ডিজিটাল প্রাংক, অ্যানালগ মশকরা
সরকারি সিদ্ধান্তে দেশে ‘বন্ধ’ রয়েছে ফেসবুকসহ কিছু সামাজিক মাধ্যম। বন্ধ থাকা এই মাধ্যমে তবু সক্রিয় রয়েছেন আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। বন্ধ ফেসবুক তার জন্যে খোলা। সরকারই বন্ধ করে রেখেছে এই মাধ্যম, এবং বন্ধের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন যার মন্ত্রণালয়ের কাজ, তিনি সেই মন্ত্রণালয়েরই প্রতিমন্ত্রী।
কোটা আন্দোলনকে ঘিরে দেশের অস্থিতিশীল অবস্থা থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে সরকার কিছুদিন ইন্টারনেট বন্ধ করে রেখেছিল। বন্ধ হয়ে থাকা এই সময়ে পুরো দেশই স্থবির হয়ে পড়েছিল। তথ্য-প্রযুক্তিভিত্তিক যোগাযোগই কেবল নয়, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, আর্থিক প্রতিষ্ঠান সব বন্ধ ছিল। বন্ধের ওই সময় ছিল আবার নির্বাহী আদেশে সাধারণ ছুটিও। ফলে বলা যায়, ক্যালেন্ডার পাতায় ওই দিনগুলো থাকলেও সে দিনগুলো ছিল আদতে ভুলে যাওয়ার মতো দুঃখের দিন। ভুলে যাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ বোধহয় নিয়ন্ত্রণহীন দেশে সংঘাত-সংঘর্ষ-আগুন আর অগণন প্রাণের অপচয়।
ইন্টারনেট বন্ধের শুরু মূলত ১৭ জুলাই। ওই দিন মধ্যরাত থেকে মুঠোফোনে ফোর-জি নেটওয়ার্ক বন্ধ করায় দেশের মোবাইল ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হয়ে যায়। পরের দিন ১৮ জুলাই রাত ৯টার দিকে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগও বন্ধ হয়ে যায়। এর পাঁচ দিন পর ২৩ জুলাই রাতে সীমিত পরিসরে পরীক্ষামূলক ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা চালু করা হয়। ২৪ জুলাই সারা দেশে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট চালু হয়। ২৮ জুলাই বেলা ৩টা থেকে মুঠোফোনে ফোর-জি ইন্টারনেট চালু করা হয়। ব্রডব্যান্ড ও মোবাইল ইন্টারনেট চালু হলেও ফেসবুকসহ মেটার মালিকানাধীন অ্যাপগুলো ও টিকটক বন্ধ রাখা হয়েছে।
ইন্টারনেট বন্ধ নিয়ে পরস্পরবিরোধী তথ্য আছে। তথ্য নয়, আসলে এটা বক্তব্য। প্রতিমন্ত্রী, বিটিআরসি, মোবাইল অপারেটররা যে বক্তব্য দিয়েছে তাতে বিষয়টি নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়েছে, বন্ধ করা হয়নি; এমন এক অদ্ভুত অবস্থা! মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধের পরদিন ১৭ জুলাই টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘জাতীয় ও নাগরিক নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হচ্ছে।’ ২২ জুলাই প্রতিমন্ত্রীর নামে মুঠোফোন গ্রাহকদের দেওয়া এক খুদে বার্তায় বলা হয়, ‘সন্ত্রাসীদের অগ্নিসংযোগের কারণে ডেটা সেন্টার পুড়ে যাওয়া এবং আইএসপির তার পুড়ে যাওয়ার কারণে সারা দেশে ইন্টারনেট সেবা ব্যাহত। মেরামত করতে সময় লাগবে।’
২৭ জুলাই জুনাইদ আহমেদ পলক আরেক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করেনি। মহাখালীতে তিনটি ডেটা সেন্টারে আইএসপিদের ৭০ শতাংশ সার্ভার থাকে। দেশের ৩৪টি আইআইজির মধ্যে ১৮টির ডেটা এই তিনটি সেন্টারে হোস্ট করা। দুই দিন পর তারা জানতে পেরেছেন ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের কাঁচপুরে সাবমেরিনের কিছু তার ওপরের দিকে ছিল, সেগুলো পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।’
এদিকে, দেশের মোবাইল অপারেটর গ্রামীণফোন, বাংলালিংক, রবি পৃথক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ইন্টারনেট বন্ধ রাখা হয়েছে।’ গ্রামীণফোনের মালিক প্রতিষ্ঠান টেলিনর, প্রতিষ্ঠানটির এশিয়া আঞ্চলিক শাখা ২০ জুলাই এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, বাংলাদেশে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশে মোবাইল ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করা হয়েছে। গ্রামীণফোন তাদের বিবৃতিতে জানিয়েছে বাংলাদেশে থ্রি-জি ও ফোর-জি ইন্টারনেট ১৭ জুলাই বন্ধের নির্দেশ দেয় কর্তৃপক্ষ। বাংলালিংকের পক্ষে বলা হয়েছে, দেশের চলমান পরিস্থিতি বিবেচনায় মোবাইল ইন্টারনেট সেবা সাময়িকভাবে বন্ধ আছে। রবির পক্ষ থেকে বলা হয়, জরুরি পরিষেবা হিসেবে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ রাখার বিষয়টি কখনোই অপারেটরদের এখতিয়ারভুক্ত নয়। দেশের চলমান পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার মোবাইল ইন্টারনেট সেবা সাময়িকভাবে বন্ধ রেখেছে।
ইন্টারনেট বন্ধ নিয়ে এই পরস্পরবিরোধী তথ্য কিংবা বক্তব্যে যা ওঠে এসেছে তাতে এখানে সরকারের নির্দেশনা যে থাকছে, সেটা বলে দেওয়া যায়। এছাড়া রাজধানীর মহাখালীর খাজা টাওয়ার, যেখানে বিভিন্ন ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের সরঞ্জাম রয়েছে, সেখানে এবার আগুন লাগেনি। পাশের ভবনে আগুন লাগলেও এই ভবনের ব্যাপক ক্ষতি হয়নি। অথচ গত বছরের অক্টোবরে ওইভবনে আগুন লেগে তিনজনের মৃত্যু হলেও ওই সময়ে দেশে ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়নি।
ইন্টারনেট নিয়ে এই গুমট অবস্থার পর আবার আছে ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপ নিয়ে আরও ঝামেলা। দেশে বন্ধ সামাজিক মাধ্যম ফেসবুক। অথচ আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক দিব্যি ফেসবুক চালাচ্ছেন। তার ভাষায়, তিনি গুজব প্রতিরোধে কাজ করছেন ফেসবুকে। কেবল প্রতিমন্ত্রীই নন, আরও কয়েকজন সরকার-ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান বন্ধের সময়ে ফেসবুক চালু রেখেছেন। অথচ সরকারি নির্দেশনা মানার দায়িত্ব প্রথমে ছিল তাদেরই। বাংলা ভাষায় খুব সুন্দর এবং কার্যকর একটা প্রবচন আছে—‘আপনি আচরি ধর্ম শিখাও অপরে’, অর্থাৎ কোনো উপদেশ অন্যকে দেওয়ার আগে নিজে তা পালন করতে হবে। দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, উপদেশ দেওয়ার বিষয়, প্রতিপালনের নয়; এবং এটা আমরা আরও একবার আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকসহ অন্যদের দেখে বুঝতে পারছি।
এটাকে কি ডিজিটাল প্রাংক বলা যায়? প্রাংক শব্দের অর্থ যদিও তেমন মজার কৌশল যা অন্যের ক্ষতির কারণ নয়। এখানে তবে অন্য অবস্থায় পৌঁছেছে, যেখানে সরকার ও সরকারের দপ্তরগুলো মানুষের সঙ্গে সচেতনভাবে না হলেও ডিজিটাল প্রাংক করতে গিয়ে বড় ক্ষতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। যার বিশাল ক্ষেত্র আর্থিক খাত। ডিজিটাল গুজব ঠেকানোর নামে অ্যানালগ গুজবের মধ্যে দেশকে ঠেলে দিয়ে, এই সময়ে সবকিছু বন্ধ করে দিয়ে আর্থিক খাতের বিশাল ক্ষতি করল সরকারই।
ডিজিটাল প্রাংক নিয়ে কথা বললাম, এবার বলি ‘অ্যানালগ মশকরা’ নিয়ে। মশকরা শব্দটি আলোচনায় এসেছে হাইকোর্টের একটি রিটের শুনানিতে বিচারপতির মন্তব্যের সূত্র ধরে। গতকাল (২৯ জুলাই) বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি এস এম মাসুদ হোসেন দোলনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ কোটা আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে খাইয়ে সেই ছবি প্রকাশ করে ‘জাতির সঙ্গে মশকরা করা হয়েছে’ বলে মন্তব্য করেন। হাইকোর্টের এই মন্তব্যটি এসেছে মূলত ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদের এক ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে। ২৮ জুলাই হারুন অর রশীদ কোটা আন্দোলনের সমন্বয়কদের সঙ্গে এক টেবিলে বসে নাস্তা করার কয়েকটি ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে লেখেন, ‘কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন। তাই ওদের ডিবি কার্যালয়ে এনে তাদের সঙ্গে কথা বললাম।’ হারুন অর রশীদের এমন আপ্যায়নের ঘটনাগুলো এবারই প্রথম নয়, এর আগে থেকে তিনি এইধরনের কাণ্ড করে আসছেন। বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় থেকে শুরু করে সংস্কৃতি অঙ্গনসহ নানা অঙ্গনের বিভিন্নজনকে তিনি নিজের কার্যালয়ে এমন আহারপর্বে সঙ্গী করেছেন। ফেসবুকে নানা সময়ে তিনি এবং অন্যরা সে সব ছবি দিয়েছেন। এসব নিয়ে দেশব্যাপী তোলপাড় হলেও শীর্ষ পর্যায়ের কেউ এনিয়ে কোন কথা বলেনি।
ডিবিপ্রধানের এমন কাণ্ড এতদিন স্রেফ সামাজিক মাধ্যমে আলোচিত হলেও এবার এনিয়ে কথা বলেছেন হাইকোর্ট। রাষ্ট্রপক্ষকে উদ্দেশ্য করে হাইকোর্ট বলেন, ‘ডিবি অফিসে যাকে তাকে ধরে নিয়ে যাবেন, তারপর খাবার টেবিলে বসাবেন। এভাবে জাতির সঙ্গে মশকরা করবেন না।’
হাইকোর্ট মশকরা শব্দটিকে সামনে এনেছেন। এর সূত্র ধরে বলা যায়, সরকার, সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ মানুষের সঙ্গে নানা ধরনের মশকরা করছেন, যার কিছুটা স্রেফ মশকরার পর্যায়ে না থেকে মানুষের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কিছু ডিজিটাল প্রাংক অথবা মশকরা ও ডিবি কার্যালয়ে ধরে নিয়ে গিয়ে খাওয়ানোর মতো কিছু অ্যানালগ মশকরা, এবং এরপর ‘বন্ধ থাকা’ ফেসবুকে সেই সব ছবি ছেড়ে দেওয়ার মতো মশকরা মানুষের সম্মান নিয়ে টানাটানির নামান্তর। এসব বন্ধ করতে বলছেন হাইকোর্ট। আমরা সাহস সঞ্চয় করে বলতে পারিনি যা এতদিন, সেটাই উচ্চারিত হয়েছে উচ্চ আদালত থেকে।
এবার আদালতের হুঁশিয়ারিতে যদি মশকরাগুলো বন্ধ হয়!