নজিরবিহীন বন্যা, গাঁজাখুরি গবেষণা!

  • ড. হাসিন মাহবুব চেরী, সিনিয়র স্পেশালিস্ট সায়েন্টিস্ট, ইউকে, অক্সফোর্ড
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

নজিরবিহীন বন্যা, গাঁজাখুরি গবেষণা!

নজিরবিহীন বন্যা, গাঁজাখুরি গবেষণা!

আকস্মিকভাবে বাংলাদেশে নজিরবিহীন বন্যা হয়েছে। পানিতে ভাসছে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বৃহত্তর সিলেট, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম জেলা। বৈপ্লবিক পরিস্থিতিতে সরকার বদলের অব্যবহিত পরেই হঠাৎ বন্যায় দেশে ১১টি জেলা বন্যাকবলিত। এই জেলাগুলোতে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৪৫ লাখ। এ মুহূর্তে ৮ লাখ ৮৭ হাজার ৬২৯টি পরিবার পানিবন্দি। আর এই বন্যায় এখন পর্যন্ত ১৩ জন মারা গেছেন। ২৩ আগস্ট (শুক্রবার) দুপুর ১২টার পর সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. কামরুল হাসান।

বিজ্ঞাপন

পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্য বন্যা কারণ হিসাবে প্রাকৃতিক ও ভূরাজনৈতিক বিষয়গুলো সামনে চলে আসছে। অনেকে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে কুৎসায় লিপ্ত হচ্ছেন। ভুল তথ্য ও উদ্দেশ্যমূলক গবেষণার বিষয়গুলোও দৃশ্যমান হচ্ছছে, যা বিরূপ পরিস্থিতিকে আরও নাজুক ও বিপন্ন করবে।

এরই মাঝে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) মেরিন সাইন্সের জনৈক অধ্যাপক সায়ীদ স্যারের ডাম্বুর বাঁধ যে বাংলাদেশের বন্যায় কোনও ভূমিকা রাখেনি সেই বিষয়ক মিথ্যাচারে ভর্তি ‘কোথাকার পানি কোথায় গড়ায়’ নামক একটি পোস্ট নজরে আসলো। তার এই পোস্টে তিনি দাবি করেছেন যে একমাত্র ডাম্বুর বাঁধের পানি যদি ‘গাঁজা' খায় তবেই সেই পানির পক্ষে বাংলাদেশের বন্যায় ভূমিকা রাখা সম্ভব! তার এই মিথ্যায় ভরা পোস্ট মানুষ শেয়ার করে হাসাহাসি করছে।

এই লেখাটা আমি ও অনেকেই পড়েছি, আর সেটার উত্তরও দিয়েছেন অনেকেই। তার লেখায় বেসিন নিয়ে এতো আঁতলামি করে তিনি জ্ঞানের প্রকাশ করতে চেয়েছেন। সহজ ভাষায় বেসিন হলো পানির কারণে তৈরি হওয়া গর্ত, যেটায় পানির রিজার্ভ হয়। এখানে একটা ড্যামের স্লুইস গেট খুলে দিলে সেই পানি শুধু আরেকটা নদীর বেসিনে যাবে এটা একটা ডাহা মিত্থ্যা কথা! স্লুইস গেটের একটা ছবি দেখে যে কেউ বুঝতে পারবে যে স্লুইস গেট খুলে দিলে পানির প্রবাহ কতোটা ভয়াবহ হতে পারে এবং সেটা সেই নদীর গতিপথ ধরে আশেপাশে কিভাবে প্লাবিত করতে পারে।

এই লেখায় তিনি নিজেই উত্তর দিয়েছেন যে, কিভাবে ডাম্বুর বাঁধ এই বন্যার জন্যে দায়ী। তিনি প্রশ্ন করেছেন: ‘তাহলে ডাম্বুরের পানি কই গেলো? তিনি নিজেই উত্তর দিয়েছেন: ‘এরপর গোমতি নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। কাজেই এই পানি ভারতের অইসব জনপদকে প্লাবিত করে বাংলাদেশের কুমিল্লা অঞ্চলকে প্লাবিত করবে। কুমিল্লার চেয়ে নিচু এলাকা পর্যায়ক্রমে চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর এবং নোয়াখালী। কাজেই গোমতির পানি কুমিল্লাসহ এই চারটি জেলার উপর বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি করায় ভূমিকা থাকবে। কিন্তু ফেনীর নয় (বড়জোর ফেনীর সোনাগাজী ও দাগনভূঁইয়ায় গোমতির পানির কিছুটা প্রভাব থাকলেও থাকতে পারে!’ অর্থ্যাৎ তিনি স্বীকার করছেন যে কুমিল্লা, চাঁদপুর, লক্ষীপুর এবং নোয়াখালীর বন্যাতে ডাম্বুর বাঁধের অবশ্যই ভূমিকা আছে।

এবার আসি ফেনীর বন্যার ব্যাপারে তার বিশ্লেষণে। উনি ইচ্ছে করে যেটা এড়িয়ে গেছেন সেটা হলো: এই বাঁধ তৈরি করে পানি আটকে ফেলার কারণে বাংলাদেশের দিকের নদীতে পানি স্বল্পতার কারণে শুষ্কতা দেখা দেয় এবং নদীগুলো পলি জমে ভরাট হয়ে যায়। যেকারণে অত্যধিক বৃষ্টিপাত হলে বাংলাদেশের নদীগুলো আর পানি ধারণ করতে পারছে না, এবং সেই পানি বহন করে বঙ্গোপসাগরে নিয়ে যেতেও পারছে না। এবং এর ফলশ্রুতিতে প্রচন্ড বন্যা দেখা দিচ্ছে। এবং তার ওপরে মরার ওপর খাড়ার ঘা হিসেবে এই অত্যধিক বৃষ্টিপাতের সাথে ত্রিপুরায় পানি বৃদ্ধির কারণে কোনোরূপ সতর্কতা সংকেত ছাড়াই ভারতের ডাম্বুর বাঁধ খুলে দেবার কারণে নদীর গভীরতা কমে যাওয়ায় ওনার বক্তব্য অনুযায়ী যেই পানি শুধু কুমিল্লা সহ চারটি উপজেলায় বন্যা তৈরী করতে ভূমিকা রাখছে, সেই পানিই ফেনী সহ চট্টগ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে।

মজার ব্যাপার হলো একজন বিশেষজ্ঞ হয়ে উনি বললেন যে বন্যা প্লাবিত হলে এক জায়গার পানি শুধু সেই জায়গায় বসে থাকবে, আশেপাশের জেলায় ছড়াবে না, এটা সত্যি হাস্যকর! যেখানে উনি নিজে স্বীকার করছেন যে ডাম্বুর এর পানি কুমিল্লা, চাঁদপুর, লক্ষীপুর এবং নোয়াখালী ছড়িয়ে পড়েছে, সেই পানি তার পাশের জেলা ফেনী পর্যন্ত যাবে না? তো বাকি পানি কোথায় যাবে? এ বিষয়ে তিনি নীরব। যদি দেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় চলে গেছে পানির তলে। অর্থ সত্য, খণ্ডিত তথ্য কোনও গবেষণাকে বিপদজনক চরিত্র দেয়। মূল সমস্যার বিশেষায়িত অনুসন্ধানের বদলে রাজনৈতিক বাদানুবাদ তৈরি করে। এরূপ হলে সমস্যার সমাধানের বদলে একদল লোক একে অপরকে কাদারছিটা মাখাতে লেগে যায়। গবেষণার নামে দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে অর্ধ, খণ্ডিত বা গাঁজাখুরি তথ্য দেওয়া নৈতিক অপরাধই শুধু নয়, সুপ্ত উস্কানির মাধ্যমে বিতর্ক, বিতণ্ডা ও বিপর্যয় সৃষ্টিরও কারণ। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের বালখিল্যতা পরিহার করে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা খুবই জরুরি।

জাতির চরম বিপদের সময় একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের ভুল বা মিথ্যাচার চরম ক্ষতির কারণ হতে পারে। ত্রাণ ও পুনর্বাসনের মূল কাজের ক্ষতি করে মানুষ কুতর্কে লিপ্ত হতে পারে। শিক্ষকের কাজ পথ দেখানো (আমার বাবা, মা, আমি শিক্ষকতায় পেশায় থেকে এটাই জেনে এসেছি ও পালন করেছি)। বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা নয়।

বন্যার মতো জাতীয় দুর্যোগে প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ উদ্ধার প্রচেষ্টা। দরকার দলমত নির্বিশেষে মানবতার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ার মানসিকতা। গাঁজাখুরি গবেষণায় মানুষকে বিভ্রান্ত করে ভুল তথ্য প্রচারের মাধ্যমে পরিস্থিতি ঘোলাটে করা মোটেই কাম্য ও সুবিবেচনাপ্রসুত নয়।