ভরসা ওই জনগণই

  • সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

বিশ্বজুড়ে ব্যাপ্ত পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা এখন বর্বরতার শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে। পুঁজিবাদমনস্ক অতিনিকৃষ্ট স্তরের মানুষেরা রাষ্ট্রের কর্তা হচ্ছে, রাষ্ট্রকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে, সঙ্গে রয়েছে ব্যবসায়ীরা, তবে-এটা যেমন সত্য, তেমনি সত্য এটাও যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা এখন ভেঙে পড়বে-পড়বে অবস্থায় পৌঁছে গেছে। তার সকল খেলা, কৌশল, প্রতিষ্ঠানই এখন দুর্বল হয়ে পড়েছে। ধরা যাক নোবেল পুরস্কারের কথাই। এই পুরস্কার এক সময়ে অত্যন্ত গৌরবজনক ছিল, এখন আর তেমন নেই; বিশেষ করে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের অবস্থাটা তো বেশ কাহিল। ক’বছর আগে দেখা গেল দেবার মতো কোনো লেখক নেই, তাই পুরস্কার দেওয়া হলো একজন সঙ্গীতরচয়িতা ও গায়ককে। পরের বছর পুরস্কার দেওয়াই হলো না; কারণ? কারণ দাতা প্রতিষ্ঠানের ভেতরে যৌন কেলেঙ্কারির ঘটনা। পুরস্কার যে দু’জনকে দেওয়া হয়েছিল জানা গেল তাঁদের একজন বসনিয়াতে গণহত্যাকে সক্রিয় ভাবে সমর্থন করেছেন। অর্থনীতিতে নোবেল পেয়েছিলেন তিনজন; এঁদের দু’জন আবার স্বামী-স্ত্রী। স্বামীটি বাঙালি। সেই খবরে বাঙালি মহলে বেশ উৎফুল্লতা দেখা গিয়েছিল, পরে সেটা স্তিমিত হয়ে গেছে।

কারণ, জানা গেছে বাঙালি ভদ্রলোক-নাম অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়-নৈতিক দিক থেকে মোটেই প্রশংসনীয় মানের নন। তাঁর প্রথম স্ত্রী ছিলেন বাঙালি, তিনিও উঁচু স্তরের একজন অধ্যাপক ছিলেন। যাঁর সঙ্গে মিলে তিনি পুরস্কারটি পেলেন তিনি তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী। ফরাসি বংশোদ্ভূত এই মহিলাটি একদা বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের ছাত্রী ছিলেন; দারিদ্র্য নিয়ে গবেষণা করতে তাঁরা ভারতে কয়েক বছর একত্রে কাটিয়েছেন। তা ছাত্রীটিকে বিয়ে করতে ওই শিক্ষকের বিশেষ রকমের আগ্রহ যে ছিল তা নয়; কিন্তু না-করে উপায় থাকেনি। কেননা ছাত্রী ঘোষণা করে দিয়েছিলেন যে তিনি মা হতে যাচ্ছেন এবং তাঁর ভাবী সন্তানের পিতা অন্যকেউ নন, তাঁর শিক্ষক মহাশয়ই। ফলে প্রথম স্ত্রী পরিত্যক্ত হয়েছেন। সে-স্ত্রী ইংল্যান্ডে চলে গেছেন একমাত্র পুত্রসন্তানটিকে সঙ্গে নিয়ে। ঘটনাধারার অত্যাচারে পুত্রটি মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে, এবং এক সময়ে আত্মহত্যাই করে ফেলে।

বিজ্ঞাপন

সেটা গেল পারিবারিক তথ্য, এ নিয়ে আমাদের কোনো দুশ্চিন্তার কারণ নেই, তবে লক্ষ্য করবার বিষয় হলো তাঁর চিন্তাধারা, যেটি খাঁটি পুঁজিবাদী, এবং যেটির প্রচারে তিনি সবেগে অংশ নিচ্ছেন। তাঁর বইপত্র পড়বার সুযোগ এখনো আমাদের হয়নি, তবে সাক্ষাৎকার পড়ে বিলক্ষণ জানা গেছে তিনি কোন ঘরানার মানুষ। পুঁজিবাদী তো হবেনই, না-হয়ে উপায় নেই; কিন্তু মনে হচ্ছে বেশ কট্টরপন্থি। যেমন, তিনি বলেছেন উন্নয়নের জন্য দুর্নীতি কোনো অন্তরায় নয়। অর্থাৎ প্রকারান্তে বলা যে উন্নতি চাইলে দুর্নীতি মেনে নিতে হবে, যে বাণীর উচ্চারণ আমরা নিম্ন, উচ্চ, নীরব কণ্ঠে অহরহ শুনেছি, বাধ্য হয়েছি শুনতে। তিনি আরও একটা কথা বলেছেন। জানিয়েছেন যে বর্তমান সময়ে সারা বিশ্বে বেশি আদর পাচ্ছে অতিধনীরা এবং অতিগরিবরা। যতো কষ্ট মধ্যবিত্তের। মধ্যবিত্ত যে কষ্টে আছে, এবং অতিধনীরা যে আদর পাচ্ছে সেটা তো আমাদেরও অভিজ্ঞতা। কিন্তু অতিগরিব? হ্যাঁ, তারাও আদর পায়। তাদের জন্য এনজিও আছে, দাতারা আছে, এমনকি স্বীয় ব্যথায়-কাতর মধ্যবিত্তও রয়েছে; কিন্তু এই ব্যবস্থাটা যে ভাঙা দরকার, অন্ততপক্ষে অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠা যে অত্যাবশ্যক, সেটা তো আমরা খুবই অনুভব করি। তবে ভরসা রাখি যে এ ব্যবস্থাটা ভাঙবে; ভাঙবে এই জন্য যে বঞ্চিত মানুষের সংখ্যাই অধিক, এবং তারা এ ব্যবস্থা মেনে নেবে না; মেনে নিচ্ছে না।


পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা যে পিতৃতান্ত্রিক সেটা তো পদে পদে টের পাই। বাঙালি সমাজে পিতৃতান্ত্রিকতার তৎপরতা সামন্তবাদের আধিপত্যের কালে বেশ ভালোভাবেই ছিল, পরেও যে একেবারে বিদায় নিয়েছে তা নয়, বরং আরো দুর্বার হয়ে উঠেছে। বাংলা সাহিত্যে মেয়েদের প্রতি যাঁরা সহানুভূতিশীল এমন লেখকদের বেলাতেও দেখা গেছে টানটা কিন্তু বাবার দিকেই। বাবা অনেক ক্ষেত্রেই কর্তব্যপালনে অপারগ, কখনো কখনো করুণার পাত্র, কিন্তু তাঁরাই কর্তা; তাঁদের প্রতিই পুত্রদের তো অবশ্যই, কন্যাদেরও বিশেষ রকমের পক্ষপাত। শরৎচন্দ্র ও বিভূতিভূষণের কথা বেশ স্মরণে আসে। ১৯৩৫ সালে লেখা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দৃষ্টি-প্রদীপ উপন্যাসে একজন পিতার কথা আছে, তিনি দার্জিলিং-এর চা বাগানে অফিসার ছিলেন। দাপুটে মানুষ। স্নেহপ্রবণও। তবে কর্তৃত্বপরায়ণ এবং মদ্যাসক্ত। সপ্তাহে অন্তত একবার মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপান না করলে তাঁর চলতো না; এবং সেই সময়ে তিনি স্ত্রী সন্তান কোনো বাছবিচার করতেন না, সবাইকে ইচ্ছামত পেটাতেন।

মদ্যাসক্তির কারণেই হবে, এক সময়ে তিনি কর্মচ্যুত হলেন। তাঁকে চলে আসতে হলো পৈত্রিক গৃহে। চাকরি নেই; চাকরি খোঁজেন, পান না। থাকেন বড় ভাইয়ের কর্তৃত্বাধীন। আশ্রিত। পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা কাকে বলে সেটা তিনি যতটা না বোঝেন তার চেয়ে বেশি বোঝেন তাঁর স্ত্রী। একান্নবর্তী পরিবার কত যে বীভৎস হতে পারে তার ছবি সামন্তবাদের-প্রতি-পিছুটানসম্পন্ন ঔপন্যাসিকের পক্ষেও আড়াল করাটা সম্ভব হয় না। ওই পিতা শেষ পর্যন্ত পাগলই হয়ে গেলেন। প্রলাপ বকেন। তাঁকে বেঁধে রাখা হয়। কলকাতায় পাঠানো হলো, মানসিক ব্যাধির হাসপাতালে। সেখান থেকে পালিয়ে চলে এলেন বাড়িতে। অবস্থা যখন আরো খারাপ হলো, তখন জিতুর জ্যেঠা-কাকারা (জিতু হচ্ছে উপন্যাসের নায়ক, কথকও সে-ই) মিলে, জিতু ও তার দাদাকে সঙ্গে করে নিয়ে জিতুর বাবাকে নিয়ে গেল বাড়ি থেকে অনেক দূরে, বিলের অপর পাড়ে, এক জঙ্গলে। সেখানে সন্ধ্যাবেলায় জিতুর বাবাকে ফেলে দিয়ে আসা হয়েছে, আশা ছিল যে তিনি আর ফিরে আসতে পারবেন না। ওখানেই শেষ হয়ে যাবেন। তিন দিনের দিন বাবা ঠিকই বাড়িতে এসে হাজির। তারপর সেই যে শয্যশায়ী হলেন আর উঠলেন না।

বিভূতি-সাহিত্যে বহু মর্মস্পর্শী দৃশ্য আছে, কিন্তু বাবাকে জঙ্গলে ফেলে দিয়ে কিশোর দু’সন্তানের দৌড়াতে দৌড়াতে ঘরে ফিরে আসার এই দৃশ্যটির সঙ্গে অন্য কোনোটাই বোধ করি তুলনীয় নয়। বাবা চলে গেলেন, কিন্তু তাতে পিতৃতন্ত্র যে ভাঙলো তা তো নয়। পিতৃহীন কিশোর জিতু একেবারে অসহায় অবস্থায় পড়েছে, অনেক দুঃখকষ্ট সে সহ্য করেছে; কিন্তু দেখা গেল ঠিক নিজের পিতার মতো না হলেও সে ওই পিতৃতান্ত্রিকই রয়ে গেছে। ব্যবস্থাটা যে ভাঙার দরকার জিতু তা বোঝে না। বোঝাটা তার পক্ষে সম্ভবও নয়; সে পালিয়ে যায়, আশ্রয় নেয় আধ্যাত্মিক জগতে। বাস্তবতা কিন্তু বলছে যে ব্যবস্থাটাকে ভাঙতে হবে; নইলে জিতুর মা, জিতুর প্রতিমার-মতো-দেখতে বোন সীতা, অকালপ্রয়াত তার সাদাসিধা বড় ভাই, কারোরই মুক্তি নেই। মুক্তি নেই জিতুর বাবারও।

বিশ্বজুড়েই এখন মুক্তির জন্য তীব্র আকাক্সক্ষা সৃষ্টি হয়েছে। মূল ভরসাটা এইখানেই। বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত করে বলেছেন কার্বন নিঃসরণ এখনই কমাতে হবে, নইলে পৃথিবী টিকবে না; রূপক নয়, আক্ষরিক অর্থেই যাবে সে রসাতলে। একের পর এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন হচ্ছে, রাষ্ট্রপ্রধানরা উপস্থিত থাকছেন; তথ্য আসছে, আলাপ-আলোচনা চলছে। কিন্তু রাষ্ট্রপ্রধানদের শুভেচ্ছার ওপর ভরসা করাটা একেবারেই বৃথা। তারা সবাই পুঁজিবাদের আজ্ঞাবাহী সেবক। ভরসা ওই জনগণই। তবে জনগণের চেতনা, ক্ষোভ, বিক্ষোভ, শোভাযাত্রা, ঘেরাও সবকিছুই অফলপ্রসূই রয়ে যাবে যদি আসল কর্তব্যটি পরিষ্কার ভাবে উঠে না আসে, এবং সেই কর্তব্যপালনে ঐক্যবদ্ধ না হওয়া যায়।

কর্তব্যটি অন্যকিছু নয়, পুঁজিবাদকে বিদায় করা। পুঁজিবাদ ব্যক্তি নয় যে তাকে সন্ধ্যাবেলা বিলের ওপাশে নির্জন জঙ্গলে ফেলে দিয়ে আসা যাবে, তাছাড়া ফেলে দিলেও তো সে ঘরে ফিরে আসবে। পুঁজিবাদ একটি আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা, বিশেষ এক ধরনের সম্পর্ক, একটি আদর্শ, এবং সভ্যতার বিবর্তনে-গড়ে-ওঠা একটি সংস্কৃতি, যাকে ভাঙতে হবে, একেবারে ভেতর থেকে, এবং কেবল ভাঙলেই কুলাবে না, তার জায়গাতে সামাজিক মালিকানার নতুন এক ব্যবস্থা গড়ে তোলাটা অত্যাবশ্যক হবে। মানুষে মানুষে সম্পর্ক হবে মৈত্রীর ও সহযোগিতার; মানুষের সৃষ্টিশীলতা হবে অবিরত; রিক্সাচালকের সততাকে অসামান্য বলতে হবে না। ওরা তো আসলে আর রিক্সা চালাবেনই না, তাঁর মুক্তি ঘটবে ওই জোয়াল থেকে। পৃথিবীতে দারিদ্র্য থাকবে না। নিপীড়ন তো নয়ই। ভাঙার ও গড়বার এই পথটা হচ্ছে সামাজিক বিপ্লব, যে বিপ্লব ঘটলে সমাজের অভ্যন্তরে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে কর্তৃত্ববাদিতা থাকবে না-পিতার তো নয়ই, মাতারও নয়।

বর্তমানে দাঁড়িয়ে এই ভবিষ্যতকে গড়বার জন্যই মানুষ এখন কাজ করছে। এই কাজ কত তাড়াতাড়ি ও কিভাবে সফল হয় তার ওপরই বিশ্বের ভবিষ্যতের একান্ত নির্ভরতা। এই মুহূর্তে পৃথিবীর অন্তত দশটি দেশে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ চলছে; ইরাকে দলবলসহ প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল, সুদানের স্বৈরশাসক পদত্যাগ করেও রক্ষা পাননি, তাঁর দলকেই বিলুপ্ত করে দেওয়া হয়েছিল। এসব ঘটনা বাড়বে, বাড়তে থাকবে, কিন্তু তাতে পৃথিবীটা বদলাবে না, যদি না ব্যক্তিমালিকানার জায়গাতে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়।

একাজ ভালো মানুষদের। কিন্তু এটা তারা করতে পারবেন না, যদি না একত্র হন, একত্র হতে হবে সমাজবিপ্লবের লক্ষ্যে। কেবল একত্র হওয়া নয়, দরকার হবে সংঘবদ্ধ হওয়া এবং বিকল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়