বেকারদের চলমান জীবনযাত্রা এবং আগামীর সম্ভাবনা

  • ড. সুলতান মাহমুদ রানা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

আমরা এক ভয়াবহ সময়ে বসবাস করছি। এই ভয়াবহতা কেন এবং কীভাবে সেটি আর নতুন করে ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। চলমান দুর্যোগের এই অধ্যায় যদি শেষ হয়েও যায়, এর রেশ থেকে যাবে বহুদিন। বলা যেতে পারে, এই সময়ে এসে আমরা একটা পরীক্ষা দিচ্ছি, এর ফলাফলের ওপর নির্ভর করবে আমাদের ভবিষ্যৎ। নিরাপদ একটি পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য আমাদেরকে শক্ত প্রস্তুতি নিতে হবে।

যেদিকে তাকানো যায় সেদিকেই এখন সংকট। এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, সেখানে সংকটের ছোঁয়া লাগেনি এই করোনাকালে। আমি আজকে একটি বিশেষ শ্রেণিকে মাথায় রেখে লেখাটি শুরু করলাম।

বিজ্ঞাপন

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি বিধায় শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার, কর্মসংস্থান প্রাসঙ্গিকভাবে আমাদের ভাবতে হয়। প্রতি বছর নবীন শিক্ষার্থীরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিতে পা দেয় তখন থেকেই তাদের জীবন সাঁজাতে কী করণীয় সেগুলো নিয়ে কথা বলতেই হয়। তাদেরকে আমরা আত্মবিশ্বাসী করে তুলতে যা যা করণীয় তাই করার চেষ্টা করি। তাদের স্বপ্নকে আরো পোক্ত করে তুলতে কাজ করে থাকি অনবরত। যেসব শিক্ষার্থী পাস করে চলে যায়, তাদের মধ্যে কে কেমনভাবে নিজের জীবনকে সাঁজাতে সফলতা লাভ করে তা নবীনদের জন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করি। করোনাকালে এসেও এখন আমাদের সেই ভাবনা থেমে থাকার কথা নয়।

দেশের বিরাট একটি অংশ বেকার। যাদের জীবন সবসময়ই নানা দুঃখ-কষ্টে ভরা। তারা কেমন আছে, তাদের আগামীর সম্ভাবনা কী এবং কেমন- সেসব ভাবনার সামান্য সংযোজন হিসেবে এই লেখাটি প্রস্তুত করছি।

বিজ্ঞাপন

কয়েকদিন থেকেই বেশ কিছু পাস করে যাওয়া বেকার শিক্ষার্থীর সাথে আমার কথা হচ্ছে। তারা কীভাবে জীবন অতিবাহিত করছে, তাদের আগামীর সম্ভাবনাটা কেমন। কোথায় গিয়ে তাদের সম্ভাবনাগুলো হোঁচট খেতে শুরু করেছে, সেগুলো নিয়ে কথা বলতে গিয়েই এই লেখাটা লেখার জোর তাগিত অনুভব করছি। দু’একজন মুখ ফুটে বলেই ফেলেছে তাদের চলমান সংকটে দুঃখ-দুর্দশার কথা। তাদের দু’একজনকে ব্যক্তিগতভাবে সাময়িক কিছু আর্থিক সহায়তা হয়তো আমরা কেউ কেউ দিচ্ছি। কিন্তু পরক্ষণেই চিন্তা করতে হচ্ছে আরো কতই না বেকার এমন দুর্দশাগ্রস্থ হয়ে জীবন-যাপন করছে! আবার ভাবতে হচ্ছে, তাদেও আগামীর সম্ভাবনাটাই বা কী!

এটি জানতে বিংবা বুঝতে কারো অসুবিধাই হবে না যে, করোনার প্রভাবে বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশেও বেকারত্ব বেড়ে চলেছে। যদিও বেকারত্ব বাংলাদেশের একটি নিয়মিত সংকট। কিন্তু বর্তমান দুর্যোগের সময়ে সেটি ক্রমেই অস্বাভাবিক রূপ ধারণ করছে। কর্মসংস্থানের অভাব এ দেশের উচ্চশিক্ষিত বেকারদের জীবন-যাপনে সবসময়ই একটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বর্তমানে ওইসব নেতিবাচক প্রভাবের ধরন আরো তীব্র মাত্রায় সামনে এসেছে।

বেকারদের সামনে অনেক অন্ধকার থাকলেও বাংলাদেশের মতো একটি সম্ভাবনাময় দেশে তাঁরা স্বপ্ন দেখে প্রতিনিয়ত। অনেকসময় স্বপ্নই তাঁদের বাঁচার একমাত্র অবলম্বন হয়। উচ্চশিক্ষিত বেকারদের মূল অবলম্বনই হলো একটি ইতিবাচক স্বপ্ন। তারা স্বপ্ন দেখে যে, সহসাই একটি ভালো কিছু হবে। তারা একটি চাকরিতে আবেদনের সময়েই স্বপ্ন দেখতে শুরু করে যে, ওই চাকরিটা হবে। এভাবে একের পর এক চেষ্টা করতে করতে হয়তো ধরা দেয় সেই কাক্সিক্ষত চাকরিটি। কিন্তু এই করোনাকালে এসে তাদের সেই স্বপ্ন ভেঙে গেছে। কারণ এখন কোনো চাকরির বিজ্ঞাপন নেই। বেকারদের যেসব পরীক্ষা দেওয়া ছিল সেগুলোর ফলাফল হচ্ছে না। যেগুলো আবেদন করা ছিল, সেগুলোর পরীক্ষা হচ্ছে না। বেসরকারি খাতে সম্ভাবনাগুলোও ক্রমেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। অনেকেই চাকরিচ্যুত হয়েছেন এবং হচ্ছেন। অনেকেই কাজ কওে যাচ্ছেন কিন্তু বেতন পাচ্ছেন না। এমন নানা সংকট তাদের জীবন চলার পথকে ক্রমেই অন্ধকার করে চলেছে।

অনেক উচ্চশিক্ষিত টিউশনি করে নিজের খরচ চালাতেন এবং ক্ষেত্রবিশেষে পরিবারের খরচও। কিন্তু করোনার কারণে তাদের সব টিউশন এখন বন্ধ। নিজে কিভাবে চলবেন, আর সংসার কিভাবে চলবে সেই চিন্তায় তারা টালমাটাল। যদিও সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে কর্মহীন হয়ে পড়া এবং বিদেশফেরতরা যাতে স্বল্প সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারেন, সে জন্য, কর্মসংস্থান ব্যাংকে ২ হাজার কোটি এবং প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকে ৫ শ কোটি টাকা আমানত হিসেবে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু এ ঘোষণা বাস্তবায়ন করার জন্য সরকারের নিকট যথাযথ তালিকা কিংবা বাস্তবায়নের সুনির্দিষ্ট পথ প্রস্তুত নেই। একটি দুর্যোগ মোকাবিলায় যে ধরনের প্রস্তুতি একটি দেশের থাকা দরকার বাংলাদেশ সেদিক থেকে বেশ খানিকটা পিছিয়ে। এবার এ বিষয়ে আমরা পরিস্কার চিত্র অনুধাবন করতে পারছি।

কাজেই, এই মুহূর্তে দেশের নানা সংকটের মধ্যে বেকারদের বর্তমান পরিস্থিতি এবং আগামীর সম্ভবনাকে নিয়ে বিশেষ একটি মনোযোগ তৈরি করতে হবে। তা না হলে দেশের আগামীর বাংলাদেশে সম্ভাব্য সকল সংকট মোকাবিলায় যথাযথভাবে ঘুঁড়ে দাঁড়ানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়তে পারে। একদিকে বেকারদের বর্তমান মানবেতর জীবন অন্যদিকে আগামীর কর্মসংস্থানের সম্ভাবনার যাবতীয় চ্যালেঞ্জ মোকবিলায় সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করতে না পারলে দীর্ঘদিনের চলমান বেকারত্বের অভিশাপ আরো ভয়াবহভাবে ঘনীভূত হতে পারে।

ড. সুলতান মাহমুদ রানা: সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।