্থাপনা; সামগ্রিকভাবে আমাদের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দুর্বলতা-ব্যত্যয়, বিভিন্ন অব্যবস্থাপনা এবং এসব ক্ষেত্রে সংস্কারের দাবিকে অবহেলা- সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হলে এগুলোই মোকাবেলা করে যেতে হবে।

আমি মনেকরি যে, চলমান এই সংকটে বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টর যে বড় ভূমিকা রাখবে সেখানে সংস্কার দরকার, যাতে করে আমরা এই সেক্টরে যে ধরণের অব্যবস্থাপনা দেখেছি, খেলাপী ঋণ-কুঋণ যেভাবে বেড়েছে; যেভাবে সুনির্দিষ্ট গ্রুপগুলোকে সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে, যার ফলে ব্যাংকিং সেক্টরের অবস্থা বেশ দুর্বল হয়ে গেছে। এসব জায়গাগুলোতে আমাদের সংস্কার আনতেই হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে। সেখানে কেবল মুদ্রানীতিই নয়, রাজস্ব নীতির মধ্যে সামঞ্জস্যবিধান, বাজার ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালী করা, মধ্যসত্ত্বভোগীদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসা এবং তথ্য-উপাত্তের বিভ্রান্তি কাটিয়ে সঠিক তথ্য প্রদান নিশ্চিত করা-যাতে নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সহজ হয়-এসব দিকগুলোতে আমাদের জরুরি নজর দিতে হবে। কতটুকু আমদানি, কতটুকু উৎপাদন ও সরবরাহ, চাহিদা কতটুকু-তার ভিত্তিতে বাজার ব্যবস্থাপনা, আমদানি এবং স্টক থেকে রিলিজ করা-এগুলোর দিকেও আমাদের নজর দিয়ে গেল দু’বছরের অর্থনৈতিক সংকটকে সামাল দিতে হবে। সরবরাহ চেইনে যেসব বিচ্যুতি ছিল-সেগুলো কাটিয়ে উঠতে হবে। বিভিন্ন ধরণের চাঁদাবাজি এবং যেসব নেতিবাচক প্রবণতা ছিল সেগুলোকে শক্ত হাতে দমন করতে হবে। এসবই তাৎক্ষণিক পদক্ষেপের মধ্যে পড়েব।

বার্তা২৪.কম: মধ্যমেয়াদী কি কি পদক্ষেপ থাকতে পারে?

অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান: সামনের দিনগুলিতে ঋণ উপস্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, যাতে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমরা কোন ঋণ ফাঁদে না পড়ি। আমাদের রূপকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে যেন আমরা সাশ্রয়ীভাবে সুশাসনের সঙ্গে সময়মত প্রকল্পগুলো শেষ করতে পারি, সেই বিষয়ে আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে। এখানে তাৎক্ষণিক ও মধ্যমেয়াদী বিষয়ও আছে।

বার্তা২৪.কম: বিগত সরকারের সময়ে বিশে^র অনেক গুরুত্বপূর্ণ দেশের সঙ্গেই বাস্তবায়নাধীন বিভিন্ন প্রকল্পে আমাদের অংশীদারিত্ব রয়েছে। অংশীদারিত্ব আছে অনেক বিশ^সংস্থার সঙ্গেও। সরকার পরিবর্তনে সেইসব প্রকল্প বা বিনিয়োগে কি পরিণতি হতে পারে?

অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান: আমার মনে হয়, আমাদের যেসব দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক সম্পর্ক আছে-যেগুলোর ভিত্তিতে আমরা ঋণ নিয়েছি। অনেক দেশের অর্থায়নেই আমাদের প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। চীন, ভারত, জাপানসহ অনেক দেশ এবং বিশ^ব্যাংক, এডিবির অর্থায়ন আছে। আমার মনে হয়-সামনের দিকে এগিয়ে নিতে গেলে এগুলো আমাদের অব্যাহত রাখতে হবে। তবে এক্ষেত্রে কোন জায়গায় যদি আমাদের নতুন করে বিচার-বিবেচনার দরকার হয়, যেমন-ঋণ কি শর্তে নিয়েছি, শর্তগুলো কি-এগুলো পর্যালোচনা করা দরকার। সেখানে যদি কোনোটি আবার রিনেগোশিয়েট করার সুযোগ থাকে, সেটাও আমাদের করতে হবে। কিন্তু আমাদের বৈশি^ক ও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক যাদের সঙ্গে, আমাদের অর্থনীতির অগ্রাধিকারগুলোকে বিবেচনায় রেখে এই সম্পর্ককে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হবে। এটি-ই আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি হওয়া উচিত।

বার্তা২৪.কম: চলমান প্রকল্পগুলো শেষ করে আনতে কিংবা ঋণের অর্থ ছাড়ে কোন ঝুঁকি দেখছেন কি?

অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান: যেসব চুক্তিগুলো বাস্তবায়িত হয়েছে, সেসব চুক্তির অধীনে যে অর্থায়ন হওয়ার কথা-মনে হয় না সেগুলো ঝুঁকিতে থাকবে। তবে সামনে আমরা যা নেগোশিয়েট করব বা যেগুলো পাইপলাইনে আছে সেটার ক্ষেত্রে আমাদেরকে অগ্রাধিকার পুনঃনির্ধারণ করা, কোনটা আমাদের অর্থনীতির জন্য কাজে লাগবে-সামনের দিনে সেগুলো অবশ্যই পুনর্বিবেচনা করা দরকার। কারণ সব ঋণই আমাদের পরিশোধ করতে হবে। ঋণ পরিশোধের দায়ভার ক্রমান্নয়ে বাড়ছে। সেকারণে পুনর্বিবেচনা জরুরি। কিন্তু চলমান যে প্রকল্পগুলো আছে সেগুলোতে বড় ধরণের কোন ঝুঁকি দেখছি না। আবারও বলছি, সামনে দিকে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রাধিকারগুলো আমাদেরই পুনঃনির্ধারণ করতে হবে। আমাদেরই ঠিক করতে হবে কোনটা নেব, কোনটা নেব না। কোনটা আমরা কখন নেব, কোন শর্তে নেব-সেগুলো।

বার্তা২৪.কম: অন্তবর্তী সরকারের অর্থনৈতিক কুটনীতি কেমন হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?

অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান: আমার মনেহয়, অর্থনৈতিক কুটনীতির ক্ষেত্রে অবশ্যই আমাদের অর্থনৈতিক স্বার্থটা অগ্রাধিকার দিতে হবে। কুটনৈতিক দিক থেকে যদি বলি, আমাদের বাণিজ্য সম্পর্ক, সেবা খাতে রেমিটেন্সের সম্পর্ক-সেইসব দিকে থেকে বৈদেশিক সহায়তার দিকগুলো তো আছেই...আমাদের অর্থনীতির জন্য যেসব প্রকল্পগুলো ভালো সেটাকে অগ্রাধিকার দিয়ে আমাদের ঋণসহ অন্যান্য বিষয়গুলো রিনেগোশিয়েট করতে হবে। আমাদের এলডিসি গ্রাজুয়েশন সামনে আসছে। যেসব দেশে আমরা শুল্কমুক্ত প্রবেশাদিকার আরও সম্প্রসারিতভাবে পেতে পারি, সেসব দেশের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। ইউরোপিয় ইউনিয়ন ও ইউকে তো আগেই বলেছে, তারা ২০২৯ সাল পর্যন্ত দেবে। জাপান, কানাডা, চীন, ভারতসহ আরও যেসব দেশ রয়েছে সেখানেও আরও কিছু সময় আমরা কিভাবে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পেতে পারি তা নিয়ে আমাদের পরিকল্পনা করতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের যে ট্রাডিশনাল ভালো সম্পর্ক-সেখানে যাতে আমরা জনশক্তি রপ্তানি বাড়াতে পারি; সেইসঙ্গে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলো থেকে আমাদের শ্রমিক ভাইদের পাঠানোর ক্ষেত্রে যাতে আরও এগ্রেসিভলি নেগোশিয়েট করতে পারি, শ্রমিকদের স্বার্থ যাতে সংরক্ষিত থাকে সেজন্য দেশগুলোর সঙ্গে ভালোভাবে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। রেমিটেন্সটা যাতে দেশে আসে, হুন্ডির মাধ্যমে অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে যাতে চলে না যায়, এসব ব্যাপারগুলোতে আমরা সেসব দেশের সরকারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলাপ-আলোচনা করে নিশ্চিত করতে পারি। মনে রাখতে হবে, কুটনীতিটা এখন অর্থনৈতিক কুটনীতি। সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই আমাদের নীতিমালা বা নীতিকৌশল বিবেচনায় নিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।