পাওয়ার অব কমন পিপল

  • ড. মাহফুজ পারভেজ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ড. মাহফুজ পারভেজ

ড. মাহফুজ পারভেজ

আন্দোলন জমলে অনেকেই এসে সমবেত হয়। আগে থেকেই বিরোধী দলগুলো নিশ্চিতভাবে সরকার বিরোধী আন্দোলনের পেছনে ছিল। থাকবেই। সরকারকে হটাতে তারা চুপচাপ বসে থাকবে, এটা ভাবার কারণ নেই। কিন্তু লিড দিয়েছে ছাত্র, সাধারণ মানুষ, কমন পিপল, আম জনতা। স্রোতের মতো জড়ো হয়েছে তারা। গুলি, হামলা, প্রতিরোধ বুক পেতে নিয়েছে। শেষ পর্যন্ত সকল প্রতিরোধ ঠেলে প্রতিবাদ সামনে নিয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশে ২০২৪ সালের সরকার পতনের প্রধান শক্তি কমন পিপল।

বলা হয়, বন্দুকের নল নয়, জনতাই ক্ষমতার উৎস। কথাটা যত বলা হয়, তত বিশ্বাস বা মান্য করা হয় না। বরং জনতার শক্তির বদলে ক্ষমতায় থাকার জন্য পেশী, শক্তি, বন্দুক ব্যবহার করা হয়। এতে কিছুদিন টিকে থাকা গেলেও শেষ রক্ষা হয় না। কমন পিপলের পাওয়ারই জয়ী হয় অবশেষে। বাংলাদেশের সর্বসাম্প্রতিক পরিস্থিতি এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশে ক্ষমতার রক্তাক্ত পালাবদল আবারও প্রমাণ করলো কমন পিপল-এর পাওয়ার। একই সাথে কমন পিপল‘কে অবজ্ঞা করার করুণ পরিণাম। রাজনীতির খেলায় ক্ষমতায় যেতে কমন পিপল‘কে ব্যবহার করলেও অধিকাংশ সময়ই এই মূল উৎসকে ভুলে যাওয়া হয় বা অবজ্ঞা করা হয়। ক্ষমতার বৃত্ত জনতাকে বাদ দিয়ে তৈরি করা হয় চাটুকার, তাবেদার, আমলা, ক্যাডার ইত্যাদির মাধ্যমে। দিনে দিনে সেই বৃত্ত জনবিচ্ছিন্ন হতে হতে বিন্দুতে পরিণত হয়। তখন পতন ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না।

উন্নয়নশীল দেশে, যেমন বাংলাদেশে, ক্ষমতার মূল উৎস জনগণ আর ক্ষমতার মধ্যকার সম্পর্ক প্রতারণামূলক। জনতার বল-ভরসায় ক্ষমতায় গিয়ে প্রথমেই তাদের দাবি ও তাদের প্রতি দায়িত্ব পালনের বিষয়টি খারিজ করে ক্ষমতাসীনরা। নিজের এবং সহযোগীদের লুটপাট ও তুষ্টিকরণে মনোযোগী হয় কর্তারা। যেন জনতাকে ব্যবহার করে নিজেদের আখের গোছানোই আসল কাজ। এতে নিজেদের ও চ্যালা-চামুণ্ডাদের শরীর-স্বাস্থ্য মোটা হলেও নিজের ভবিষ্যত অন্ধকার হয়ে যায় ও পতন আসন্ন হয়। অতীতে যতগুলো সরকার ক্ষমতা থেকে পতিত হয়েছে, সবগুলোর পেছনে দেখা যাবে জনবিচ্ছিন্নতার বিষয়টি। জনবিচ্ছিন্ন হলে এবং জনতার স্বার্থ রক্ষায় ব্যর্থ হলে যত শক্তিশালী সরকারই হোক, টিকতে পারে না।

বিজ্ঞাপন

নিজের ও বশংবদদের প্রতি মনোযোগী হয়ে আমজনতার প্রতি অবহেলা ও অবজ্ঞার ফল হয় মারাত্মক। তাদেরকে সম্মানের সাথে দেখা ও তাদের কথা গুরুত্বের সাথে শোনার প্রয়োজনও বোধ করা হয় না। এই অবজ্ঞা ও অবহেলার পুঞ্জিভূত ক্ষোভ এক সময় আগ্নেয়গিরির মতো বিস্ফোরিত হয়। তখন বশংবদরা সেই লাভাস্রোত থামাতে পারে না। বশংবদ-তাবেদার গোষ্ঠীই বরং সর্বাগ্রে পালিয়ে যায়।

ফলে গণতন্ত্রের প্রাথমিক শর্ত জনগণের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের বিষয়টি বিস্মৃত হলে তথা কমন পিপল থেকে সরে গেলে কোনও সরকারই জনপ্রিয়তা পায় না, টিকে থাকতে পারে না। জনগণের জন্য সুশাসনের মৌলিক কাজগুলোও তখন করা হয় না। মানুষ বাঁচলো নাকি মরলো সেটাও দেখা হয় না। মানুষও ক্ষেপে গিয়ে সরকার বাঁচলো কি মরলো সেটার পরোয়া করে না।

ক্ষমতায় থেকে যখন দলেবলে হাজার কোটি টাকা বানানো হয়, শত কোটি টাকা কামানো হয়, আর আম জনতা নিত্যদিনের বাজার খরচ মেটাতে ব্যাকুল হয়, তখন জনতার ভালোবাসা ও সমর্থন ক্ষোভে পরিণত হতে বাধ্য। যখন মানুষ চাকুরি পাবে না, হাসপাতাল-রেল-সড়ক-অফিসে সামান্যতম সার্ভিস পাবে না, থানা-পুলিশের কাছে নিরাপত্তা পাবে না, পয়সা ছাড়া কিছুই হবে না, দলীয় সন্ত্রাসীদের চাঁদা না দিয়ে ব্যবসা করতে পারবে না, তখন নিশ্চয় খুশি হবে না। তার মনের মধ্যে ঘৃণা ও সংক্ষোভ জমবেই।

যে জনতা গণতন্ত্রের ভরসায় কোনও দলকে ক্ষমতায় আনে, এবং দেখে যে দলই সব খেয়ে ফেলছে, তখন সহ্য করতে পারে না। আবার, গণতন্ত্রে সরকার ও বিরোধী দল দুটি পায়ের মতো। ক্ষমতায় গিয়ে একটি পা ভেঙে ফেলে যদি ভাবা হয়, প্রতিপক্ষ শেষ। তাহলে ভুল। ক্ষতিটা তখন আরও মারাত্মক আর ভয়াবহ হয়। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ থাকলে তার কাছে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের যে পথ খোলা থাকে, সেটাও বন্ধ হয়। তার জায়গা দখল করে অমঙ্গলজনক পরিস্থতি তথা সংঘাত, সংঘর্ষ, রক্তপাত ও নৈরাজ্য।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন অনেক কাঙ্খিত ও অনাকাঙ্খিত ঘটনার জন্ম দিলেও একটি শিক্ষা দিয়ে গিয়েছে যে জনতাকে অবজ্ঞা ও অবহেলা করে দূরে সরিয়ে দিতে নেই। জনতার মৌলিক দাবি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে নেই। জনতার সুখ-দুখে একাকার হয়ে থাকা দরকার।

চেন্নাই এক্মপ্রেস শাহরুখ খান ও দীপিকা অভিনীত অতি জনপ্রিয় একটি রোমান্টিক-কমেডি। ছবিতে শাহরুখের একটি সংলাপ আছে, ‘ডোন্ট আন্ডার এস্টিমেট পাওয়ার অব কমনম্যান‘। সাধারণ মানুষের ক্ষমতাকে অবজ্ঞা করতে নেই। আপাতত বাংলাদেশের জন্য এই সংলাপটিই একটি বড় শিক্ষা হয়ে ফিরে এসেছে।

বিশেষত, সরকার পতনের পরেও যখন ছাত্র-জনতা রাস্তা ছাড়েনি এবং মৃত্যুর পর মৃত্যু দিয়ে যারা এখনও মাঠ দখল করে রেখেছে, তাদের স্পন্দন অনুধাবণ করা বিশেষ জরুরি। যে আন্দোলনের পেছনে ছিল রাজনৈতিক শক্তি আর সামনে ছাত্র-জনতা, সে আন্দোলনের ফসল কব্জা করা বা বিপথগামী করার ফলও ভালো হবে না। প্রজ্জ্বলিত আগুন তাতে বাড়বে বৈ কমবে না। যারা ক্ষমতায় ছিলেন, তারা বিরাট মূল্য দিয়ে এই সত্যটি বুঝেছেন। যারা ক্ষমতায় আসবেন, তাদেরকেও গভীরভাবে জনতার শক্তিকে মূল্য দিতে হবে। দল ও গোষ্ঠীর দিকে অতিরিক্ত মনোযোগ দিয়ে জনপ্রত্যাশা ও দাবিকে অবজ্ঞার ফল আগে বা পরে, সব সময়ই ভয়াবহ। অতএব, কোনও পরিস্থিতিতেই ‘ডোন্ট আন্ডার এস্টিমেট পাওয়ার অব কমনম্যান‘।

ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।