চতুর বেজি ও দুর্নীতি সাপের ক্ষমতানুপাত!

  • প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত,  প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম

ছবি: সংগৃহীত, প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম

বেশ কিছুদিন আগে উপকারী ও ক্ষতিকর কিছু প্রাণীর নাম উল্লেখ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় আলোচনা শুরু হয়েছিল। সে আলোচনার ঢেউ সবকিছু ছাড়িয়ে মহান সংসদের তাপানুকূল কক্ষেও উত্তাপ ছড়াতে দেরি করেনি।

সেদিন একজন তরুণ সংসদ সদস্য তার সংসদীয় মাইকে অগ্নিঝরা বক্তব্যে নানা সমস্যার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘...রাসেল ভাইপার সাপ চলে আসছে মাননীয় স্পিকার… কিন্তু সেই পরিমাণ বেজি নাই’।

বিজ্ঞাপন

প্রসঙ্গত, আমাদের সমাজে সাপের উৎপাত বেড়ে গেছে ঠিকই কিন্তু সেই অনুযায়ী বেজির তৎপরতা নেই। আসলে কি তাই!

হয়ত-বা তাই হবে! একদিন আগে দুপুরবেলা ঝুম বৃষ্টির একটানা মাধুর্য্যে দোতলার বারান্দায় বসে বাগানের নুয়ে পড়া সব্জিগাছগুলোর দিকে বার বার তাকাচ্ছিলাম। কাছেই কিছু পাখি বেশ চেচামেচি করছিল। ঢেঁড়শবেডের ঘন সবুজ গাছের নিচে কী যেন ঘোঁৎ ঘোৎঁ করে নড়াচড়া করছে। একটু ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম দুটো বেজি সেখানে নিজেদের লুকিয়ে কী যেন খুঁজছে। ওরা নিচের বারান্দায় বিড়ালের জন্য পাত্রে রাখা খাবারে মাঝে মাঝে ভাগ বসাতে আসে। তবে সেটা রাতের বেলা।

বিজ্ঞাপন

কয়েকদিন ধরে একটানা বৃষ্টি চলায় আশেপাশের জঙ্গলে পানি জমে গেছে। খাবারের অভাব ঘটায় হয়ত আজ দিনের বেলা বাগানে ঢুকে পড়েছে ওরা। হঠাৎ বেজি দেখে মনে করলাম থাক্, ওরা বেশ উপকারী প্রাণী। বেজি থাকলে সে এলাকায় সাপ আসতে চায় না। বেজিকে সাপেরা খুব ভয় পায়। সাপে-নেউলে সম্পর্কটা কখনই মধুর নয়! তবে বেজির আনাগোনা না থাকলে সাপেরা নির্ভয়ে সেখানে বিচরণ করার সাহস পায়। আর বেজি থাকলে গোপনে বিচরণ করে, দেখামাত্র সাপ দৌড়ে পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করে থাকে। সাপ বেজিকে সহজে কামড়াতে পারে না।

তবে আজকাল কী যেন হয়েছে! বেজি-সাপ একই এলাকায় সদর্পে বাস করে। কেউ কাউকে তাড়া করে না। উভয়কেই বেশ তাজা ও শক্তিশালী চেহারায় একসঙ্গে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়; যা মানুষ অথবা অন্যান্য নিরীহ প্রাণীর জন্য সুখকর নয়। যেটাকে বলা যায়- আসল চরিত্রের বেজিরা কমে গেছে অথবা দৃশ্যত নেই! সেটাই হয়ত মানুষরূপী বেজি ও সাপের উপমা দিয়ে বলতে চাচ্ছিলেন সেই তরুণ সংসদ সদস্য।

কয়েক মাস ধরে রাসেল’স ভাইপার আক্রমণে সারাদেশে অনেক মানুষ হতাহত হয়েছেন। এজন্য চরম আতঙ্ক ছড়িয়েছে জনমনে। রাসেল’স ভাইপার নিয়ে সব ধরনের গণমাধ্যমে প্রচারণা চলেছে।

কেউ কেউ সম্প্রতি দেশের সীমান্ত ভেদ করে ভারতের সঙ্গে নানাদিক দিয়ে ট্রেন চলাচলের সমঝোতা স্মারককে উদ্দেশ করে বৈদেশিক রাসেল’স ভাইপার আগমনের ভয়ঙ্কর রুট হিসেবে আগাম সতর্কবাণী হিসেবে প্রচার করতে তৎপর রয়েছেন।

ভবিষ্যতের বিদেশি রেলগাড়িগুলোকে ভয়ঙ্কর ‘সাপগাড়ি’ দেখিয়ে প্রচারণায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন অনেকে। তারা মনে করছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) মতো সীমান্ত চলাচলে ততটা উদার ও সভ্য হয়নি উপমহাদেশের মানুষ। কারণ, সেসব দেশ পরস্পরকে সমমর্যাদায় সমীহ করে। তারা সীমান্তে পশু-পণ্য পাচার নিয়ে কেউ পাহারা বসানোর প্রয়োজন মনে করে না। নিরীহ মানুষকে পাখির মতো হত্যা করে না। তারা আঞ্চলিক ট্রানজিট দিয়ে নিজেদের পর্যটন, ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রসারের মাধ্যমে সবাই সমভাবে আয় করে। আমরা ট্রানজিটের নামে আসলে করিডোর খুলে একচেটিয়া লাভ করতে দিয়ে নিজ নিরাপত্তা ক্ষুণ্ণ করেছি। তাই রাসেল’স ভাইপারের মতো সমঝোতা স্মারকের ভূ-রাজনৈতিক তাৎপর্য কোনো ফেলনা বিষয় নয়।

আমাদের নদীতীরবর্তী জেলা ও এর চরাঞ্চলে যে বিষধর রাসেল’স ভাইপারের আক্রমণ শুরু হয়েছে, এদের বিষ-ক্ষমতা নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা রিপোর্ট থেকে তথ্য পেশ করে মোটিভেশন চালানো হচ্ছে।

কেউ কেউ পৌরাণিক কাহিনী জুড়ে দিয়ে বলছেন- রাসেল’স ভাইপার মেরে ফেললে মানুষের বাচ্চারাও বেঁচে থাকবে না। কেউ বলছেন, এই সাপ কাটলে রোগীকে ওঝার কাছে নিয়ে কালক্ষেপণ করা উচিত নয়। বরং রোগীকে দ্রুত হাপাতালে সঠিক ভেনম ইঞ্জেক্ট করতে পারলে ৭০ ভাগ মানুষ বেঁচে যায়। তবুও অনেকেই এই সাপ মারার জন্য জোর প্রচারণা চালাচ্ছেন।
তবে হ্যাঁ, জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে হলে নির্বিচারে কোনো প্রাণী নিধন করা থেকে বিরত থাকতে হবে। কৃষি জমিতে ব্যাঙ, সাপ না থাকলে কয়েক বছরের মধ্যে পোকামাকড় ও ইঁদুরের দৌরাত্ম্য বেড়ে গিয়ে মানুষের জন্য শস্যকণা অবশিষ্ট থাকবে না। এমনকী ফসলের অভাবে দুর্ভিক্ষও শুরু হয়ে যেতে পারে। যতই বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া চালাই না কেন, প্রাকৃতিক ভারসাম্য না থাকলে ক্ষতি অনিবার্য।

সাধারণত, বেজি-শিয়াল মানুষকে দেখলে নিজেরাই পালায়। এদেরকে মানুষ সচরাচর ভয় পায় না। কোনো কারণে বেজি-শিয়াল মানুষকে কামড়ালে কামড়ায় হাঁটুর নিচে। আর বাঘ দেখে মানুষ নার্ভাস হয়ে পড়ে। কারণ বাঘে ধরলে বা ঘা মারলে আর রক্ষা নেই। বাঘ মানুষের মাংস-কলিজা ভক্ষণ করে। সেখানেই বাঘে-মানুষের শত্রুতার ভয়াবহতা। সেজন্য বাঘের ভয়ে মানুষ লৌহ বেষ্টনী বানিয়ে রাখে অথবা চলার পথে গহীন বাঘাবন এড়িয়ে নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে রেখে বাঁচতে চায়।

এভাইে গড়ে উঠেছে সভ্যতার বৈচিত্র্য। প্রাচীন সভ্যতা, মধ্যযুগীয় সভ্যতা, আধুনিক সভ্যতা পেরিয়ে মানুষ এখন অত্যাধুনিক সভ্যতার ধ্বজাধারী।

আজকাল নেটওয়ার্কের চমকপ্রদ গতিতে মানব সভ্যতার বিকাশ এক অজানা অধ্যায়ে নিয়ে ঠেকিয়ে দিয়েছে। মানুষ নিজেকে সেই গতির সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্বারস্থ হয়ে আরো সভ্য হবার চেষ্টায় তৎপর। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পর আরো কী ঘটতে যাচ্ছে, সেটা অনেকে কল্পনাও করতে পারছেন না!

কিছুদিন আগে একটি কোরবানির খাসি কেনা ও সামাজিক নেটওয়ার্কে দ্রুত ছড়িয়ে পড়া উপাখ্যান মানুষের জীবনপ্রণালীকে কতটুকু ভয়ঙ্কর করে তুলেছিল, তা অনেকই জানেন। মানুষ অনলাইনের সুবাদে সেই ভয়ঙ্কর অবস্থার কথা দ্রুত জেনে ফেললেও সেটার কার্যকরী সমাধান অতিদ্রুত জানতে পারবে কীভাবে!

আমাদের সমাজে চোর ও তাদের থাপইতদের বিচরণ আরো ভয়ঙ্কর। থাপইতরা বা মাফিয়া ডনরা আড়ালে বসে চোরদেরকে চালায়। সেজন্য চোরেরা কোনোকিছুকে ভয় পায় না। চতুর বেজি ও তাদের চতুর প্রভুরা অনেকাংশেই জ্ঞানপাপী। তাদের অনৈতিক চরিত্র ও রাক্ষুসে আচরণের কারণে মানব সভ্যতার বিনাশ ঘটে দিকে দিকে, সবসময়।

সেজন্য পৃথিবীতে ঠান্ডা যুদ্ধ থামানো যায় না। গরম যুদ্ধ কমলেও দেশে দেশে সীমান্তহত্যা কোথাও বন্ধ হয় না। মানুষ প্রাণভয়ে পালিয়ে বেড়ায় এক দেশ থেকে আরেক দেশে।

ইউক্রেন, ফিলিস্তিন ইত্যাদি যুদ্ধ কখন থামবে, তা কেউ জানে না। ইউএস-মেক্সিকো সীমান্ত, মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্ত, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত হত্যা। ক্রমাগতই ঘটে চলেছে নিরীহ মানুষ হত্যা। তার ওপর দেশ ছেড়ে তিউনিশিয়া, লিবিয়া হয়ে নৌকায় উত্তাল ভূ-মধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে ঢুকতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করছে কত বাবা-মায়ের শত শত, হাজারও ধনীর দুলালেরা। এর সঠিক পরিসংখ্যানও অনেক সময় প্রকাশ করা হয় না।

দেশে দেশে মানবপাচারকারী বিষাক্ত সাপেরা যেমন সক্রিয়, তাদেরকে ঠেকানোর জন্য উপকারী বেজি সদৃশ চৌকস গোয়েন্দা, সীমান্তরক্ষী, নৌপুলিশ, রয়্যাল নৌবাহিনী, সাইবার পুলিশ ইত্যাদি তৎপর রয়েছেন বিভিন্ন মাঠে-ঘাটে। এদের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। তবুও প্রতিদিন ঘটছে ভয়ঙ্কর রকমের অঘটন।

আমাদের দেশে অপরাধীর সংখ্যা নির্মূল হয়ে গেছে বলে যেসব বক্তব্য শোনা যায়, তার সঙ্গে নিত্য সংঘটিত অপরাধের মাত্রাবিচারে সঠিক বলে ধরে নেওয়া যায় না। অপরাধ নির্মূল হয়েছে, এমন বক্তব্য অপরাধীকে আরো বেশি উৎসাহিত করে অপরাধ করার জেদ ও ভয়াবহতা উস্কে দেওয়ার শামিল। কারণ, মানুষ একটু সুযোগ পেলে পুনঃঅপরাধ করতে প্রবৃত্ত হয়। তার পেছনে সবসময় কুমন্ত্রণা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকে আরেকজন। এসব কুমন্ত্রণা থেকে কুপ্রবৃত্তির জাগরণ ঘটে অতি সহজেই। তারা এতটাই তৎপর থেকে কুপ্ররোচনা দেয় যেজন্য সমাজ থেকে অপরাধ কখনোই শতভাগ নির্মূল করা যায় না। শুধু অপরাধের মাত্র কমানো যায় মাত্র। এজন্য প্রয়োজন হারমোনি বা সামঞ্জস্য বিধান করে চলা।

তবে সামঞ্জস্য বিধানের জন্য শুধু বেজির সংখ্যা বাড়ালেই কাজ হয় না; সাপ ধরা বেজির সংখ্যা বাড়ানোর জন্য সঠিক ও কার্যকর প্রশিক্ষণধারীর সংখ্যানুপাত বেড়েছে কিনা, তা পর্যবেক্ষণ করা উচিত।

আধুনিক যুগে সংখ্যা নয়- সৎ ও নৈতিকতাসম্পন্ন মেধার মাধ্যমে টেকসই সফলতা আসে। আমাদের সমাজে এটার ঘাটতি আছে। এর ঘাটতি পূরণে তাই আজকাল মহান সংসদে কিছু তরুণেরা সোচ্চার। এধরনের আলোচনাগুলো জাতিকে অনেকটা ভরসা দেয়। তবে মজার ব্যাপার হলো- বেজি পুষে, তাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে, সাপ ধরার জিরো টলারেন্স তৎপরতা দেখিয়ে যদি ঘরের বেড়ায় সজ্ঞানে ছিদ্র তৈরি করে রাখা হয়, তাহলে ঘরের মালিক ও বাসিন্দাদের কী বিপদ ঘটতে পারে, সেটা গভীরভাবে আঁচ করার সক্ষমতা কি আমাদের আছে!

কারণটা, শুধু আমাদের দেশেই নয়, উপমহাদেশে মানুষের স্বপ্নের সঙ্গে সামাজিক ও রাজনৈতিক মূল্যবোধের লালনের বৈপরীত্য চলছে। সেজন্য ঐতিহাসিকভাবে লক্ষ্যণীয় যে, বর্গীরা এখানে বহুবার হামলা করেছিল এবং এখনো বার বার হামলে পড়তে উদ্যত হচ্ছে। এখন চলছে পারস্পরিক আস্থাহীনতায় জাতি বিভাজনের অস্থির রাজনীতি। তার সঙ্গে কিছু দুর্নীতিবাজ রাজকর্মচারী হাম্বরা বুলি দিয়ে রাজা-বাদশার মতো আচরণ করে চরম সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করে চলেছে- যার লঘু অনুপাত সহ্যণীয় কিন্তু মিশ্র ক্ষমতানুপাত একটি গণতান্ত্রিক সমাজে অচল, অগ্রহণীয়! ফলে, সাধারণ মানুষের চেয়ে দুর্নীতিবাজদের বেশি উন্নতি হয়েছে। তারা নিজের ভ্রমে বা লোভের বশবর্তী হয়ে সজ্ঞানে যেন ছিদ্র তৈরি করে বিপদকে আরো বেশি আহ্বান করতে না পারে, সেটাই হবে আসল বেজি পোষার মতো প্রতিরোধক!

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন, E-mail: [email protected]