বার্তা২৪.কম-কে শ্রীরাধা দত্ত

‘বাংলাদেশে সামাজিক বিভক্তির প্রভাব ভারতের ওপরও পড়বে’

  • আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সম্প্রতি বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া নজিরবিহীন নাশকতা ও বিপুল সংখ্যক হতাহতের ঘটনায় সামাজিক বিভক্তির নেতিবাচক প্রভাব ভারতের উপরও পড়বে বলে মনে করেন দিল্লিভিত্তিক থিংকট্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠান বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো অধ্যাপক ড. শ্রীরাধা দত্ত। এই বিভক্তিকে উসকে না দিয়ে জনআকাঙ্খার প্রতি সরকারকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি।

সোমবার সন্ধ্যায় টেলিফোনে বার্তা২৪.কম-কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন ড. শ্রীরাধা দত্ত। কথা বলেছেন পরিকল্পনা সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম

বিজ্ঞাপন

বার্তা২৪.কম: বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহ ভারত কিভাবে দেখছে?

শ্রীরাধা দত্ত: যদিও এখনো অফিসিয়াল রিঅ্যাকশনে সেভাবে উল্লেখযোগ্য কিছু বলা হয়নি। তবে বলতে পারি উনার (পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী) হঠাৎ করে বাড়িয়ে কথাগুলো বলাতে না দিল্লি খুশি হয়েছে, না ঢাকা খুশি হয়েছে। যাদের জন্য তিনি বলেছেন তারাও যে তা চাইছেন বা খুশি হয়েছেন সেটা তো নয়। তাই ব্যাপারটা অদ্ভূদই। উনি যে আশ্বাস দিচ্ছেন স্টুডেন্টসদের, তাতে তাদের কোন সুবিধা হবে, বিষয়টা এমন নয়।

বার্তা২৪.কম: আন্দোলনে ভারতবিরোধিতাও দেখা গেছে। এতে বিদ্যমান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে কি প্রভাব ফেলতে পারে?

শ্রীরাধা দত্ত: আমি মনেকরি, দিল্লি ও ঢাকা চেষ্টা করবে তাদের অটুট সম্পর্কটা বজায় রাখতে। কিন্তু এখানে একটা ভাঙন ধরবে এবার। কারণ যেটা হয়েছে সেটা তো কখনও কোনও ভাবে এক্সপোজ করা যায় না, তাই না? সেটাকে লুকিয়ে রাখার জায়গা নেই আর। যতই অফিসিয়াললি বলা হোক না কেন, আমার ধারণা দিল্লি এটাকে অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে হয়ত...এদিক-ওদিক করবে না। কিন্তু সরকারের পজিশন যাই যাক, দীর্ঘমেয়াদে বিষয়টিতে কারোরই সাপোর্ট থাকার কথা নয়। সবাই ভাবছে, ভারতবর্ষ চুপ আছে মানে সাপোর্ট পাচ্ছে। গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট সেটা অন্য ব্যাপার। কিন্তু জনগণের কথা যদি ভাবি সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের মানুষ নিশ্চয়ই প্রত্যাশা করবে...যাদের সঙ্গে আমাদের এত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, তারাও আমাদের পাশে দাঁড়াবে। শুধু সরকারের পাশে দাঁড়াবে না। এখানে বোধহয় একটা পার্থক্য হচ্ছে।

বার্তা২৪.কম: উগ্রবাদীদের একটা বাড়বাড়ন্ত এবারও দেখা গেল। এতে রাজনৈতিক দুর্বলতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বলে মূল্যায়ন করছেন বিশ্লেষকরা। রাজনৈতিক দলগুলো একে যথাযথভাবে এড্রেস করেনি বলেই তাদের এই উত্থান, মনে করেন তারা। আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?

শ্রীরাধা দত্ত: আমরা যেটা জানতাম বা যে ধারণা হয়েছিল-বাংলাদেশে একদম হয়ত শেষ হয়ে যায়নি, তবে এক্সট্রিমিজমের জায়গাটা অনেক কমে এসেছে। কিন্তু এবার যে রূপটা দেখলাম তাতে তো ভয়ঙ্কর রূপ দেখতে পেলাম। এটার অনেক যুক্তিতর্ক হতে পারে কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে বাংলাদেশের মধ্যেই এই উপাদান (উগ্রবাবিদতা) আছে যা থেকে এখনো বেরুতে পারেনি দেশটি। যদিও এখন পুরো ন্যারেটিভটাই এদের ওপর ঘুরিয়ে দেওয়া হল। সরকার তাদের দায়িত্বের কথা ভুলে গিয়ে এখন বলছে উগ্রবাদীদের কথা। কি বলব, সুবিধার লাইন এটা। আমি প্রকৃত সমস্যাটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না এখন...অপজিশন এটা করছে সেই লাইনটা ধরে সরকারবিরোধী ন্যারেটিভটা ধরে ..আসল জিনিসটা ভুলে যাচ্ছে সবাই। ভয়ঙ্কর একটা দিক দেখা গেল। কে কতটা করেছে, সরকারের হাত কতটা ছিল সেটাও তো বোঝা যাচ্ছে না। কিছু বিতর্ক শুনছিলাম, ডেটা সেন্টার নিয়ে যে কথাটা উঠেছে, ছাত্ররা তো ৫টার সময় বেরিয়ে গেছে, এটা হয়েছে ৭টার সময়ে। তার মানে ছাত্রদের তো এখানে হাত ছিল না। তার মানে কি সরকারের কোন ইন্টিলিজেন্স নেই? সরকার কি জানতো না কি হচ্ছে?

বার্তা২৪.কম: সুশাসনের আকাঙ্খা সব মানুষের মনে অবশ্যই থাকবে। কিন্তু বাংলাদেশ ও ভারতের অভিন্ন শত্রু উগ্রবাদী গোষ্ঠী, যে শত্রুর বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে দু’দেশ একসঙ্গে লড়াই করে আসছে। সেই গোষ্ঠীটি যে ফের মাথাচাড়া দিতে পারে-সেটা বুঝতে না পারার যে রাজনৈতিক দুর্বলতা বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের, তাকে আপনি কিভাবে দেখেন?

শ্রীরাধা দত্ত: আমি তো মনে করি এটা একটা ইন্টিলিজেন্স ফেইলিওর, ল্যাক অব গভর্ন্যান্স। সাংঘাতিক একটা ঘটনা ঘটে গেছে। কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে এই দলগুলোকে তো সিকিউরিটি ফোর্স আটকাতে পারেনি। এটা অবশ্যই ফেইলিওর অব দ্য গভর্নমেন্ট। গভর্নমেন্টের সিকিউরিটি ফোর্স থাকার পরও এটা ঘটেছে, তার মানে কি দাঁড়াচ্ছে? নিশ্চয়ই সবার উপরে এর প্রভাবটা আসছে।

বার্তা২৪.কম: এই ছাত্র বিক্ষোভের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশে সমাজিক বিভক্তির একটি রূপও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এই বিভক্তি কতখানি কাঙ্খিত?

শ্রীরাধা দত্ত: আমি যা বুঝতে পারছি, এখন যেটা হয়েছে-স্বাধীনতার পক্ষের যারা দাবি করেন তারা একদিকে, অন্যদিকে বাকীরা। এটা তো ঠিক না। সবাই তো রাজাকার না। এই ছেলেমেয়েরা তো একদমই তা নয়। এখন লিবারেশনের মিনিংটা কমে যাচ্ছে, তাদের চাকুরি দরকার। যারা স্বাধীনতার গল্প জানে না, তারা রাজাকার-এটা ভাবা তো খুব খারাপ। আওয়ামীলীগের সদস্যরা এইভাবেই বিষয়টা গড়ে তুলেছেন। পলিটিক্স সমাজকে অদ্ভূতভাবে ডিভাইড করে দিচ্ছে, এটা একদমই ঠিক না।

বার্তা২৪.কম: ভারত কি তার বন্ধু দেশকে ইতিবাচক কোন পরামর্শ দেবে?

শ্রীরাধা দত্ত: আমি জানি না, এখনও সেরকম কিছু দেখিনি। হয়ত ভেতরে ভেতরে কথা হলেও হতে পারে। আমি নিশ্চয়ই ভাবি যে, আমার পাশের দেশের যারা আমার সঙ্গে এত বন্ধুত্ব, তার ওখানে যদি এমন কিছু হয় সেটা আমার উপরও প্রভাব পড়বে। যেটা হয়েছে, ভালো জিনিস কিছু হয়নি। সেটার বিষয়ে সবাইকে সচেতন করা উচিত। ধরেই নিলাম ঘটনাটি ঘটে গেছে, এখন কি করা উচিত সেই জায়গাতে বোধহয় প্রতিবেশিদের একটা ইমপ্যাক্ট থাকা উচিত। গভর্নমেন্ট কি করবে জানি না, কিন্তু বুদ্ধিজীবী সমাজের পক্ষ থেকে বলব, সমাজকে বিভক্ত করা খুব দুঃখজনক বিষয়। এর প্রভাব কিন্তু ভারতের উপরও পড়বে। আমাদের সেটা নিয়ে ভাবতে হবে, চিন্তা করতে হবে। বিষয়টি এই ভাবে না করে অন্যভাবে করা যেত-এটা বোধহয় আমাদের কনভে করা উচিত।

বার্তা২৪.কম: অন্তর্ভুক্তিমূলক একটি সমাজ গড়তে ভারত থেকে বাংলাদেশ কি শিক্ষা নিতে পারে?

শ্রীরাধা দত্ত: আমি একটু ভিন্ন দৃষ্টান্ত দিয়ে বলব যে, আপনারা দেখুন ভারতে কৃষক আন্দোলনে কি হলো...সরকারকে পলিসি পাল্টাতে হলো। জনগণের জীবন-যাপনের দিকে না তাকিয়ে যদি বিবেচনা করা হয় ,তাহলে তার একটা প্রভাব হবেই। ভারতে ফেডারেল সিস্টেম আছে বলে কিছু সমস্যা রাজ্যই সমাধান করে নিতে পারে। দিল্লি সব দেখে না। আমাদের এটা একটা এডভান্টেজ। কিন্তু আপনাদের ওখানে তা নয়। স্টেটকে তো নিশ্চয়ই ভাবতে হবে, বুঝতে হবে; ওখানকার লোকজন কি চাইছে। স্টুডেন্টসরা যা করেছে কেউ তো বলছে না যে তারা ভুল করেছে। স্টেট যে রিঅ্যাকশন করেছে তার পরিণাম কি তা তো আমরা জানিই। গভমেন্টকে সব দিকেই নজর রাখতে হবে। একতরফা তো আর হয় না, তাই না? শক্তি দিয়ে কতদিন পজিশনকে ধরে রাখা যায়। কিছু দিন টানা যায়। কিন্তু পাবলিক সাপোর্ট ছাড়া তো কেউ টিকতে পারে না।