নিভে গেল চেতনার বাতিঘর

  • প্রভাষ আমিন
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

প্রভাষ আমিন/ছবি: বার্তা২৪.কম

প্রভাষ আমিন/ছবি: বার্তা২৪.কম

গত ২৮ এপ্রিল পরলোকগমন করেন অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের রূপকার। বাংলাদেশের অধিকাংশ বড় প্রকল্পেই ছিল তার অভিভাবকত্ব। তবে শুধু প্রকৌশল খাত নয় জেআরসি নামে পরিচিত জামিলুর রেজা চৌধুরী ছিলেন জাতির অভিভাবক। করোনার এই অবরুদ্ধকালে হাহাকার তুলে চলে গেলের তিনি।

জেআরসি যেদিন চলে যান, তার আগের দিন হাসপাতালে ভর্তি হন ড. আনিসুজ্জামান। বয়স ৮৩ বছর। বয়সজনিত নানান সমস্যা বাসা বেধেছিল তার শরীরে। তবুও আমার মনে কেমন সাহস ছিল, আনিস স্যার বোধহয় এই দুঃসময়ে আমাদের শোক আর বাড়াবেন না। গত শনিবার যখন তাকে ইউনিভার্সেল হাসপাতাল থেকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়, তখন আমার সে আশা আরও দৃঢ় হয়। কিন্তু হলো না। করোনাকাল আমাদের শোকের ওপর শোকের পাহাড় চাপিয়ে দিল।

বিজ্ঞাপন

শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি-সবক্ষেত্রে যিনি ছিলেন আমাদের বাতিঘর, সেই ড. আনিসুজ্জামানও চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। আর মৃত্যুর পর জানা গেল ড. আনিসুজ্জামানের হন্তারক সেই করোনাভাইরাসই। আমরা আগেই জানি, করোনা বিশেষ করে প্রবীণদের জন্য প্রাণঘাতী। মৃত্যুর কোনো সময়-অসময় নেই; মৃত্যু মানেই দুঃসময়। তবে করোনাকালে কারো মৃত্যু মানে চরম দুঃসময়। করোনাকালে কাউকেই যথাযথ সম্মানের সাথে বিদায় জানানো যায় না। ভাবুন একবার, স্বাভাবিক সময়ে ড. আনিসুজ্জামানের মৃত্যু হলে মানুষের ঢল নামত। করোনার কারণে তাকে সীমিত আকারে বিদায় জানানোর প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু তার করোনা পজিটিভ জানার পর তার শেষকৃত্য হচ্ছে প্রায় সবার চোখের আড়ালে। মৃত্যুর পর ড. আনাসুজ্জামান এসবের ঊর্ধ্বে উঠে গেছেন। তাকে যথাযথ মর্যাদায় বিদায় জানাতে পারলাম না, এ আমাদের বেদনা।

একটা পরিবারের যেমন একজন অভিভাবক থাকে, একটা দেশেরও থাকে। ড. আনিসুজ্জামান ছিলেন বাংলাদেশের সত্যিকারের অভিভাবক। যে মানুষটির নামের আগে নির্দ্বিধায় 'সর্বজনশ্রদ্ধেয়' লিখে দেয়া যায়, তিনি আনিসুজ্জামান। দুঃখের কথা, এমন মানুষের সংখ্যা দ্রুত কমে আসছে।

আনিসুজ্জামানের জন্ম ১৯৩৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি, অবিভক্ত ভারতের চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাটে। দেশভাগের পর তাঁরা প্রথমে খুলনা ও পরে ঢাকায় থিতু হন। তার পেশা ছিল শিক্ষকতা। চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক ছিলেন তিনি। তার বহুমাত্রিক গবেষণা ও লেখালেখি সমৃদ্ধ করেছে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে।

তিনি ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুমের শিক্ষক ছিলেন বটে, কিন্তু হয়ে উঠেছিলেন জাতির শিক্ষক। তার শ্রদ্ধার আসনটি এমন উচ্চতায় স্থাপিত ছিল, দেশের প্রধানমন্ত্রীও সসম্মানে তাকে লাল গালিচা ছেড়ে দেন।

আনিসুজ্জামান ৫২এর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ–অভ্যুত্থান, ৭১এর মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের সকল প্রগতিশীল আন্দোলনে সামনের কাতারে ছিলেন। ষাটের দশকে পাকিস্তানীরা যখন তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করার অপচেষ্টা করেছিল, তখনও রুখে দাঁড়িয়েছিলেন; আবার স্বাধীন বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনেও ছিলেন সামনের কাতারেই।

ড. আনিসুজ্জামানকে কেউ কখনো চড়া গলায় কথা বলতেও শোনেননি। কিন্তু আদর্শের প্রশ্নে তিনিই ছিলেন অটল, কারও রক্তচক্ষুকে ভয় পাননি কখনো। আওয়ামী লীগ যখন সাম্প্রদায়িক শক্তির সাথে আপোষ করে, তখনও তিনি প্রতিবাদ করেন। কয়েক বছর আগে কোনো এক সরকারি ক্রোড়পত্রে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তার এক লেখা ছাপা হয়েছিল। পরদিন তিনি পত্রিকায় ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে বাকশালসহ সামগ্রিকভাবে মূল্যায়ন করেছিলেন। কিন্তু সরকারি আমলারা ড. আনিসুজ্জামানের লেখা সম্পাদনা করে বাকশাল প্রসঙ্গটি বাদ দিয়েছিল। তিনি সেটার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। নীতির প্রশ্নে এমন অটল মানুষ কজন আছে?

মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে গিয়ে তিনি প্রবাসী সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে কাজ করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে ড. কুদরাত-এ-খুদাকে প্রধান করে গঠিত জাতীয় শিক্ষা কমিশনের সদস্য ছিলেন তিনি। বাংলাদেশের সংবিধানের বাংলা অনুবাদটা ড. আনিসুজ্জামানের করা। তিনি স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ বাংলাদেশের সম্ভাব্য সব পুরস্কারই পেয়েছেন।

শুধু বাংলাদেশ নয় ভারতেও তিনি ছিলেন সবার শ্রদ্ধার পাত্র। শিক্ষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য তাকে ভারত সরকার তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মভূষণ পদক দেয়। এছাড়া তিনি দুবার আনন্দ পুরস্কার, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি লিট ডিগ্রি এবং ২০১৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জগত্তারিণী পদক লাভ করেন।

ড. আনিসুজ্জামানের অর্জনের পাত্র উপচে পড়া। কিন্তু তিনি গুরুত্বপূর্ণ অন্য কারণে। এই যে আমরা বলি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ; এর বুদ্ধিবৃত্তিক কাঠামো ও মানস গঠনে তাঁর অবদান সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ- ২৩ বছরের মুক্তি সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় অসাম্প্রদায়িক চেতনায় একটি সাম্যের সমাজ গঠনের যে ভাবনা তাতে ড. আনিসুজ্জামানদের অবদান অনেক বেশি। সাম্প্রদায়িক শক্তির এই অন্ধকার সময়টায় তাই তাঁকে আরও বেশি দরকার ছিল। আমাদের চেতনার বাতিঘরটাই নিভে গেল।

শেষ করি একটি ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ দিয়ে। এবারের নারী দিবসে এটিএন নিউজ দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে জানতে চেয়েছিল তাদের সাফল্যে তাদের সহধর্মিণীদের অবদানের কথা। মুন্নী সাহার আইডিয়া বাস্তবায়নের জন্য একটা তালিকা করা হয়। সবার ওপরে ছিল ড. আনিসুজ্জামানের নাম। কিন্তু তাকে রাজি করানোটাই ছিল সবচেয়ে কঠিন। একে তো স্যার অসুস্থ, কার ওপর বিষয়টা তাকে বুঝিয়ে বলবে কে? দ্বারস্থ হলাম স্যারের ছেলে আনন্দ জামানেরর। নারী দিবসের আগের দিন, মানে ৭ মার্চ বিকেল ৫টায় এটিএন নিউজের রিপোর্টার এ কে আজাদ গিয়েছিলেন স্যারের গুলশানের বাসায়। পরে শুনেছি বিষয়টা স্যার বেশ মজা পেয়েছিলেন এবং স্ত্রীর কথা বলেছিলেন প্রাণ খুলে। আনন্দও পরে ফোন করে আমাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। সম্ভবত সেটিই কোনো টেলিভিশনে ড. আনিসুজ্জামানের শেষ উপস্থিতি।

কিছু কিছু ব্যক্তি আছে; যাদের উপস্থিতিটাই সাহস জোগায়, নির্ভরতা দেয়; ড. আনিসুজ্জামান ছিলেন তেমনি একজন। যদিও পরিণত বয়সে,তবুও এই দুঃসময়ে তার চলে যাওয়া আমাদের অসহায় করে দিল। শূন্যতা আর শোক আরও প্রলম্বিত হলো। পরপারে ভালো থাকবেন স্যার।

প্রভাষ আমিন: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ