প্রতিশোধ ও ইতিহাসের মহাকাব্যিক শিক্ষা

  • ড. মাহফুজ পারভেজ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

‘প্রতিশোধ‘ বড় মারাত্মক প্রবণতা। জন্ম দেয় প্রতিহিংসার। তারপর চক্রবৎ চলতেই থাকে। ক্রমশ সবাইকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিতে থাকে। একবার শুরু হলে, আর যেন শেষ হয় না হিংসা, প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসার দাবানল।

বিজ্ঞাপন

প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসা যখন ব্যক্তিগত পরিসর থেকে সামাজিক, রাজনৈতিক বা আরও বৃহত্তর ক্ষেত্রে চলে যায়, তখন সেটা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। ন্যায়-অন্যায়ের বিবেচনা না করেই ঢালাও আঘাত ও প্রতিআঘাতের মাধ্যমে এক বর্বর সংস্কৃতিতে পরিণত হয়।

প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসার প্রতিফল যে কত মারাত্মক ও ধ্বংসাত্মক, তার প্রমাণ রয়েছে সভ্যতার ইতিহাসে, মহাকাব্যে, পৌরাণিক উপাখ্যানে এবং আমাদের চারপাশের বহু ঘটনায়। ধ্বংসাত্মক এই অর্থে যে, প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসার আগুন প্রতিপক্ষের সঙ্গে সঙ্গে নিজেদেরও অনির্বায ধ্বংসের গহ্বরে ঠেলে দেয়।

দৃষ্টান্ত দেওয়ার ক্ষেত্রে উপাখ্যানের আশ্রয় নেওয়া নিরাপদ। আখ্যান কাহিনী রূপে ‘মহাভারত‘ প্রাচ্য দেশে এবং ‘ইলিয়াড‘ প্রতীচ্যের পাঠকদের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার অংশ। মহাভারতের শত শত বিচিত্র চরিত্রের মধ্যে একটি হলো শিশুহন্তারক দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা। আরেক জন গ্রিক মহাকাব্য ইলিয়াড-এর নায়ক অ্যাকিলিস। দু’জনেই রণক্ষেত্রে নিতে চেয়েছেন ব্যক্তিগত প্রতিশোধ। এক জন পিতৃহত্যার, অন্য জন বন্ধুহত্যার। সাহিত্যাশ্রয়ী ঘটনার কাল্পনিক চরিত্র হলেও প্রতিশোধ-স্পৃহার কারণে তাদেরকে সম্মুখীন হতে হয়েছিল কঠিন পরিস্থিতির।

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধশেষে সৌপ্তিক পর্বে রাতের অন্ধকারে পাণ্ডব শিবিরে ঢুকেন অশ্বত্থামা। উদ্দেশ্য, পিতা দ্রোণাচার্যের মৃত্যুর প্রতিশোধ। দ্রোণাচার্যের মৃত্যু হয়েছিল ছলনায়। অশ্বত্থামা নামের এক হাতিকে মেরে ঠারেঠোরে বা মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে তাঁকে বলা হয়েছিল, ‘আপনার পুত্র যুদ্ধে মৃত’। হাতের অস্ত্র ফেলে ধ্যানে বসেছিলেন পিতা, তখনই দ্রুপদপুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন ছুটে গিয়ে তরবারির এক কোপে উড়িয়ে দিয়েছিলেন তাঁর মাথা।

প্রতিশোধের আগুনে জ্বলতে জ্বলতে আগুয়ান অশ্বত্থামা অন্ধকার পাণ্ডব শিবিরে নিদ্রিত ধৃষ্টদ্যুম্নকে পেয়ে গিয়েছিলেন। পেয়েই একের পর এক পদাঘাত, চুলে হ্যাঁচকা টান মারতে মারতে বিছানা থেকে মাটিতে ফেলে তাঁকে চেপে ধরেন। তার পর পা দিয়ে তাঁর বুক আর গলা চেপে পশুর মতো নিধন করেন।

আক্রান্ত ধৃষ্টদ্যুম্ন কাতর আবেদন করেছিলেন, “আচার্যপুত্র, আমাকে অস্ত্রপ্রহার দ্বারা অবিলম্বে বিনা অত্যাচার ও অপমানে সংহার করো।” প্রতিশোধে উন্মত্ত অশ্বত্থামা তা করেন নি। উত্তমৌজা ও যুধামন্যু নামের দুই পাঞ্চাল রাজকুমার অন্ধকার হট্টগোলের শব্দ শুনে ছুটে এসেছিলেন, অশ্বত্থামা ওই ভাবেই পা দিয়ে তাঁদের বুক, গলা বারংবার মাড়িয়ে মাড়িয়ে হত্যা করেন।

পক্ষান্তরে অ্যাকিলিস বন্ধুর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে তরবারি বা অস্ত্র ব্যবহার করেন নি। ট্রয় নগরীর বিশাল প্রাচীর ধরে ছুটিয়ে ছুটিয়ে হত্যা করেন সেখানকার রাজপুত্র হেক্টরকে। যত বারই হেক্টর বুরুজগুলোর দিকে ছুটে গিয়েছিলেন, যাতে উপরে থাকা সহযোদ্ধারা তীর ছুড়ে তাঁকে সুরক্ষা দিতে পারে, তত বারই ক্ষিপ্র পায়ে অ্যাকিলিস তাঁর সামনে চলে এসে নিগৃহীত করেন।

ধৃষ্টদ্যুম্নের আর্তি সত্ত্বেও অস্ত্রাঘাতে ক্ষত্রিয় বীরের সদ্গতি নাকচ করে দিয়েছিলেন অশ্বত্থামা। অ্যাকিলিসকে হেক্টর বলেছিলেন, “এসো দ্বন্দ্বযুদ্ধে। এসো একটা চুক্তি করি। যদি আমি তোমাকে মারতে পারি, তোমার মৃতদেহ সসম্মানে তুলে দেব গ্রিকদের হাতে। আর তুমিও ঠিক তা-ই করবে।” অ্যাকিলিস মানবিক আবেদনে সাড়া দেন নি।

অশ্বত্থামা ও অ্যাকিলিস যুদ্ধজয়ী বীর হলেও বড়ত্বের প্রমাণ রেখে যেতে পারেন নি। প্রতিশোধ গ্রহণের ক্ষেত্রে তাঁদের ক্ষুদ্রতাকে প্রকাশ করেছে ইতিহাস। ইতিহাসের ভাষ্যে এটাও জানা যাচ্ছে যে, প্রতিশোধের অনলে উভয়েই ছিলেন কাণ্ডজ্ঞানহীন। রাগের চোটে অশ্বত্থামা শত্রুর গলা পা দিয়ে চেপেছেন, অ্যাকিলিস কণ্ঠার হাড়ে বল্লম ছুড়েছেন। এর পর মৃত হেক্টরকে রথের পিছনে চাকার সঙ্গে বেঁধে ঘষটাতে ঘষটাতে গ্রিক শিবিরে নিয়ে গিয়েছেন। দুই বীরই প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা ও রাগে ভয়ঙ্কর, শত্রুর অন্ত্যেষ্টি সৎকারের সুযোগটুকুও দিতে নারাজ ছিলেন তাঁরা।

মহাভারত এবং ইলিয়াড, এই দুই মহাকাব্যের দুই মহাবীর নিয়মের সীমারেখা ও নৈতিকতার ধার ধারেননি। যদিও পিতা ও বন্ধুর জন্য প্রতিশোধ গ্রহণ এবং অপরাধীকে শাস্তির মুখোমুখি করার অধিকার তাদের ছিল। কিন্তু প্রতিশোধ নিতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করার কারণে তারাও নিন্দিত হয়েছেন। এটাই ইতিহাসের মহাকাব্যিক শিক্ষা।

ভারতীয় পৌরাণিক ভাষ্যে অশ্বত্থামার পাশাপাশি কৃপাচার্য, হনুমান, বিভীষণ, পাতালের বলিরাজা, ব্যাসদেব, পরশুরাম, এমন মোট সাত জন চিরঞ্জীবী আছেন। কিন্ত পূতিগন্ধময় শরীরে একমাত্র অশ্বত্থামার এই চিরকাল বেঁচে থাকাটা 'পাপের ফল'। আবার মৃতদের রাজ্যে অ্যাকিলিসও চিরকাল টেনে চলেছেন 'অভিশপ্ত অমর'।

অ্যাকিলিস জানতেন, হেক্টর-বধের পর তাঁরও মৃত্যু নেমে আসবে। অশ্বত্থামা জানতেন, সম্মুখসমরে না পেরে তিনি রাতের অন্ধকারে শত্রুবধের পাপাচরণ করেছেন। বীরেরা যুদ্ধক্ষেত্রে ক্ষমতা দেখান। আবার, ব্যক্তিগত আচরণের ক্ষেত্রে নানাবিধ অক্ষমতাও দেখান। মহাকাব্যে অবশ্য দেবতাদেরও নানা দোষ চিত্রিত হয়েছে। অতএব, মানুষ তো ভুল করবেই। কিন্তু এই ভুল যদি সীমা ছাড়ায়, শাস্তির বদলে প্রতিশোধের অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করে, প্রতিহিংসার লেলিহান শিখায় সব কিছু পুড়িয়ে দিতে চায়, ইতিহাস তাহলে ক্ষমা করে না।

সাধারণ পরিস্থিতিতে হিংসা, প্রতিহিংসা, প্রতিশোধ মানব সমাজের চিরায়ত অভ্যাসের মতোই লক্ষ্য করা যায়। তবে, কোনও পরিবর্তন বা বিপ্লবাত্মক ঘটনায় হিংসা, প্রতিহিংসা, প্রতিশোধ চরম আকার ধারণ করে। তখন হানাহানি ও রক্তারক্তির মাঝখানে চাপা পড়ে গিয়ে পরিবর্তন বা বিপ্লবের মৌলিক মর্মার্থই মুখ থুবড়ে ভূপতিত হয়। এতে পরিবর্তন ও বিপ্লবের অবক্ষয় ঘটে। সামান্য ব্যক্তিগত হিংসা, প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধ চরিতার্থ হয়। যদিও সীমা লংঘন না করেও আইনানুগ পথে নীতি-নৈতিকতার মাধ্যমে প্রতিশোধ গ্রহণ করা বা শাস্তির আইনানুগ বিধান করা সম্ভব ছিল।

অবশ্য ইতিহাসের পাতায় যে কোনও বিপ্লবের পরেই এমন পরিস্থিতির বিবরণ লিপিবদ্ধ রয়েছে, যেখানে হিংসা, প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধ প্রাধান্য পেয়ে বিপ্লবের মনোদার্শনিক শক্তিকে বিপন্ন করেছে; বিপ্লবের মৌলিক শক্তিকে নস্যাৎ করেছে। এজন্যই বিপ্লব নিয়ে বহু কথা বলা হলেও ফ্রান্তজ় ফানোঁ (Frantz Fanon)-এর কথাটি খুবই দামি। তিনি বলেছিলেন, 'বিপ্লবের অর্থ শুধু দেশের রাজনৈতিক অবস্থানের বদল নয়, বরং মানুষের অন্তর-সত্তার পরিবর্তন। সফল বিপ্লবের পরে নতুন মানব-মানবীর আবির্ভাব ঘটবে যারা নতুন পৃথিবী গড়ে নেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট শক্তপোক্ত হবে।'

'সেই ধরনের বিপ্লব কি সম্ভব?' এই প্রশ্ন করেছিলেন ফরাসি ভাষার ক্যারিবিয়ান লেখিকা মারিস কোঁদে (Maryse Condé)। তাঁর প্রশ্নটি অনেক বছর আগে উত্থাপিত হলেও বর্তমানেও প্রাসঙ্গিকতা হারায় নি। বিপ্লবের পরে নতুন মানব-মানবীর আবির্ভাবের মধ্যেই নিহিত রয়েছে পরবর্তী সাফল্য। আবেগীয় হিংসা, প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধে নেই বৈপ্লবিক সফলতার বীজমন্ত্র।

ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; প্রফেসর ও চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।