মতিয়া চৌধুরী স্মরণে: স্থির প্রত্যয়ের এক ‘ব্যতিক্রমী যোদ্ধা’
প্রায় ছয় দশকের রাজনৈতিক জীবনে সাদামাটা জীবনযাপনের জন্য প্রশংসা কুড়িয়েছেন দেশের রাজনীতিতে ‘অগ্নিকন্যা’ খ্যাত মতিয়া চৌধুরী। তার এই ঘটনাবহুল রাজনৈতিক জীবনে রয়েছে নানা দুর্বিষহ স্মৃতি। লড়াই-সংগ্রামে কর্মীদের নিয়ে রাজপথে সরব থেকেছেন। তেমনি নারী জাগরণ ও নারীর ক্ষমতায়নে তার ভূমিকা অসামান্য রেখেছেন। তবে ক্ষমতার রাজনীতির ভেতরে থেকেও একজন ব্যক্তি চাইলে যে সৎ থাকা যায়, তার উজ্জ্বল উদাহরণ তৈরি করে গেছেন মতিয়া চৌধুরী।
স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ে বাংলাদেশে রাজনীতিবিদদের দুটি স্বতন্ত্র ব্যাচ ছিল। প্রথম ব্যাচ, ১৯৫০-এর দশকে যারা নবাব পরিবার থেকে এসে মুসলিম লীগে যোগ দিয়েছিলেন তারা। এছাড়াও তাদের বাইরে আরও অনেক বুদ্ধিজীবী ছিলেন যাদের বেশিরভাগই ছিলেন গ্রামীণ পটভূমির প্রথম প্রজন্মের শিক্ষিত মুসলিম যুবক। যাদের রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয়েছিল ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ততার মধ্য দিয়ে। অবশ্য তাদের অনেকেই পরে আইনজীবী হয়েছেন কিংবা অন্য পেশায় এসেছেন।
এরপরের ব্যাচ ১৯৬০-এর দশকে যারা ছাত্র নেতা হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছিলেন তারা। এই ব্যাচই পাকিস্তানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে এরাই রাজনীতিতে নিয়মিত হয়েছেন। তারা এক একজন রাজনৈতিক কাণ্ডারি হয়েও সহজ-সরল, মধ্যবিত্ত জীবনধারা বজায় রেখেছিলেন। এ কথা সত্য যে ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারির পর নৃশংসতার কারণে ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন তাদের অনেকেই কাজ চালিয়ে যেতে পারেননি। তবে ষাটের দশকের এই ব্যাচ মুক্তিযুদ্ধের সময়ও রাজনীতিতে ব্যাপক সক্রিয় ছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের অসামান্য অবদান, বীরগাথা ইতিহাসের পাতায় চির স্মরণীয় হয়ে আছে।
কিন্তু স্বাধীনতার পর পরিস্থিতি পুরোপুরি পাল্টে যায়। ক্ষমতা তাদের জীবনযাত্রার অতীব গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে ওঠে আর এটাই জনসাধারণের ধারণাকে বদলে দেয়। এই ধারণা এখনো পর্যন্ত মানুষের মনে গেঁথে আছে। ক্ষমতার এ লিপ্সায় শুধু রাজনীতিবিদরাই নন ব্যবসায়ী, শিল্পপতি এবং বেসামরিক কিংবা সামরিক আমলারাও রাজনীতিবিদদের মতো প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন।
তবে এদের মধ্যে ব্যতিক্রম ছিলেন মতিয়া চৌধুরী। ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে গিয়েও নিজেকে ব্যতিক্রমী রাখতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ ছিলেন। দেড় দশক ধরে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, দুই মেয়াদে মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনের পর জাতীয় সংসদের উপনেতা হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন।
তিনি এবং তার প্রয়াত স্বামী, সাংবাদিক বজলুর রহমান (যিনি একটি দেশীয় দৈনিকের সম্পাদক ছিলেন) ঢাকায় ১,৪০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাটে থাকতেন। তার নিজস্ব কোনো গাড়ি ছিল না। মন্ত্রী হয়েও তিনি বাজারে হেঁটে যেতেন এবং কেনাকাটা করতেন। তাকে মোটা ভাত, মোটা কাপড়ে আমৃত্যু স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতে দেখা গেছে। সাজগোজের চাকচিক্যময় জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন না কখনো। মোটা পাড়ের তাঁতের শাড়িতেই পুরো জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন তিনি।
মতিয়া চৌধুরী হাঁটতে ভালোবাসতেন। একবার ড. জাফর ইকবাল ও আমি তার নির্বাচনী এলাকা শেরপুরের নালিতাবাড়িতে শহীদ স্মৃতি বিদ্যালয় ও কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে যাচ্ছিলাম। সেদিন তিনি তার সরকারি গাড়ি থেকে নেমে গ্রামের রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা পায়ে হেঁটেছিলেন। সাদামাটা জীবনযাপন আর পরিশ্রমের অধিকারী মতিয়া ছিলেন রাজনীতিবিদের জন্য বিরল দৃষ্টান্ত। ক্ষমতাসীনরা বা ক্ষমতার অলিন্দে যারা বিচরণ করেন, তাদের সম্পর্কে জনসাধারণের গৎবাঁধা ধারণাকে ভেঙে দিয়েছেন তিনি।
আমাদের পরিচয় ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে। মনে পড়ে ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলনের সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র সংসদ অফিসে তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তিনি তৎকালীন ইডেন কলেজের (বর্তমানে বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ) ছাত্রীদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নে আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি। পরবর্তীতে তিনি তার জ্বালাময়ী বক্তৃতার জন্য 'অগ্নিকন্যা' নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তিনি সেসময় ছাত্রনেতা হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন।
মনে পড়ে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী গণহত্যা শুরু করার পর মতিয়া আমাদের দলে ছিল। আমরা গ্রামের পর গ্রাম পাড়ি দিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম। সেসময় কাপাসিয়ায় মতিয়া চৌধুরীর খালার বাসায় আমাদের দল যাত্রাবিরতি করেছিল। কিন্তু মতিয়ার জনপ্রিয়তার কারণে গ্রামবাসী তাকে চিনতে পারে, এতে করে অনেকটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে মতিয়া। যার ফলে পরিকল্পনার আগেই আমাদেরকে সেখান থেকে সরে যেতে হয়েছিল। স্বাধীনতার পর মতিয়া চৌধুরী রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তবুও, তিনি আমাদের ঘনিষ্ঠ পারিবারিক বন্ধু ছিলেন। এর মাঝে তার স্বামীর মৃত্যু হয়। অল্প বয়সে স্বামীর এ আকস্মিক মৃত্যু তার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছিল।
মতিয়া চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন। প্রতিষ্ঠাপর্ব থেকেই মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অকৃত্রিম সুহৃদ ছিলেন তিনি। স্বামী বজলুর রহমানের মৃত্যুর পর যা কিছু পেয়েছেন তা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে দান করেছেন। ইতিহাসের সঙ্গে নতুন প্রজন্মের সম্পৃক্তি গড়তে তিনি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরকে ‘মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সাংবাদিকতার জন্য বজলুর রহমান স্মৃতি পদক’ প্রবর্তনের জন্য আর্থিক অনুদান প্রদান করেন। এ লক্ষ্যে তিনি প্রতিবছর সংশ্লিষ্ট জুরি বোর্ডের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন।
ছাত্র আন্দোলন থেকে জনমানুষের নেতা হয়ে ওঠা মতিয়া চৌধুরীর নাম বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস লিখতে গেলে নানা ক্ষেত্রেই আসবে সামনে। কর্মের মধ্য দিয়ে এদেশের সচেতন মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন মতিয়া চৌধুরী। নশ্বর দেহ লোকান্তরিত হয়, কিন্তু গুণীজন বেঁচে থাকেন তার কর্মের মাঝে। অনুসরণীয় তার আদর্শ প্রেরণা দেবে নতুন প্রজন্মকে। শুধু আমাদের পরিবারই নয়, জাদুঘর ও নিবেদিতপ্রাণ সাংবাদিকরাও তাকে মিস করবে। তার আত্মা শান্তিতে থাকুক।
ড. সারওয়ার আলী । ট্রাস্টি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। (ডেইলি স্টার থেকে ভাবানুবাদ)