সিয়াম সাধনা আর করোনায় ঈদ আনন্দ!

  • আনিস আলমগীর
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

 সিয়াম বা রোজা পালন ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের অবশ্যই পালনীয় কাজগুলোর মধ্যে একটি। তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় ৩০ দিন সিয়াম সাধনার পর পবিত্র ঈদুল ফিতর পালন করে। যে আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় মুসলমানরা রোজা পালন করে, সেই আল্লাহ সম্পর্কে ধারণা এসেছে কিন্তু ইসলাম ধর্ম আবির্ভাবের আগে। মুসলমান ধর্মের আগেও বিশ্ববাসীর কাছে আল্লাহর ধারণা উপস্থিত ছিল। চীনে কনফুসীয় ধর্মবাদীরা, ভারতের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা, ইউরোপে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা- যে নামেই ডাকা হোক, সবার কাছে সৃষ্টিকর্তা একজন ছিলেন। প্রশ্ন আসতে পারে তাহলে নতুন আরেকটি ধর্ম ইসলামের আবির্ভাব হয়েছিল কেন?

এই প্রসঙ্গে ইসলাম ধর্মাবলস্বীদের বক্তব্য হচ্ছে, মানুষ তার স্রষ্টাকে ছেড়ে অন্য কিছুর এবাদত, পূজা-অর্চনা করত বলে স্রষ্টার এবাদতের শুদ্ধতম রাস্তার নির্দেশনার জন্য নতুন ধর্মের আবির্ভাব হয়েছে। ইসলাম ধর্ম স্রষ্টাকে ছেড়ে অন্য কিছুর পূজা-অর্চনা বা এবাদতের নাম দিয়েছে শিরক। এই ধর্ম মতে শিরক নিকৃষ্টতম পাপ। শিরক বিতাড়িত করে প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা ছিল ইসলাম ধর্মের একমাত্র লক্ষ্য। আল্লাহ সর্বশেষ এই দায়িত্বভার প্রদান করেছেন মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে। তিনি মক্কার সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশে ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

বিজ্ঞাপন

আবার ইসলামে বিশ্বাসীদের এটাও বিশ্বাস করতে হবে যে, বিশ্বে প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে হযরত মুহাম্মদ (সা.) একমাত্র মনোনীত ব্যক্তি নন। তাঁর আগে আরও বহু মনোনীত ব্যক্তি ছিলেন। একবার হযরত মুহাম্মদ (সা.) তার অন্যতম প্রধান সাহাবা হযরত আবু যর গিফারির অনুসন্ধানের উত্তরে বলেছিলেন, প্রথম মানব হযরত আদম (আ.) নবী ছিলেন। আল্লাহর মনোনীত তিনিসহ সর্বমোট এক লাখ ২৪ হাজার ব্যক্তি বিশ্বে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য পরিশ্রম করেছিলেন। এইসব সম্মানিত ব্যক্তিদের নবী-রাসুল বলা হয়। এক লাখ ২৪ হাজারের মধ্যে ৩১৫ জন ছিলেন রাসুল আর অবশিষ্টরা ছিলেন নবী। মানে এক লাখ ২৪ হাজারের সবাই নবী ছিলেন আর তাদের মধ্যে রাসুল ছিলেন মাত্র ৩১৫ জন। (তথ্যসূত্র: রাসুলে রহমত (সা.) লেখক, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, প্রকাশনী: ইসলামিক ফাউন্ডেশন)।

আবার ৩১৫ জন রাসুলের মধ্যে চারজন মূখ্য বা প্রধান ছিলেন। হযরত মুসা (আ.), হযরত দাউদ (আ.), হযরত ঈসা (আ.) এবং সর্বশেষ হযরত মুহাম্মদ (সা.)। এই চারজনকে আল্লাহতালা চারটি প্রধান আসমানি কিতাব প্রদান করেছেন। হযরত মুসাকে (আ.), হযরত দাউদকে (আ.) যাবুর, হযরত ঈসাকে (আ.) ইঞ্জিল আর হযরত মুহাম্মদকে (সা.) কোরআন গ্রন্থ প্রদান করেছেন। আসমানি কিতাব বা ঐশী গ্রন্থ বলতে এমন কতকগুলো গ্রন্থকে বোঝানো হয়, ইসলাম ধর্মমতে এই গ্রন্থগুলো আল্লাহ প্রদত্ত গ্রন্থ। ইসলাম ধর্মে যে সাতটি বিষয়ের ওপর বিশেষ করে ঈমান আনতে বা বিশ্বাস স্থাপন করতে বলা হয়েছে, তার মধ্যে একটি বিষয় হলো এ আসমানি কিতাব।

বিজ্ঞাপন

ইসলাম ধর্মের মূল কর্তব্য চারটি- নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত। আমরা গত এক মাস ধরে রোজা পালন করছি। হযরত মুহাম্মদ (সা.) আরবের লোক ছিলেন। আরবরা চন্দ্রের হিসাব অনুসারে মাস গণনা করে। এই জন্য রোজা কখনো ২৯টি হয় কখনো ৩০টি। তবে কখনো ৩১টি হয় না। কারণ চন্দ্রমাস কখনো ৩১ দিনের হয় না।

হিজরী দ্বিতীয় সালে সিয়ামের বিধান দেওয়া হয়েছিল। সে থেকে রমজান মাসে রোজা বা সিয়াম ফরজ হয়েছে। সিয়াম অর্থ উপবাস নয়, সিয়াম অর্থ সাধনা। মাওলানা রুমী বলেছেন, যে জিনিসটি তোমাকে আল্লাহর ভালোবাসা থেকে দূরে সরিয়ে নেয়, তার নাম দুনিয়া। তুমি ১১ মাস দুনিয়াদারি করেছ, সিয়ামের এক মাস তুমি সাধনা করে তোমার মূল গন্তব্যে ফিরে এসো। সিয়ায়ের মূল শিক্ষা কি? প্রেম, ধৈর্য ও সেবা। উপোস করেছি কিসের জন্য, কার জন্য? শুধু তাই নয়, পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ স্পর্শের মোহনীয় আকর্ষণ থেকে বিরত রয়েছি কিসের জন্য? এসবই একমাত্র স্রষ্টার প্রেমে।

আমরা গত একমাত্র সিয়াম সাধনা করেছি সত্য, কিন্তু কতটুকু নিজেকে আল্লাহর প্রেমে নিমজ্জিত রাখতে পেরেছি, তা জানি না। মানুষের ত্রুটিরতো সীমা নেই। আল্লাহ যদি ক্ষমা করেন। সিয়াম সাধনার শেষ দিনের পরের দিন যখন ঈদ আসে তখন আনন্দের আর সীমা থাকে না। কারণ আমরা সিয়াম সাধনার রাহে পথিক ছিলাম। যতই সিয়াম সাধনায় ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকুক না কেন ধৈর্যের সঙ্গে সিয়াম সাধনার পর আনন্দ করার নামই ঈদ।

যারা রোজদার, তারাই পরিপূর্ণ ঈদ আনন্দ উপভোগ করেন। ধর্মবাদীদের কাছে এক অপার আনন্দ। এই আনন্দে পবিত্রতা আছে। অমনোযোগীরা এই আনন্দ থেকে বঞ্চিত। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে এবারের ঈদ কারো জীবনে ব্যাপক আনন্দ উপভোগ করার জন্য আসেনি। কারণ মেলামেশা, কোলাকুলি যেখানে বারণ, সেখানে ঈদ আনন্দের কী থাকে! প্রায় তিন মাস ধরে মানুষ তালাবন্দী হয়ে আছে। স্থবির হয়ে আছে অর্থনীতি।


ঈদ অর্থ আনন্দ হলেও তাই এই ঈদ মোটেও আনন্দের না। আমরা জানি না আগামী দিন বাঁচব কি না। ঘুম থেকে জেগে শুনতে হয়, এর মধ্যে কে কে চলে গেলেন পরপারে। প্রতিদিন মানুষ মরছে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে, প্রতিদিন ধরা পড়ছে কোভিড-১৯ পজেটিভ রোগী। এর মধ্যে এসেছে দক্ষিণ বাংলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে ঘূর্ণিঝড় আম্পান। ঝড় বয়ে যাওয়ায় ১০-১২টি জেলার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেশি। বোরো ধানের ওপর ভরসা ছিল। ভালোয় ভালোয় বোরোটা পরিপূর্ণভাবে উঠে গেলে হয়তো আমনে আউশে মিলে খাদ্যের অভাব হতো না। এখন ১০-১২টি জেলায় বোরো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমন-আউশের প্রতি মনোযোগী হতে হবে। আমন-আউশ যদি কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে না পড়লে খাদ্যের টান পড়ার কথা নয়। সরকার প্রচুর টাকা বিলিয়েছে, সাধারণ মানুষের হাতে টাকা পৌঁছিয়েছে। বাজার খোলা থাকলে টাকার প্রবাহ বোঝা যেত।

তারপরও বলব, জীবনকে এগিয়ে নিতে হবে। জীবন থেমে থাকে না, সময় থেমে থাকে না। সময়ই আমাদের এই উদ্বিগ্নতা কবে নিরসন হবে তার জবাব দিতে পারে। যেই ঈদে ভাবছেন কোনও আনন্দ পেলেন না, পরলেন না কোনো নতুন জামা, দেখা হলো না আত্মীয়-বন্ধু-বান্ধব প্রিয়জনের সঙ্গে- সেই ঈদে এটা ভেবে খুশি থাকেন যে- ‘বেঁচে আছি, এটাই এই ঈদের বড় আনন্দ!’

সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা!


আনিস আলমগীর: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।