সহিষ্ণুতার নান্দনিক নীড় নির্মূলের পীড়া

  • আবু মকসুদ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

অত্যধিক সহিংসতা এবং অমানবিকতা নিয়ে আমাদের সমাজের বর্তমান অবস্থা খুবই উদ্বেগজনক। মানুষের মধ্যে সহিষ্ণুতা এবং সহনশীলতা প্রায় নির্মূল হয়ে যাচ্ছে। আমরা ক্রমেই অধৈর্য এবং রূঢ় হয়ে পড়ছি। দিন দিন মানুষ অমানবিকতাকে আঁকড়ে ধরছে, যা বিভক্ত এবং অস্থির করে তুলছে আমাদের সমাজকে।

কোটা আন্দোলনকে ঘিরে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া যে দৃশ্য প্রত্যক্ষ করা গেছে তা হলো নির্দয়তা। হত্যা এবং ধ্বংসযজ্ঞের ভিডিও চিত্রগুলোতে আমরা কোনো মানবিক আচরণ দেখতে পাইনি। একজন নিরস্ত্র আবু সাঈদের বুকে পুলিশ গুলি চালায়; তাকে কীভাবে মানুষ ভাবা যায়? আর যে পুলিশ জনগণের নিরাপত্তা দিতে গিয়ে নির্মমভাবে নিহত হয়, তার লাশ ব্রিজে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এ ধরনের আচরণকেও মানবিক বলা যায় না। 

বিজ্ঞাপন

আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, প্রতিপক্ষকে যেকোনো অবস্থাতেই নির্মূল করার চেষ্টা করা হচ্ছে। নির্মূল অর্থাৎ সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে, কোনো চিহ্নও রাখা হচ্ছে না। যারা হত্যাযজ্ঞ থেকে দূরে ছিল এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িত ছিল না, তারাও সন্ত্রাসীর মতো আচরণ করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একে অপরকে ঘায়েল করার জন্য যত উপায় আছে সবই প্রয়োগ করা হয়েছে। প্রতিদিন গুজবের নতুন নতুন কারখানা আবিষ্কার হচ্ছে এবং এসব কারখানা থেকে উৎপাদিত ‘পণ্য’ নিয়ে একে অপরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এ ধরনের আচরণ সমাজকে করে তুলছে আরও অস্থিতিশীল।

ভয়াবহ দিক হলো ভয় দেখিয়ে মানুষকে প্রভাবিত করার চেষ্টা হচ্ছে। দুপক্ষই তাদের মতের বিপরীতে থাকা মানুষদের তালিকা করে রেখেছে, যেমন একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যার সময় চিহ্নিত করা হয়েছিল। এই প্রবণতা আমাদের সমাজকে আরও ভয়ানক অবস্থায় নিয়ে যাচ্ছে। বিপরীত মতকে সহ্য করতে না পারার এই প্রবণতা আগে থেকেই ছিল, কিন্তু এখন তা মহামারী আকারে দেখা দিয়েছে। সহিষ্ণুতা এবং সহনশীলতা সম্পূর্ণ উধাও হয়ে যাচ্ছে। আমার বিপরীত মত অর্থাৎ আমার শত্রু, তাকে যে কোনো মূল্যে নির্মূল করতে হবে।

বিজ্ঞাপন

স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, ভিন্নমতকে সহ্য করা এবং তাকে সম্মান জানানোর প্রবৃত্তি গড়ে তোলা সমাজের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ। পক্ষ ও প্রতিপক্ষের মধ্যে পার্থক্য সমাজের সৌন্দর্য বাড়ায়। মত কিংবা দ্বিমত না থাকলে কোনো দেশ, সমাজ, বা জাতি সামনে এগোতে পারে না। আমাদের দেশে সবাইকে ‘সহমত ভাই’ হওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হয়, কেউ যদি দ্বিমত করে তবে তাকে ‘নাস্তিক’ বা ‘রাজাকার’ বলা হয়। এই সংস্কৃতি আমাদের সমাজকে পেছনে ঠেলে দিচ্ছে, এতে কোন সংশয় নেই।

আমাদের দেশের কি কোনো আশা নাই সামনে এগিয়ে যাওয়ার? মত এবং দ্বিমতকে সম্মান জানানোর মানসিকতা গড়ে তুলতে কি আমরা আদৌ সক্ষম হবো? আমরা কি সারাজীবন মূর্খ, গণ্ড, একগুঁয়ে এবং অহংকারী হয়েই থাকবো?

এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের প্রথমেই নিজেদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ গড়ে তুলতে হবে। আমাদের শিখতে হবে কীভাবে একে অপরের মতামতকে সম্মান জানাতে হয়। সহিষ্ণুতা এবং সহনশীলতা আমাদের সমাজের ভিত্তি হওয়া উচিত।

সহিষ্ণুতা ও সহনশীলতার পাশাপাশি সমাজে সহমর্মিতা ও সহযোগিতার চর্চাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সহমর্মিতা মানুষকে অন্যের দুঃখ-কষ্ট বুঝতে এবং তাদের সাহায্য করতে উদ্বুদ্ধ করে। সমাজে সহমর্মিতা থাকলে মানুষ একে অপরের প্রতি আরও সহানুভূতিশীল হয়। এ ধরনের মানসিকতা গড়ে তুলতে হলে আমাদের পরিবার থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সর্বত্র এই গুণাবলির চর্চা করতে হবে।

সমাজে মতের পার্থক্য থাকবে এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু সেই পার্থক্যকে সম্মান করার মানসিকতা থাকতে হবে। এই মানসিকতা গড়ে তুলতে হলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ, সহিষ্ণুতা, এবং সহনশীলতা গড়ে তোলার ওপর জোর দিতে হবে।

সমাজে সহিংসতা এবং অমানবিকতার পরিবর্তে মানবিকতা, সহিষ্ণুতা, এবং সহনশীলতার চর্চা করতে হবে। তাহলেই আমাদের দেশ এবং সমাজ একটি সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাবে। আমাদের দেশেও আশাবাদী হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে, কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন আমাদের সবার আন্তরিক প্রচেষ্টা এবং মানবিক মূল্যবোধের চর্চা।

লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী, ছোটকাগজ ‘শব্দপাঠ’ সম্পাদক