আঞ্চলিক ও শ্রেণি বৈষম্য আইয়ুবের উন্নয়নে বৃদ্ধি পেয়েছিল

  • সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

বাংলার ইতিহাস পলাশীর যুদ্ধের পরে বড় রাজনৈতিক ঘটনা সাতচল্লিশের দেশভাগ। উভয় ঘটনাই পরাজয়ের। সাতচল্লিশের পরে উনসত্তরে যে গণঅভ্যুত্থান সেটি কিন্তু পরাজয়ের নয়, জয়েরই। এই অভ্যুত্থান নিয়ে বেশ কিছু লেখা আমরা পেয়েছি, আরও পাবো, পাওয়া প্রয়োজন। কারণ উনসত্তরে তখনকার পূর্ব পাকিস্তান একটি ক্রান্তি-বিন্দুতে এসে দাঁড়িয়েছিল। প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল ঘটনা-প্রবাহ এর পরে কোন দিকে মোড় নেবে। এটা বোঝা যাচ্ছিল যে, পাকিস্তান নামে যে পুঁজিবাদী আমলাতান্ত্রিক একটি রাষ্ট্র গড়বার চেষ্টা চলছিল, সেটা সফল হবে না। পাকিস্তান ভাঙবে। জিজ্ঞাসাটা ছিল কীভাবে, কখন, এবং কাদের নেতৃত্বে?

ভাঙবে যে সেটা ছিল নিশ্চিত, কারণ পূর্ববঙ্গের মানুষ অসন্তুষ্ট হয়ে উঠেছিল। দ্বিতীয় কারণ রাষ্ট্রটি ছিল অবাস্তবিক। তার দুই অংশের মধ্যে ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা ছিল ১২০০ মাইলের, এবং মাঝখানে অবস্থান ছিল বৈরী রাষ্ট্র ভারতের। ভাষা ও সংস্কৃতিতে দুই অঞ্চলে পার্থক্য ছিল; ধর্মীয় ঐক্য থাকলেও ধার্মাচরণে বিস্তর দূরত্ব ছিল।

বিজ্ঞাপন

উনসত্তরের অভ্যুত্থানের চরিত্রটি ছিল জাতীয়তাবাদী। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে অনেকগুলো দ্বন্দ্ব ছিল, কিন্তু প্রধান দ্বন্দ্ব হয়ে উঠেছিল পাকিস্তানি জাতীয়তাদের সঙ্গে বাঙালি জাতীয়তাবাদের। পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ ছিল ধর্মভিত্তিক, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ভাষাভিত্তিক। এই দুই জাতীয়তাবাদ একই রাষ্ট্রের ভেতর হয়তো থাকতে পারতো, যদি শাসকগোষ্ঠী আপোস করতো। কিন্তু আপোস সম্ভব ছিল না। ভৌগোলিক দূরত্ব বিচ্ছিন্নতার কারণ ছিল বৈকি, কিন্তু তার চেয়েও বড় কারণ ছিল পাকিস্তানি শাসকদের শোষণকারী অবস্থান। এই শাসকেরা রাষ্ট্রটিকে একটি অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চাইছিল; যেটা পূর্ববঙ্গের মানুষের পক্ষে মেনে নেওয়াটা ছিল অসম্ভব।

রাষ্ট্রীয় ঐক্যের জন্য একটি জাতিসত্তা গড়ে তোলা আবশ্যক ছিল, যাতে বলা যায় আমরা সবাই একই জাতি, একে অপরের আত্মীয়, এখানে বিরোধ অপ্রয়োজনীয়, এবং অন্যায়ও। ভারতীয় মুসলমানরা একটি স্বতন্ত্র জাতি এই দাবিকে কেন্দ্র করেই পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা। কিন্তু সাতচল্লিশের স্বাধীনতার পর ভারতের মুসলমানদের এক তৃতীয়াংশই তো রয়ে গিয়েছিল ভারতে, এবং তাদের জন্য জাতীয় পরিচয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল ভারতীয়। কাজেই পাকিস্তান ভারতীয় মুসলিম জাতির আবাসভূমি এই দাবিটা করা যাচ্ছিল না। এর চেয়েও বড় সত্য ছিল এই যে, জাতি গঠনে ধর্ম নয় ভাষাই হচ্ছে প্রধান উপাদান। ধর্ম যদি প্রধান উপাদান হতো তাহলে বিশ্বের সকল মুসলমান একটি জাতিতে পরিণত হতো, যেটি ঘটেনি, ঘটা সম্ভবও ছিল না।

বিজ্ঞাপন

তাছাড়া পাকিস্তানের নাগরিকদের মধ্যে অমুসলিমরাও ছিলেন। তাই পাকিস্তানের ‘জাতির পিতা’ বলে কথিত মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করতে চেয়েছিলেন; তাঁর আশা ছিল যে ওই ভাষার ভিত্তিতে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠবে। কিন্তু পাকিস্তানের জনসংখ্যার শতকরা ৫৬জনই তো ছিল বাঙালি; তারা কেন উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নেবে? মেনে নেয় নি। বায়ান্নতেই তাই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এক অভ্যুত্থান ঘটে, যার পরিণতিতে উর্দুর সঙ্গে বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া হয়।

কিন্তু তাতে দুই অংশের ভেতর শাসক-শাসিতের যে সম্পর্কটা প্রতিষ্ঠা পাচ্ছিল তা দূর হলো না। পাকিস্তানের প্রশাসনিক রাজধানী ছিল পশ্চিমে; বাণিজ্যিক রাজধানীও সেখানেই। শিল্প-কারখানায় কিছু বিনিয়োগ পূর্ববঙ্গে ঘটছিল বটে, কিন্তু মালিকানা ছিল অবাঙালিদের। শাসনকার্য চলতো সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের হাত দিয়ে। উভয় ক্ষেত্রেই উচ্চপদস্থরা প্রায় সবাই ছিল অবাঙালি।

রাষ্ট্রের সর্বাধিক নির্ভরতা ছিল সামরিক বাহিনীর ওপর। সে-বাহিনীতে বাঙালির সংখ্যা ছিল একেবারেই নগণ্য। উচ্চপর্যায়ের আমলাদের মধ্যেও বাঙালিদের খুঁজে পাওয়া ছিল খুবই কঠিন। জাতীয় বাজেটের বরাদ্দ তিনভাগে ভাগ করা হতোÑ দুই ভাগ দুই প্রদেশের, একভাগ কেন্দ্রের। কেন্দ্রের যা বরাদ্দ তার সিংহ ভাগই খরচ হতো পশ্চিমে। অথচ আয়ের প্রধান উৎস ছিল পূর্ববঙ্গ। পূর্ববঙ্গের জন্য যেটুকু বরাদ্দ থাকতো তাও ঠিক মতো এসে পৌঁছাতো না।

জিন্নাহ সাহেব পাকিস্তানের সুরক্ষার জন্য ভরসা করতেন প্রধানত সেনাবাহিনীর ওপর। রাষ্ট্রটি ছিল এমনই অবাস্তবিক যে এর সংবিধান রচনার জন্য সময় লেগেছিল নয় বছর। আর ১৯৫৬-তে যে সংবিধানটি শেষ পর্যন্ত তৈরি হয়েছিল, সেটি ছিল সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক। পূর্ববঙ্গের ছাপ্পান্ন জনের মাথা ছেঁটে সমান করা হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানের চুয়াল্লিশ জনের; এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অপাঞ্জাবিদেরকে পাঞ্জাবিদের শাসনাধীনে নিয়ে আসার জন্য এক ‘ইউনিট’ গঠন করা হয়েছিল।

বস্তুত পাকিস্তানে ছিল পাঁচটি জাতির বসতিÑ বাঙালি, পাঞ্জাবি, সিন্ধী, বেলুচ ও পাঠান। তবে পাঞ্জাবিরাই শাসক শক্তিতে পরিণত হয়েছিল, কারণ সামরিক বাহিনীর শতকরা ৭২ জনই ছিল ওই জাতির। কিন্তু সামরিক বাহিনী যেহেতু ছিল সর্বাধিক ক্ষমতাধর, তাদের ক্ষমতা খর্ব হবে মনে করে তারা ওই সংবিধানও গ্রহণ করতে রাজি হয়নি।

বিশেষ করে এই শঙ্কায় যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ক্ষমতা চলে যাবে বামপন্থিদের হাতে। ১৯৫৪তে পূর্ববঙ্গের নির্বাচনে ওই রকমের ঘটনা ঘটতে তারা দেখেছে। বামপন্থিরা ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করে পশ্চিম পাকিস্তানেও শক্তিশালী হয়ে উঠছিল, অপাঞ্জাবিদের ভেতর তো বটেই এমনকি পাঞ্জাবিদের ভেতরেও ন্যাপের প্রতি সমর্থন দেখা যাচ্ছিল। তাই সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত দেরি না করে ১৯৫৮-র অক্টোবরেই সুশৃঙ্খল বাহিনীটি সেনাপতি আইয়ুব খানের নেতৃত্বে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নেয়; বরং সর্বজনীন ভোটাধিকার হরণ করে ‘বুনিয়াদী গণতন্ত্র’ ব্যবস্থা চালু করে।

এখানে স্মরণ করা যেতে পারে যে ১৯৪৬-এ স্বাধীনতার নামে দ্রুত গতিতে যে দেশভাগ করা হয়েছিল তার পেছনে একটা বড় কারণ ছিল আমেরিকানদের চাপ। আমেরিকানরা তখন নতুন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, এবং তারা বাধ্য হয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নকে প্রধান শত্রু হিসেবে দেখতে। ভারতীয় জনগণের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন যাতে কমিউনিস্টদের প্রভাবাধীন না হয়ে পড়ে ওই শঙ্কাতে আমেরিকানরা কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ, জাতীয়তাবাদী দুই বুর্জোয়া দলের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া হোক এটাই চেয়েছে।

পাকিস্তান আমলে বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের দাবির প্রতি আমেরিকানরা সমর্থন দিতে পারে এমন আশা সৃষ্টির পেছনেও আমেরিকানদের কমিউনিস্ট-ভীতি কাজ করেছে। আর এই ধারণাও ভ্রান্ত নয় যে, পাকিস্তান রাষ্ট্রটি সোভিয়েত রাশিয়ার ‘সম্প্রসারণে’র সম্ভাবনার বিরুদ্ধে প্রাচীর হিসেবে কাজ করবে এমন চিন্তাও আমেরিকানদের ছিল।

জিন্নাহ থেকে শুরু করে পাকিস্তানের সকল শাসকই কমিউনিস্টদেরকে প্রধান শত্রু বলে মনে করেছেন, এবং তাদেরকে দমন করতে তৎপর হয়েছেন। ব্রিটিশ শাসকদের বেলাতেও দেখা গেছে যে, জাতীয়তাবাদীরা ছিলেন শাসকদের প্রতিদ্বন্দ্বী, কমিউনিস্টরা ছিলেন শত্রু।

আইয়ুব খানের আস্থা ছিল উন্নয়নের ওপর। এবং উন্নয়ন যে তিনি ঘটাননি তাও নয়; কিন্তু যতই উন্নয়ন ঘটাচ্ছিলেন ততোই বৃদ্ধি ঘটছিল বৈষম্যের। আঞ্চলিক বৈষম্য ও শ্রেণি বৈষম্য দু’টোই উন্নয়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। বৈষম্য সৃষ্টির একটি উপাদান অবশ্য ছিল সেনাবাহিনীর জন্য ব্যয়।

একটি হিসাব বলছে যে সেনাবাহিনীর জন্য ব্যয়ের পরিমাণ ১৯৪৬-৪৭-এ ছিল জাতীয় বাজেটের শতকরা ৫০ ভাগের কাছাকাছি; ১৯৫০-এ সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ৫১ শতাংশে; ১৯৬১’তে উঠে যায় ৫৮.৭ শতাংশে। আর এই ব্যয়ের মূল ভাগ ঘটে পশ্চিম পাকিস্তানেই। আইয়ুবের শাসনামলেই বিখ্যাত সেই ২২ পরিবার গড়ে ওঠে, যারা ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংক-ইনসিওরেন্স তো বটেই রাজনীতিতেও প্রতাবশালী ছিল; এবং যাদের মধ্যে একটি মাত্র পরিবার ছিল বাঙালি, তাও আবার প্রান্তিক অবস্থানেই।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়