আবরার হত্যা: বুয়েট প্রশাসন কি দায় এড়াতে পারে?

  • লুৎফে আলি মহব্বত
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরারকে নৃশংসভাবে হত্যা করার দায় অবশ্যই হত্যা-সংশ্লিষ্ট দোষীদের। এতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু এইসব প্রত্যক্ষ হত্যাকারীরা ছাড়াও পরোক্ষভাবে যারা দায়িত্বে অবহেলা করেছেন, হত্যাকাণ্ডের পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছেন, তারা কেমন করে দায় এড়াবেন?

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বুয়েট প্রশাসনের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন, তা যথার্থ। সারা রাত ধরে একটি ছাত্রকে তুলে নিয়ে নির্যাতন করার দীর্ঘ সময় তারা কোথায় ছিলেন? শিক্ষা প্রশাসন যে অযোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছে, তা সুস্পষ্ট।

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন: বুয়েটে প্রশাসন সতর্ক থাকলে আবরার হত্যা হতো না: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

বুয়েটের ভিসি হত্যাকাণ্ডের কত ঘণ্টা পর এসেছিলেন? প্রশাসন সংশ্লিষ্টরা তড়িৎ ব্যবস্থা নিতে শৈথিল্য দেখিয়েছেন কেন? এসব প্রশ্ন এখন সকলের মুখে মুখে ঘুরপাক খাচ্ছে।

আরও পড়ুন:  ভিসির পদত্যাগ চায় বুয়েট শিক্ষক সমিতি

সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বুয়েট পরিচালনার জন্য একটি প্রশাসনিক কাঠামো আছে। ভিসি, রেজিস্ট্রার, প্রক্টর ছাড়াও হলের জন্য প্রভোস্ট, হাউস টিউটর আছেন। এজন্য তারা মূল বেতনের বাইরে ভাড়া, গাড়ি, বাসা ও অন্যবিধ সুবিধা পান।

এতো কিছু পেয়েও বুয়েটের প্রশাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা হলের সার্বিক খবর রাখেন নি। হলের সঙ্গে নূন্যতম যোগাযোগ থাকলে তারা ঘটনাটি জানতে পারতেন এবং দ্রুত অকুস্থলে পৌঁছে বা পুলিশের সহায়তায় মৃত্যুমুখী নৃশংসতা থামাতে পারতেন।

এমনকি হলে হলে যে গার্ড, দারোয়ান থাকে তাদের মাধ্যমে হলের সব খবর নিমেষেই প্রশাসন গোপনে পেয়ে যেতে পারে। এতবড় নির্যাতনের খবর তারা পান নি, এ কথা অবিশ্বাস্য। বরং, সবার মনে এই সন্দেহই দৃঢ়তর হচ্ছে যে, সব খবর জেনে বুয়েট প্রশাসনের সংশ্লিষ্টরা চুপ করে ছিলেন বা ঘটনাস্থল থেকে সটকে ছিলেন।

মোদ্দা কথায়, ক্যাম্পাস ও হলের সামান্যতম নিরাপত্তা বিধান করতে তারা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন, যার পরিণতি সারা রাত ধরে একটি ছাত্রকে নৃশংসভাবে মারতে মারতে হত্যা করার মধ্যে প্রকটিত হয়। ফলে আবরার হত্যাই শুধু নয়, আরও যে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী বুয়েটে পড়াশোনা করছে, তাদের নিরাপত্তা যে কত নাজুক অবস্থায় আছে, তা সরকার, নাগরিক সমাজ, অভিভাবক ও খোদ শিক্ষার্থীদের ভাবতে হবে।

ফলে বুয়েটের প্রশাসন হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে তাদের ব্যর্থতাকে অস্বীকার করতে পারেন না। প্রশাসনিক ও নৈতিক দায়িত্ব বলতে একজন শিক্ষকের যে সচেতনতা বোঝায়, বুয়েটের প্রশাসনে জড়িতরা তার বিন্দুমাত্রও যদি দেখাতেন, তাহলে আবরারকে অন্ততপক্ষে প্রাণে রক্ষা করা সম্ভব হতো। এখন প্রশ্ন হলো, ভবিষ্যতে এমন প্রশাসনের দ্বারা অন্য শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা আদৌ রক্ষিত হবে কেমন করে?

এ কথা সকলের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে যে, বুয়েটের প্রশাসন ও হল-সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের অবহেলার কারণে হত্যার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে এবং হন্তারকরা বেপরোয়া আচরণ করতে পেরেছে। কতিপয় শিক্ষক নামধারী কাপুরুষের কারণে হত্যাকারীরা সাহস ও সুযোগ পেয়েছে। ভবিষ্যতেও যে এমন নৃশংস পরিস্থিতির উদ্ভব এমন অথর্ব প্রশাসনের অধীনে ঘটবে না, তার নিশ্চয়তা কে দেবে?

শিক্ষক হিসাবে পিতৃসম অভিভাবকত্ব যারা দেখাতে পারেন নি এবং হলের বিভিন্ন পদ ও দায়িত্বে থেকে সকল ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিয়েও যারা তাদের হলের সামান্যতম খবর রাখেন নি, তাদের কাছে শিক্ষার্থীরা নিরাপদহীন হবেই। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দেওয়ার গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুটি যেসব শিক্ষকের কাজে-কর্মে-তৎপরতায় প্রকাশ পায় নি, তাদের ব্যাপারেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দরকার আছে।

শুধু বুয়েট নয়, সারা বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র অভিন্ন। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, ক্যাম্পাসে থাকেন না, বছরে একবারও হলে আসেন না, হলের খোঁজখবর নেন না, এমন শিক্ষক প্রভোস্ট ও হাউস টিউটরের পদ বাগিয়ে বসে আছেন। অনৈতিকতা কতটুকু তলানিতে নামলে একজন শিক্ষক এমন করতে পারেন, তা ভাবতেও কষ্ট হয়।

দেখা গেছে, ভিসি বা শীর্ষ প্রশাসন বদল হলেও হলের প্রভোস্ট বা হাউস টিউটর বদল হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন বহু শিক্ষক আছেন, যারা নানা সুবিধার লোভে প্রশাসনের কোনও না কোনও পদ বছরের পর বছর আঁকড়ে থাকেন।

প্রশ্ন হলো, এতো দায়িত্বহীন হওয়ার পরেও এরা এসব পদ পান কেমন করে বা বছরের পর বছর এসব পদে টিকে থাকেন কেমন করে? উত্তর হলো, দালালি ও তেলবাজির যোগ্যতায় তারা সেরা। সর্বক্ষণ ভিসির পা চেপে থাকা এদের অভ্যাস। ভিসি বদলের সঙ্গে সঙ্গে নিজের স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ভিসিকে নতজানু হয়ে কুর্নিশ ও কদমবুসি করতে এরা পারঙ্গম।

প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই এসব মুষ্টিমেয় দালাল, চাটুকার, তাবেদার শিক্ষক হল ও প্রশাসনে বসে আছেন এবং চরম দায়িত্বহীনতার মাধ্যমে নিজের আখের গোছাচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যক্তিত্ববান ও অ্যাকাডেমিক শিক্ষক সমাজে এরা ঘৃণিত ও নিন্দিত। এরা পড়াশোনা বা শিক্ষকসুলভ কাজের বদলে প্রশাসনিক সুবিধা নেওয়ার জন্য মাছির মতো ভনভন করেন। শিক্ষক রাজনীতির এইসব অসৎ পাণ্ডারা শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ কলুষিত করছেন এবং নিজেদের স্বার্থে ছাত্র রাজনীতিকে নষ্ট ও বিপথগামী হতে প্ররোচনা দিচ্ছেন।

আবরার হত্যাকাণ্ডের বিচার-বিশ্লেষণের সময় ক্রিমিনাল অ্যাক্টিভিটির নানা দিকের সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের নৈতিক স্খলনের বিষয়টিও সামনে আনতে হবে। বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা ও লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীর জানমালের হেফাজতের স্বার্থে শিক্ষা প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্তদের দায়িত্বহীনতাকেও চিহ্নিত ও শাস্তির আওতায় আনা জরুরি।

আরও পড়ুন: নামতে নামতে, থামবে কোথায়?

লুৎফে আলি মহব্বত: লেখক, কলামিস্ট।