ছাত্র বিক্ষোভের আগুন ও স্বার্থান্ধ ব্যক্তি-গোষ্ঠীর মতলব

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছাত্র বিক্ষোভের আগুন ও স্বার্থান্ধ ব্যক্তি-গোষ্ঠীর মতলব

ছাত্র বিক্ষোভের আগুন ও স্বার্থান্ধ ব্যক্তি-গোষ্ঠীর মতলব

রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছিলেন, আগুন তেমনটি ছিল না। ছিল না সুরের, ছিল বিদ্রোহের, বিপ্লবের, প্রতিবাদের, বদলের। কবির ভাষায়: তুমি যে সুরের আগুন লাগিয়ে দিলে মোর প্রাণে/এ আগুন ছড়িয়ে গেল সব খানে, বাস্তবের পটভূমিতে তা দ্রোহের আগুন হয়ে ছড়িয়ে গেল সব খানে, বাংলাদেশের সকল মানুষের প্রাণে প্রাণে।

বিজ্ঞাপন

কলকাতায়, এমন কি, সুদূর বেলুচিস্তানের ছাত্র বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ লক্ষ্য করা গেছে বাংলাদেশের পর পরই। আরব বসন্ত যেমন মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিম এশিয়ায় গণতন্ত্রের প্রাণাবেগ এনেছিল, বাংলাদেশের ছাত্র বিক্ষোভ তেমনিভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় কর্তৃত্ববাদ ও সামাজিক অন্যায়-অনাচার-অপরাধের বিরুদ্ধে এক নজির বিহীন আশার সঞ্চার করেছে। যা থেকে প্রতিবেশী দেশগুলোও অনুপ্রাণিত হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনকে দক্ষিণ এশিয়ার দ্রোহের আইকন রূপে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।

বাংলাদেশের ছাত্র বিক্ষোভের এই আগুন যেমন পেরিয়ে এসেছে রক্তাক্ত প্রান্তর ও আত্ম বলিদানের প্রহর, তেমনি এর ভবিষ্যতের দিনগুলোও কঠিন হতে পারে। সামনের পথ তাই মসৃণ নয়। এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র থাকবে। থাকবে স্বার্থান্ধ ব্যক্তি-গোষ্ঠীর মতলববাজী। যা থেকে একে রক্ষা করতে হবে। আরও সুসংহত করতে হবে। ইতিবাচক পথে চালিত করতে হবে।

বিজ্ঞাপন

জুলাই-আগস্ট ২০২৪ সালের ছাত্র বিক্ষোভ ও বাংলাদেশের ক্ষমতার পালাবদল নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা হবে নিশ্চয়। এর কার্যকারণ ও গতি-প্রকৃতি নিয়ে নিবিড় সমীক্ষাও হবে ইতিহাস, রাজনীতি ও সমাজ বিজ্ঞানের তত্ত্বগত কাঠামোর আলোকে। তখন হয়ত এর মর্মার্থ আরও সবিস্তারে জানা যাবে। এর তাৎপর্য ও গভীরতার পুরো চিত্র উদ্ভাসিত হবে তখন।

আপাতত এটা বলাই যায় যে, বাংলাদেশের ছাত্র বিক্ষোভ অবশ্যই অকস্মাৎ কোনও প্রস্তুতি বিহীন ঘটনা নয়। কোটা বিরোধী আন্দোলনে বলপ্রয়োগের প্রতিবাদে আরও তীব্র ও সংগঠিত হয়ে তা দেশময় বিস্তৃত হয়ে ক্ষমতার বদল ঘটিয়েছে। কিন্তু ছাত্ররা একেবারেই অপ্রস্তুত ও আকস্মিক শক্তি ছিল না। তাদের ছিল মানসিক প্রস্তুতি আর পরিবর্তনের স্পৃহা।

তবে, পূর্ব-প্রস্তুতি না থাকার পরেও ক্ষমতার বদল পরবর্তী যে তিন/চার দিন দেশ সরকারহীন ছিল, তারা সেই সঙ্কুল পরিস্থিতি বেশ দক্ষতার সঙ্গে সামাল দিয়েছে। রাস্তার ট্রাফিক থেকে পাড়ায় ডাকাতি রোধে কমিটি করে কাজ করেছে তারা। ছাত্রদের সঙ্গে মিশে অপরাধ করতে আসা দুষ্কৃতিদেরও হটিয়ে দিয়েছে। এসব করার শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ তাদের আগে ছিল না। ঘটনাপ্রবাহ তাদেরকে দায়িত্বশীল ও সুসংবদ্ধ করেছে।

তাদের দায়িত্বশীলতার আরও প্রমাণ হলো, বিশেষ কোনও দলের প্রতি তারা এখনও সমর্থন দেয় নি। নিজেদের স্বতন্ত্র অবস্থান ধরেই কাজ করছে। কোনও কোনও সভা-সমাবেশে তাদেরকে আমন্ত্রণ জানালো হলেও সেখানে তারা সংবর্ধনা ও পুষ্প স্তবক গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকছে। তাদের ভাষায়, আমাদের বিপ্লব চলমান ও অসমাপ্ত। আর এতে মিশে আছে শত শহীদের রক্ত। আমরা কাজ শেষ না করে সংবর্ধনা নেবো না।

এই যে সততা, দৃঢ়তা ও আত্ম মর্যাদা, তার মূল্য অপরিসীম। ক্ষমতার পালাবদলের সুযোগে যখন শীত-ঘুমে মগ্ন একদল সুবিধাবাদী চোখ মেলে কিছু পাওয়ার জন্য কচ্ছপের লোভাতুর গলা বের করছে, তখন বিক্ষোভ ও পরিবর্তনের মূল চালিকা শক্তি ছাত্ররা হাতের কাছ দিয়ে চলে যাওয়া ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে। যেমন ভাবে তারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে লুট হওয়া টাকা ও সামগ্রী ফিরিয়ে দিয়েছে। চারদিতে হাতিয়ে নেওয়া মচ্ছবে এই ত্যাগী ও স্বার্থহীন চেতনা বড়ই অস্বাভাবিক হলেও প্রচণ্ড আশার বিষয়।

সাধারণ ছাত্র সমাজের এই দেশপ্রেমিক ও নিবেদিতপ্রাণ শক্তি কি অটুট থাকবে? তাদের ইতিবাচক শক্তিকে কি সঠিকভাবে কাজে লাগানো যাবে? এর উত্তর দেওয়া কঠিন। রাজনীতির ধান্ধাবাজ গোষ্ঠী কতক্ষণ তাদেরকে কলুষমুক্ত থাকতে দেবে, তা একটি বড় প্রশ্ন। কতক্ষণ তারা সুবিধাবাদী-বলশালীদের কুটিল শাঠ্য-ষড়যন্ত্রের চাপ সামলিয়ে নিরপেক্ষ ও সঠিক অবস্থান ধরে রাখতে পারবে, সেটাও এক বড় চ্যালেঞ্জ।

এজন্য চ্যালেঞ্জ যে, বাংলাদেশ হলো ঘোলা পানিতে মাছ ধরার একটি উৎকৃষ্ট ক্ষেত্র। এখানে অপরের কাঁধে বন্দুক রেখে শিকার করতে আগ্রহী পাক্কা শিকারীর সংখ্যা অগণন। ছাত্রদের নাম ভাঙিয়ে বা তাদেরকে ভুল বুঝিয়ে বা অপব্যবহার করে ফায়দা লুটে নেওয়ার মৌ-লোভী ঘুরঘুর করছে সর্বত্র।

উদাহরণ স্বরূপ, বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের ভয় দেখিয়ে চাঁদা নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশে সব কিছু দিবালোকের মতো স্পষ্ট হলেও আলাদা তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এদেশে কে কাকে চেনে না আর কে কার সম্পর্কে খবর রাখে না। তারপর নতুন করে তালিকা বানানোর কি আছে? অথচ ছাত্রদের নাম করে শিক্ষক, আমলা, সাংবাদিকদের এমন তালিকা বানানো হয়েছে মতলববাজদের পক্ষে, যাতে দোষীদের সঙ্গে নিজের অপছন্দের এক-দুইজনের নাম ঢুকিয়ে দিয়ে তাদেরকে এই সুযোগে ঘায়েল করার অপচেষ্টা চলেছে। কেউ কেউ ছাত্রদের নাম বিক্রি করে পদ-পদবী হাসিল করতে বা প্রতিপক্ষকে নাজেহালও করতে চাচ্ছে। মহল বিশেষের এই অপচেষ্টা একটি মহৎ আন্দোলনকে বিভ্রান্ত ও বিকৃত করার ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়।

অতএব, স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর কবল থেকে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা যদি রক্ষা পায় এবং নিজেদের অভীষ্ট লক্ষ্যে অটল থাকে, তাহলে ছাত্র বিক্ষোভের রেশ ধরে বাংলাদেশে ইতিবাচক পরিবর্তনের পথকে প্রসারিত করা অবশ্যই সম্ভব হবে। এক্ষেত্রে ছাত্র আন্দোলনের ফলে যারা ক্ষমতাসীন হয়েছেন, তাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। এমন একটি বৃহত্তর সামাজিক শক্তির, যার রয়েছে রাজনৈতিক পরিবর্তন সাধনের বিপুল ক্ষমতা, তাকে ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা মহল বিশেষ নিজস্ব ক্ষুদ্র ফায়দা হাসিলের মাধ্যমে যেন বেপথু হতে না পারে, তার বন্দোবস্ত করতে হবে। সরকার ও প্রশাসনের সঙ্গে ছাত্র শক্তিতে নিরপেক্ষকতার সঙ্গে সুসমন্বিত ভাবে কাজে লাগানোর মাধ্যমে তা হতে পারে। ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠীর স্বার্থ হাসিলের চক্রান্তমূলক খপ্পড়ে পড়ে গেলে তা কখনোই সম্ভব হবে না।

বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের যে আগুন ছড়িয়ে গেল সব খানে, তাকে অন্ধকার বিনাশের কাজে লাগাতেই হবে। রাজনৈতিক অন্ধকার, সামাজিক অন্ধকার, অর্থনীতির অন্ধকার তথা দুর্নীতি, অব্যবস্থার যাবতীয় অন্ধকার বিনাশের কাজে প্রজ্জ্বলিত মশালের মতো কাজে লাগাতে হবে অযুত সম্ভাবনাময় এই মহাশক্তিকে। কোনও অবস্থাতেই মতলববাজ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থবাদী কারসাজিতে এই মহত্তম শক্তিকে নস্যাৎ ও পথভ্রষ্ট হতে দেওয়া যাবে না।

ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; প্রফেসর ও চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।