ভিন্নমতের স্বর এবং রাজনৈতিক আশ্রয়ের বাস্তবতা

  • আবু মকসুদ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

প্রবাসজীবনে যারা আছেন, তাদের কাছে ‘পলিটিক্যাল এসাইলাম’ শব্দ দুটি অত্যন্ত পরিচিত। গুগলে এর বাংলা অনুবাদ ‘রাজনৈতিক আশ্রয়’। তবে এই অনুবাদে শব্দ দুটির প্রকৃত অর্থ প্রতিফলিত হয় না। ক্যামব্রিজ ডিকশনারির ব্যাখ্যা অনুসারে, পলিটিক্যাল এসাইলাম বলতে বোঝায় ‌‘কোনো দেশের সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সুরক্ষা, যা একজন ব্যক্তির রাজনৈতিক কার্যকলাপের কারণে তার নিজের দেশে জীবনযাপন অসম্ভব হয়ে পড়ে।’ কিন্তু এই ব্যাখ্যাতেও শব্দ দুটির গভীর তাৎপর্য স্পষ্ট হয় না।

তাহলে পলিটিক্যাল এসাইলাম আসলে কী? একটি ছবি দিয়ে বুঝিয়ে বলি: ডিবি হারুন কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় কয়েকজনকে নাস্তা করাচ্ছে। নাস্তার পর তারা সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলন স্থগিত বা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছে।

বিজ্ঞাপন

কিছুদিন পরেই দেখা যাবে, এদের কেউ কেউ অন্য কোনো দেশে আশ্রয় নিয়েছে। তখন তাদের কাছে প্রশ্ন করলে তারা উত্তর দেবে, ‘আমাদের জোরপূর্বক ধরে নিয়ে গিয়ে বিবৃতি দিতে বাধ্য করা হয়েছিল। প্রাণের ভয়ে পালিয়ে এখানে এসেছি।' অন্যদিকে, আন্দোলনের আরেক পক্ষ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এই বিবৃতিও লক্ষণীয়। তারাও নজরে থাকতে চাচ্ছে প্রয়োজনে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারে। তাদেরকেও কিছুদিন পর অন্য দেশে দেখা গেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

পলিটিক্যাল এসাইলামের সবচেয়ে মজার বিষয় হলো সরকারের সাথে বসে নাস্তা করার পর সরকারের সমালোচনায় মুখর হওয়া। কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে। যদিও সবাইকে একই কাতারে বসানো উচিত নয়, কিছু পেছনের খবর জানা থাকায় বলা যায়, অনেক অবৈধ অধিবাসীর জন্য এই আন্দোলন একটা বিরাট সুযোগ এনে দিয়েছে। এরা প্রথম সারিতে থেকে প্রতিবাদে অংশগ্রহণ করেছে, যাতে জাতীয় কোনো খবরে তাদের মুখ দেখা যায় এবং প্রয়োজনে সেই খবর কাজে লাগিয়ে নিজের উদ্দেশ্য সাধন করা যায়।

অনেকেই আন্তরিকভাবে সরকারের অন্যায়ের সমালোচনা করছে, আবার কেউ কেউ এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অন্য দেশে নতুন জীবন শুরু করার চেষ্টা করছে। অবশ্যই বাংলাদেশের সরকার ভিন্নমতকে দমন করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। বাংলাদেশের ভিন্নমতের মানুষ নিগৃহীত হচ্ছেন না—এটা ঠিক নয়।

প্রকৃতপক্ষে, বাংলাদেশে ভিন্নমতের কারণে মানুষ নিগৃহীত হচ্ছে। এমনকি গ্রেফতার, নির্যাতন এবং গুম হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে। একদিকে সরকারের সমালোচনার সুযোগ নেই, অন্যদিকে কেউ যদি সমালোচনা করেও, তাকে হয়রানি বা নানাভাবে দমনের চেষ্টা করা হয়। এ অবস্থায় অনেকেই বিদেশে আশ্রয়ের জন্য পলিটিক্যাল এসাইলামের সুযোগ নিচ্ছেন।

আমার দেখা মতে, কিছু মানুষ দেশে থাকাকালে সরকারের প্রতি খুবই অনুগত ছিল। তারা সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পেয়েছে। কিন্তু কিছুদিন পর এদের মধ্যেই কেউ কেউ সরকারের সমালোচক হয়ে উঠেছে। তাদের বক্তব্যের সারাংশ হলো, এই সরকার অত্যন্ত ভয়ংকর। কিন্তু বাস্তবিক কারণটা হলো, তারা পলিটিক্যাল এসাইলাম নামের সোনার হরিণটি পেতে চায়। ইউরোপীয় দেশে বৈধ হওয়া প্রায় অসম্ভব, একমাত্র উপায় হলো দেশের প্রসিকিউশন থেকে পালিয়ে আসা এবং তা প্রমাণ করা।

এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, অনেকেই সত্যিই নিগৃহীত হচ্ছে এবং প্রকৃত আশ্রয়ের প্রয়োজন তাদের আছে। তারা বিদেশে গিয়ে পলিটিক্যাল এসাইলামের মাধ্যমে নিরাপত্তা এবং নতুন জীবনের সুযোগ পাচ্ছে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ার মধ্যে কিছু অসাধু ব্যক্তিও আছেন, যারা শুধুমাত্র সুবিধা নিতে চাইছেন। এই বিভাজনটি পরিষ্কারভাবে বোঝা জরুরি, যাতে প্রকৃত নিগৃহীতরা সুবিচার পায় এবং অসাধুরা সুযোগ নিতে না পারে।

এভাবেই পলিটিক্যাল এসাইলামের প্রক্রিয়াটি বিভিন্নভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, যার মধ্যে সত্য এবং মিথ্যার একটি মিশ্রণ রয়েছে। এটি একটি জটিল এবং স্পর্শকাতর বিষয়, যা আরও গভীর আলোচনার দাবি রাখে।

লেখক : যুক্তরাজ্য প্রবাসী, ছোটকাগজ ‘শব্দপাঠ’ সম্পাদক