ছাত্র অভ্যুত্থান ২০২৪

  • কবির য়াহমদ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছাত্র অভ্যুত্থান ২০২৪

ছাত্র অভ্যুত্থান ২০২৪

পেছন ফিরে তাকালে দেখা যায়, বাংলাদেশে কোন ছাত্র আন্দোলন ব্যর্থ হয়নি। সেই ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিটি আন্দোলনে সফল হয়েছে ছাত্ররা। যখন আমাদের স্বাধিকার ও স্বাধীনতার অধিকার ছিল না, তখনও পাকিস্তানি শাসকের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে জয়ী হয়েছে ছাত্ররা। স্বাধীন বাংলাদেশে নানা নামের সরকারের সময়েও একইভাবে সফল সকল ছাত্র আন্দোলন। ছাত্র-শক্তির এই বিপুল রূপ সত্ত্বেও প্রতিটি শাসক দমন করতে চেয়েছে শক্তি-প্রয়োগে, বন্দুকের নল তাক করা হয়েছে তাদের দিকে, কিন্তু কেউ সফল হয়নি। শিক্ষার্থীরা রক্ত দিয়েছে, তবু দমে যায়নি; বিজয়ী বেশে ফিরেছে ঘরে।

ছাত্র-আন্দোলনের বিজয়ের এই ধারাবাহিকতায় এবার যোগ হয়েছে আরেক অধ্যায়। বিপুল ক্ষমতার অধিকারী আওয়ামী লীগ সরকারের পতন। আন্দোলনের পাঁচ সপ্তাহের মাথায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের মাধ্যমে আজ সোমবার (৫ আগস্ট) সূচিত হয়েছে আরেক অধ্যায়ের। এবার পদত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে দেশত্যাগ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এবারের এই আন্দোলনে কেবল শিক্ষার্থীরাই ছিল, এমন না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল সকল রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষ। ফলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লং মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচির দিনে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন শেখ হাসিনা।

বিজ্ঞাপন

ইতিহাস বলে, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পূর্বাপরে ছিল ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ। উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার করার যে ঘোষণা তার প্রতিবাদের শুরু করেছিল ছাত্ররাই, ‘না-না’ ধ্বনিতে। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল ছাত্ররা। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের জন্ম প্রক্রিয়ায় দীর্ঘ মুক্তির সংগ্রাম ও স্বাধীনতা অর্জনে ছাত্ররা রেখেছিল অগ্রণী ভূমিকা।

স্বাধীন বাংলাদেশে স্বৈরাচার হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের শাসনের বিরুদ্ধে যে গণআন্দোলন গড়ে ওঠে সেখানে ছাত্রসমাজের ছিল ইতিবাচক অগ্রগণ্য ভূমিকা। এরআগে মজিদ খানের শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আন্দোলন করেছিল। ওয়ান-ইলেভেনের সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে খেলার মাঠে ছাত্রদের সঙ্গে এক সেনাসদস্যের ঝামেলা থেকে শেষ পর্যন্ত আন্দোলন ও সেনাসমর্থিত সরকারের পতনের পথ রচিত হয়। ২০১৩ সালের একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে যে গণজাগরণের সূচনা হয়, সেখানেও ছিল ছাত্রসমাজের ভূমিকা। ২০১৮ সালের কোটা সংস্কারের দাবিতে যে আন্দোলন গড়ে ওঠে সেটা ছাত্রসমাজের দাবি ও তাদের মাধ্যমেই গড়ে ওঠে। ওই আন্দোলনের ফলে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি করে আওয়ামী লীগ সরকার। নিরাপদ সড়কের দাবিতে যে আন্দোলন সূচিত হয় ওই একই বছর, সেটাতেও ছিল শিক্ষার্থীরাই। এরবাইরে বিশ্ববিদ্যালয়ে-বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা সময়ে নানা আন্দোলন হয়েছে, এবং অধিকাংশ আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায়নি।

বিজ্ঞাপন

ছাত্র আন্দোলনের এই চারণভূমে কোটা নিয়ে যে আন্দোলন হয়েছে, সেটাকে কেবল ছাত্র-আন্দোলন বলা চলে না; বিস্তৃতভাবে একে ‘ছাত্র অভ্যুত্থান’-ই বলা যায়। এবারের আন্দোলন ক্যাম্পাসে-ক্যাম্পাসে সীমাবদ্ধ থাকেনি, এটা ছড়িয়ে পড়েছিল সারাদেশে। সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত হোক, শক্তি-প্রয়োগের অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের কারণেই হোক, এর ব্যাপ্তি ছিল বিশাল। বিশাল ছাত্র-বিক্ষোভ দেশ ছাপিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশেও আঁচ ফেলেছিল। এর প্রভাব পড়েছিল আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও। আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘসহ নানা দেশ ও সংস্থা এটা নিয়ে কথা বলেছে, চাপ প্রয়োগ করেছে। এবং শেষ পর্যন্ত দেশের সেনাপ্রধানের বক্তব্যের জানা গেছে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের আনুষ্ঠানিক খবর।

শিক্ষার্থীদের ডাকা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’-এ পুরো দেশ অচল হয়ে পড়ে। আন্দোলনকে স্তিমিত ও নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়, বিচ্ছিন্ন দেশে নির্বাহী আদেশে সরকারি ছুটি ঘোষিত হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের পাশাপাশি এইচএসসির মতো পাবলিক পরীক্ষায় স্থগিত করতে হয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের, সরকারি চাকরিতে নিয়োগের বিভিন্ন পরীক্ষাও স্থগিত হয়ে যায় এই সময়ে। সরকারপ্রধানকে পূর্ব-নির্ধারিত স্পেন ও ব্রাজিল সফর বাতিল করতে হয়। প্রধানমন্ত্রীর ২১ থেকে ২৩ জুলাই স্পেনে এবং সেখান থেকে ২৪ থেকে ২৭ জুলাই ব্রাজিলে সফরে থাকার কথা ছিল। পুলিশ-র‍্যাব-বিজিবিসহ বিভিন্ন বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারার প্রেক্ষাপটে সেনা সহায়তা নেওয়া হয়। নাগরিক অধিকারকে স্থগিত করে একাধিকবার কারফিউ প্রয়োগ করতে হয়।

পরিস্থিতির অবনতিতে আমরা ভয়ে কম্পমান প্রভাবশালী মন্ত্রীদের মুখ দেখেছি। ব্রিটিশ ম্যাগাজিন ‘দ্য ইকোনমিস্ট’-এর আখ্যা দেওয়া ‘এশিয়ার আয়রন লেডি’ শেখ হাসিনার কম্পিত কণ্ঠস্বরও আমরা দেখেছি। ‘আয়রন লেডি’ বলা হতো মার্গারেট থ্যাচারকে। ব্রিটেনের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হয়েও যে ভাবে শক্ত হাতে, বিভিন্ন বাধা অগ্রাহ্য করে তিনি ব্রিটেনের অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক সংস্কার এনেছিলেন, তার জন্য তিনি আয়রন লেডি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। দ্য ইকোনমিস্ট শেখ হাসিনাকে মার্গারেট থ্যাচারের সেই উপাধি দিয়েছিল এশিয়ার আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে। সেই শেখ হাসিনাকেও আন্দোলনের পুরোটা সময় কম্পিত ও বিব্রত দেখা গেছে। এবং শেষ পর্যন্ত তার চরিত্রবিরুদ্ধ ভাবে তাকে বাধ্য হতে হয়েছে দেশত্যাগের।

২০২৪ সালের এই ছাত্র-অভ্যুত্থানের শুরু হয়েছিল কোটা নিয়ে। কোটা বাতিলের পর এরপর এটা রূপ পেয়েছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমা চাওয়া, কয়েকজন মন্ত্রীর পদত্যাগসহ ৯ দফা দাবিতে। কিন্তু সরকারের অনমনীয় মনোভাবে প্রধানমন্ত্রী ক্ষমা চাননি, কোন মন্ত্রী পদত্যাগ করেননি, এবং দাবি আদায়ের প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়নি। অথচ এই দাবিগুলো পূরণ কঠিন কিছু ছিল না সরকারের জন্যে। সরকারের গোঁয়ার্তুমি, এবং দেশব্যাপী বিপুল প্রাণের অপচয়, অরাজকতা শেষে সরকার যখন আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছিল, তখন আন্দোলনকারীরা সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবি উপস্থাপন করে। এবং এই এক দফা দাবি আদায়ের কর্মসূচির তৃতীয় দিনেই পদত্যাগ করতে হলো প্রধানমন্ত্রীকে, সরকারকে।

ছাত্র আন্দোলনের এই বিপুল বিজয়ের পর দেশ এখন কীভাবে পরিচালিত হবে এটা এখনো পরিস্কার নয়। জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ‘নিজে দায়িত্ব নিয়ে’ বলেছেন, দেশ এখন চলবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মাধ্যমে। এজন্যে তারা রাষ্ট্রপতির সঙ্গে পরামর্শ করবেন।

এখন দেখার বিষয় ‘দায়িত্ব’ শব্দের অর্থ ও ব্যাপ্তি কেমন?