ভণ্ডামি ও সুবিধাবাদিতার শেষ কোথায়?

  • মনিরুল মোমেন
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

আমাদের একটি বড়ো সমস্যা হলো বিশ্বাসের ভণ্ডামি। যা বিশ্বাস করি, তা বলি না বা করি না। আবার যা করি বা বলি, তা বিশ্বাস করি না। আমরা যারা এই দ্বৈতনীতির মধ্যে আছি, তারা বোকাও নই, চালাকও নই- সুবিধাবাদী। সুবিধার কাছে নির্লজ্জের মতো নিজের অস্তিত্বকে বিসর্জন দিচ্ছি। এই সুবিধা নানামাত্রিক। আর্থিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রিক। যুগে যুগে আমরা এসব সুবিধা গ্রহণ করে এসেছি। এখনো করছি।

অনেক ধর্মযাজক ছিলেন, যারা তাদের সত্য সম্পর্কে নিজেরাই সন্দিহান ছিলেন। অনেক দার্শনিক যা ভাবতেন, নিজেরা তা করতেন না। অনেক বিজ্ঞানীর ক্ষেত্রেও সে প্রবণতা রয়েছে। সময়ের ধারাবাহিকতায় এই প্রবণতা আরো প্রকট হয়েছে।

আমরা এখন সভ্যতার চূড়ান্ত পর্যায়ে আছি। আমাদের জীবন বিলাসী হয়েছে। ভোগবাদী মানসিকতা বেড়েছে। ত্যাগের তুলনায় গ্রহণের প্রতিযোগিতা তীব্র হয়েছে। যেকোনো মূল্যে আমরা কেবল পেতেই চাই, দিতে চাই না কিছুই।

আমাদের মনস্তাত্ত্বিকতা দিন দিন জটিল হচ্ছে, কুটিল হচ্ছে। আমরা একেক জন যেন একেকটি রেপ্লিকা। টসটসে মাকাল ফল। সুন্দর আবরণে ঢেকে রাখি উৎকট তিক্ততা। এটা সভ্যতার চরম সংকট। এতে স্খলিত হচ্ছে বিশ্বাস ও নীতি। এই বিশ্বাসের ভণ্ডামি ও দ্বৈতনীতির বিষাক্ত ছোবলে দংশিত হচ্ছে আমাদের সমাজ, ধর্ম, রাষ্ট্র। ভয়ংকর পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে আমাদের নীতি, নৈতিকতা ও আদর্শগুলো। রাজনীতিক, ধর্মগুরু, সমাজ সংস্কারক, শিক্ষক, লেখক, ডাক্তার, সংস্কৃতিকর্মী ছাড়াও নানা শ্রেণি পেশার মানুষ বিশ্বাসের দিক থেকে ভণ্ড হয়ে উঠছে, নীতির দিক থেকে দ্বৈত হয়ে উঠছে।

ধর্মগুরুরা আমাদেরকে ধর্মজ্ঞান দিয়ে থাকেন, বিশ্বাস দৃঢ় করেন, সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য লাভের উপায় বলে দেন। কিন্তু ব্যক্তিজীবনে অনেকেই অবলীলায় স্ববিরোধী কাজ করে বেড়ান। অন্যদেরকে যা করতে বলেন, তারা তা করেন না। এটা তাদের দ্বৈত মানসিকতারই প্রকাশ। আবার যারা জাত নাস্তিক, দিনে-রাতে ধর্মের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করেন, তাদেরকেও খাঁটি ধার্মিকের মতো মসজিদ-মন্দিরে যেতে দেখা যায়। পরকালে বিশ্বাসী নন, এমন ব্যক্তিরাও স্বজন, প্রিয়জনের মৃত্যুতে 'বেহেস্ত নসিব হোক' 'স্বর্গবাসী হোক' বলে বলে গলা ফাটান। অর্থাৎ, তারাও যা বিশ্বাস করেন, তা বলেন না। কিংবা যা বলেন, তা বিশ্বাস করেন না।

রাজনীতিকের ক্ষেত্রেও অনুরূপ। অনেকেই কথায় কথায় দলের আদর্শের কথা বলেন। কিন্তু, তাদের বিশ্বাসটি ওই আদর্শের পরিপন্থী। উঠতে বসতে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বুলি আওড়ান, কিন্তু আদতে তারা পাকিস্তানের দোসর। অর্থাৎ, তারা যা ধারণ বা বিশ্বাস করেন, তা বলেন না। এই না বলার পেছনে রয়েছে নানা সুবিধা। একজন লেখক আরেকজন লেখকের লেখা পড়েন। কিন্তু লোকসমাজে সেই লেখককে লেখক হিসেবেই স্বীকার করেন না। এখানেও রয়েছে বিশ্বাসের ভণ্ডামি, সুবিধাবাদিতা।

আমরা দেশপ্রেমের কথা বলে নিজেরাই দেশের অসম্মান করি। সততা সম্পর্কে মানুষকে জ্ঞান দিয়ে নিজেরাই অর্থ লুট করি, চুরি করি, ঘুষ খাই। মানুষের অধিকারের কথা বলে নিজেরাই অধিকার হরণ করি। জনসেবার কথা বলে জনদুর্ভোগ বাড়াই, অন্যের জমি দখল করি, শ্রমিকদের বেতন মেরে খাই। মাদকের বিরুদ্ধে সেমিনার করে এসে নিজেরাই মাদক সেবন করি। যৌতুকের বিরুদ্ধে র‍্যালি করি কিন্তু নিজেরাই যৌতুক ছাড়া বিয়ে করি না। পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্যের কথা বলে নিজেদের পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাই। নারী অধিকারের কথা বলে স্ত্রীকে নির্যাতন করি। অন্যকে আদর্শের কথা বলে নিজেরা আদর্শ বিসর্জন দিই। চরিত্র গঠনের পরামর্শ দিয়ে নিজেরাই চরিত্র স্খলন করি। 'মিথ্যা বলা মহা পাপ' ছবক দিয়ে দিন-রাত নিজেরাই সেই 'মহা পাপ' করতে থাকি।

এই যে এতো এতো স্খলন, দ্বৈতনীতি, বিশ্বাসের ভণ্ডামি- তার মূলে রয়েছে নানা সুবিধা ও ভোগবাদী মানসিকতা। সভ্যতার পাশাপাশি আমাদের নীতি-বিশ্বাসগুলোকেও স্খলন থেকে রক্ষা করতে হবে। সভ্য করতে হবে নিজেদেরকেও। অন্তত যা বিশ্বাস বা ধারণ করি- তা যেন বলি ও করি। আমাদেরকে সতর্ক থাকতে হবে, বিশ্বাসের দিক দিয়ে যেন ভণ্ড না হই। নীতির দিক দিয়ে যেন দ্বিমুখী না হই।


মনিরুল মোমেন: কবি