তৃতীয় লিঙ্গের উদ্যোক্তারাই চালাচ্ছেন যে পোশাক কারখানা

  • স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

এক সময় রাস্তা-ঘাটে লোকজনের কাছ থেকে চাঁদা তুলে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করতেন। এখন পোশাক কারখানায় কাজ করে আত্মনির্ভরশীল হতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন সবাই। এ কারখানার মালিক থেকে সব কর্মীই তৃতীয় লিঙ্গের। ২০১৫ সালে রাজধানীর আজমপুরে 'উত্তরণ ফ্যাশন এন্ড স্বপ্ন টেইলার্স' নামে এ পোশাক কারখানাটি গড়ে ওঠেছে।

মাত্র ১২টি সেলাই মেশিন দিয়ে কাপড় বানানোর কাজ শুরু করেন কারখানাটির পরিচালক গুরু মা আপন আক্তার। এখন পঁচিশটি মেশিন দিয়ে নিজের পুরো দল দিয়ে পোশাক কারখানাটি পরিচালনা করছেন তিনি। তাদের সহায়তা করেন ঢাকার একজন পুলিশ কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান।

বিজ্ঞাপন

গুরু মা আপন আক্তার বিবিসি বাংলার একটি ভিডিও সাক্ষাৎকারে বলেন, আমাদের ফ্যাক্টরিতে পঁচিশটি মেশিন আছে। শুরুতে ১২টা মেশিন দিয়ে আমরা কাজ শুরু করেছিলাম। আমরা সিজন অনুযায়ী কাজ করি, যেমন স্কুল ইউনিফর্ম, শার্ট-প্যান্ট, রোজা-বৈশাখের কাপড়।

আপন আক্তার বলেন, আমরা বাইরে কাজ করলে প্রত্যেক দিনের ভাগটা প্রত্যেক দিন পেতাম। সে হিসেবে আমি চিন্তা করেছি- যারা প্রত্যেক দিন টাকা পেয়ে অভ্যস্ত তাদের প্রত্যেক দিন টাকা দেওয়া দরকার। তাহলে তাদের মনে কোনো কষ্ট থাকবে না। এজন্য আমার নিজের বুদ্ধিতে এই প্ল্যানটা করেছি। এখন ওরা একটা থ্রি-পিস তৈরি করে দিলে ১০০-১২০ টাকা পায়। একটা শার্ট তৈরি করলে ১০০ টাকা, একটা পাঞ্জাবি তৈরি করলে ১২০ টাকা।

২০১৯ সালে এক বছরে প্রায় আটাশ লাখ টাকা লাভ করেন পোশাক কারখানা ব্যবসা থেকে। তবে করোনা মহামারির প্রভাব অন্যান্য ব্যবসার মতো তাদের উপরেও পড়েছে, ফলে পুরনো পেশা চাঁদা তোলায় ফিরতে বাধ্য হচ্ছেন মাঝে মধ্যে।

আপন আক্তার বলেন, ২০২০ সালেও ভালো টাকা আয় করেছি কিন্তু এই ২০২১ সালে এসে ধরা খেয়ে গেলাম।

শুরুতে কাজের অর্ডার পাওয় খুব একটা সহজ ছিলো না। আপন আক্তার বলেন, প্রথম দিকে আমাদের নারী ও পুরুষ যে মাস্টার ছিলেন তাদের দিয়ে মাপজোক করা হতো। কারণ মানুষের মাঝে হিজড়াদের নিয়ে একটা আতঙ্ক ছিল। বাচ্চারা ভয় পেতো, গার্ডিয়ানরা ভয় পেতো। কিন্তু আল্লাহর রহমতে আমি আমার যোগ্যতায় তাদেরকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছি। তাদের সাথে মিশে গেছি। এখন দেখা যাচ্ছে দোকান যদি বন্ধ থাকে আমাদেরকে ফোন করে।

তৃতীয় লিঙ্গের এসব মানুষ মূলধারা থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্নভাবে বাস করেন। নিজের পরিবার ছেড়ে তৃতীয় লিঙ্গের গোত্রভুক্ত হয়ে থাকতে হয় তাদের। অনেকে বিয়ে করলেও তাদের স্বামীর বাড়িতে থাকতে পারেন না।

উত্তরণ ফ্যাশনের সহকারী অপারেটর মুন জান্নাত নোলক বলেন, যখন শোনে একটা হিজড়ার সাথে সম্পর্ক গড়েছে তাকে সবাই অন্যভাবে দেখে। একটা মানুষ নারী সাথে সম্পর্ক করবে, কেন হিজড়ার সাথে সম্পর্কে যাবে। অনেক সময় পরিবার মেনে নিলেও, সমাজ তো আর মেনে নেয় না, সমাজ তো স্বীকৃতি দেয়নি আমাদের।

উত্তরণ ফ্যাশনের কাটিং মাস্টার ভাবনা আক্তার জেলি বলেন, আমার বাবা মারা গেছে আমি দেখতে পারিনি, আমি জানতাম না, মারা যাবার পাঁচদিন পর শুনেছি। আমি যখন জিজ্ঞেজ করলাম যে আমাকে জানানো হয়নি কেন? বলে ফোন নম্বর ছিলো না- হয়তোবা ইচ্ছে করেই জানায়নি।

আপন আক্তার বলেন, আমি সবার কথা জানি না। তবে আমার এখানে পরিবর্তন এসেছে। আমার এলাকার অনেকে আমাকে সমর্থন দিচ্ছে।

শুরু থেকে লাভজনক হলেও উত্তরণ ফ্যাশনেও মহামারির প্রভাব পড়েছে। ফলে আগের মতো আবারও চাঁদা তুলে জীবিকা নির্বাহ করতে হচ্ছে তাদের।

সম্প্রতি সরকার বাজেটে তৃতীয় লিঙ্গের কর্মচারী নিয়োগ দিলে কর ছাড় দেবার প্রস্তাব দিয়েছে। তবে তৃতীয় লিঙ্গের এসব মানুষেরও কাজ করে উপার্জনের প্রতি আগ্রহ থাকতে হবে বলে মনে করেন আপন আক্তার।

আপন আক্তার বলেন, আসলে কী, কাজ করার মজাটাই আলাদা। নিজের পরিশ্রমে খাওয়া, নিজের ওপর নির্ভরশীল হওয়া এটা যে কত সুন্দর জিনিস যে করবে সেই বুঝবে, যে করবে না সে বুঝবে না।

সরকারি পরিসংখ্যানে দেশে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের সংখ্যা দশ হাজার। তবে বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠনের হিসাবে দেশে হিজাড়ার সংখ্যা তিন লাখের বেশি।