কিছু তর্ক হচ্ছে রাজনৈতিক পরিসরে। একটি হলো এই যে, আগে সংস্কার নাকি নির্বাচন? আরেকটি হলো, সংস্কার শেষ করবে কে? বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নাকি পরবর্তী নির্বাচিত সরকার? সরকার ও নির্বাচনের মধ্যে সমন্বয় হবে কেমন করে?
এসব তর্ক-বিতর্কের কারণ হলো, পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষার ওপর বর্তমান বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে। এত বছর জনগণের কোনো অধিকার ছিল না। আমাদের লক্ষ্য ছিল গণতান্ত্রিক দেশ হওয়ার। কিন্তু আমরা তা করতে পারিনি। দেশ এখনো অস্থিরতার মধ্যে আছে। কিন্তু সম্ভাবনাও আছে। এছাড়া ২৪-এর অভ্যুত্থানের পর নতুন যাত্রার শুরু থেকে জনগণ হতাশা ও আশঙ্কায় ভুগছে। সংস্কার আগে নাকি নির্বাচন, তা নিয়ে জনগণ শঙ্কায় আছে। তবে আশার কথা হলো, আমরা এখন কিছুটা হলেও স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারি।
বলার অপেক্ষা রাখে না, জুলাই বিপ্লব পরবর্তী বাংলাদেশে সংস্কারকে এড়িয়ে নিছক একটি নির্বাচন অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্য নয়। আবার নির্বাচনকে অনিশ্চিত রাখাও কাম্য নয়। ফলে সংস্কার ও নির্বাচনের মধ্যে একটি সুসমন্বিত যোগসূত্র খুবই জরুরি বিষয়। এমতাবস্থায় অন্তবর্তীকালীন সরকারকে কমপক্ষে ৩ বছর সময় দেয়া দাবি উত্থাপিত হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ‘শ্বেতপত্র প্রকাশই শেষ কথা নয়, সুপারিশ বাস্তবায়ন জরুরি’ শীর্ষক এক সেমিনার থেকে দাবিটি উচ্চারিত হয়েছে। যে সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন বিপুল সংখ্যক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী। এতে, বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারকে জাতীয় সরকারে রূপান্তর করে প্রয়োজনীয় রাষ্ট্র সংষ্কারের জন্য কমপক্ষে ৩ বছর সময় দেয়ার দাবি জানান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য ও চবি উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) প্রফেসর ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান।
মঙ্গলবার (২৪ ডিসেম্বর) বেলা ১১ টায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট মিলনায়তনে চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি) আয়োজিত ‘শ্বেতপত্র প্রকাশই শেষ কথা নয়, সুপারিশ বাস্তবায়ন জরুরি’ শীর্ষক মুক্ত সংলাপে উপস্থিত ছিলেন অর্থনীতি বিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. এ কে এনামুল হক। সভাপতিত্ব করেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি ও সিসিআরএসবিডির নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর ড. মাহফুজ পারভেজ।
অন্তবর্তীকালীন সরকারকে জাতীয় সরকারে রূপান্তরের দাবি নতুন নয়। কারণ, রাজনৈতিক সরকার বহু কমিশন কমিশন গঠন করলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে এগুলোর রিপোর্ট আলোর মুখ দেখেনি এবং বাস্তবায়নও হয়নি। সরকার বা দায়িত্বশীলরা শুধু দিন গোনে, কখন সময় শেষ হবে, রিপোর্ট জমা দিবে এবং তা বস্তাবন্দি করবে। আসলে এ দেশটাকে কিছু দেওয়ার জন্য সহজে কেউ দায়িত্ব নিতে চায় না। একটি জাতীয় সরকারকে এই দায়িত্ব নিতে হবে। এজন্য, সকল দুর্নীতি তদন্তে ও সুপারিশমালা বাস্তবায়নে সৎ, সাহসী ও দেশপ্রেমিক মানুষ দরকার।
তাছাড়া, অর্থনীতি বিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির রিপোর্টে উল্লিখিত সুপারিশসমূহ জনসম্মুখে প্রকাশ ও বাস্তায়নের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দুদককে শক্তিশালী করার বিষয়টি রাজনৈতিক সরকারের চেয়ে অন্তর্বর্তীকালীন বা জাতীয় সরকার অধিকতর সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করতে পারবে।
বিগত অতীতে দেশের ব্যাংকিং সেক্টর ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদদের হাতে চলে গিয়েছিল, যার কারণে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। কেউই আর ব্যাংক লুট দেখতে চায় না, দুর্নীতি দমনে শুদ্ধাচার চায়, চায় যথাযথভাবে সংস্কার কার্যকর করার মাধ্যমে রক্তের বিনিময়ে অর্জিত নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে।
শুধু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন না দেখে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে জাতীয় ঐক্যমতের ভিত্তিতে অংশগ্রহণমূলক জাতীয় সরকার গঠন করার বিষয়টিকেও গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। এ ব্যাপারে অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধানকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্তবর্তীকালীন সরকারকে ৩ বছর ক্ষমতায় থেকে সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করার পর নির্বাচন আয়োজনের যে আহবান জানানো হয়েছে, তা নতুন বাংলাদেশকে সত্য, সুন্দর, ন্যায় ও কল্যাণের পথে নিয়ে যেতে পারবে বলে আশা করা যায়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, অর্থনীতি বিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. এ কে এনামুল হক বলেন, শ্বেতপত্র প্রস্তুত করতে গিয়ে ২৮ ধরনের দুর্নীতির চিত্র পাওয়া গেছে। তিনি পেশকৃত রিপোর্টের দ্রুত বাস্তবায়ন ও জাতিকে জানাতে পাঠ্যবইয়ে সংযুক্ত করার জন্য বর্তমান সরকারকে পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, ২০২২ সালে সরকারের বিভিন্ন আর্থিক খাতে ২২ হাজারেরও অধিক অডিট আপত্তি দেয়া হয়েছে। দেশ অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত হয়েছে। সবাই দুর্নীতির কৌশল শিখে গেছে। পাবলিক ফান্ডের দায়ভার না নেয়া, আগে তথ্য দেয়া, তথ্য লুকানো ও হঠাৎ ডকুমেন্ট লাগবে বলে বিনিয়োগকারীদের বিপদে ফেলা ইত্যাদি নানা উপায় দুর্নীতি করা হয়ে থাকে। অধিকাংশ দুর্নীতিতে সরকারি কর্মকর্তারা জড়িত। তারপরই রাজনীতিবিদদের অবস্থান।
প্রফেসর এনামুল হক বলেন, কৃষি খামার করে সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে। যারা প্রকৃত হকদার, সে সকল কৃষক ও গরীব মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক সময় মাস্টার প্লানও বদলানো হয়েছে। পণ্যের দাম বাড়িয়ে কমিশন বাণিজ্য করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, দেশটাকে বদলাতে চাইলে সবাইকে নিয়েই বদলাতে হবে। সিস্টেম সংশোধন করতে হবে। ডাইরেক্ট ট্যাক্স বাড়ালেও দুর্নীতি কমানো যায়।
তিনি আরও বলেন, ৫০ হাজার ট্রাক্টর আনা হয়েছে। কিন্তু যাদের জন্য এ ট্রাক্টর আনা হয়েছিল সে দরিদ্র চাষীরা তা পায়নি। দেশের এমপি, মন্ত্রীরা চাষী নাম দিয়ে তা নামে-বেনামে গ্রহণ করেছে। টাকা লোপাটের ৪৫ শতাংশ সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের পকেটে গেছে। আইসিটিতে প্রচুর দুর্নীতি হয়েছে কিন্তু তা দেখা যায়নি। দুর্নীতি দমন করতে নিচ থেকে ধরতে হবে। দুর্নীতি দমনের ব্যাপারে গবেষকরা যত চিন্তা করবেন, দেশের জন্য তত মঙ্গল হবে।
শ্বেতপত্র নিয়ে আজকের সংলাপ যথেষ্ট নয় উল্লেখ করে চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ এর নির্বাহী পরিচালক ও রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মাহফুজ পারভেজ বলেন, শ্বেতপত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর সুপারিশমালার দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরি। তিনি বলেন, বিগত সরকারের দলীয় নেতারা বিভিন্ন সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে চাঁদাবাজি করেছে। এখন শুধুমাত্র সাইনবোর্ড পাল্টানো হয়েছে কিন্তু চাঁদাবাজি রয়েই গেছে। এর পেছনে জড়িতদের খুঁজে বের করতে হবে। তিনি রাষ্ট্রের সাথে নাগরিকদের সম্পর্ক বাড়ানোর পরামর্শ দেন। তিনি বৈষম্যবিরোধী চেতনা ধরে রাখতে রাজনৈতিক, আইনগত এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাজ করতে শিক্ষার্থীদের যথাযথভাবে কাজে লাগানোর পরামর্শ দেন। একই সঙ্গে দুদক'কে শক্তিশালী ও স্বাধীনভাবে কাজ করার বিষয়ে তাগিদ দেন তিন।
প্যানেল আলোচক চবি রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) প্রফেসর ড. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, আমরা একটা সুন্দর স্বপ্নের মাঝে বেঁচে আছি। দীর্ঘ ১৫ বছর দেশে দমন-নিপীড়ন করেছিল বিগত ফ্যাসিবাদী সরকার। এ ফ্যাসিবাদী দানব যেন আর ফিরে না আসে, সেজন্য আমাদের সকলকে সতর্ক থাকতে হবে। ফ্যাসিবাদমুক্ত রাষ্ট্র উপহার দেওয়ার জন্য ছাত্রসহ যারা রক্ত দিয়েছেন, সংগ্রাম করেছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি আরও বলেন, ফ্যাসিবাদী শক্তি পালানোর পর এদেশের ভঙ্গুর অর্থনীতি রেখে গেছেন। তিনি বলেন, দুর্নীতি অনেক ধরনের হয়েছে কিন্তু বিদেশে নিজের ছেলে-মেয়ের পড়াশোনার খরচ চালানোর দুর্নীতি শুনে আশ্চর্য্য হয়ে গেলাম। এমন দুর্নীতি কি মানুষ করতে পারে?
এসময় তিনি দশটি পয়েন্ট উল্লেখ করে বিস্তারিত আলোচনা করেন এবং বর্তমান সরকারকে তাড়াহুড়া না করে সংস্কার কাজ শেষ করে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরীর আহ্বান জানান। এজন্য তিনি কমপক্ষে তিন বছর সময় দেয়ার জন্য দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন বিগত সরকারের আমলে দেশের শেয়ার বাজারসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দিয়ে বিদেশে কোটি কোটি টাকা পাচার করেছে। এটা জাতির কাছে একদিন জবাবদিহি করতে হবে। তিনি আরও বলেন বিগত ফ্যাসিবাদী সরকার শেষ পর্যন্ত এদেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে এ দেশ থেকে পালিয়ে গেছে।
প্যানেল আলোচক চবি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (ভারপ্রাপ্ত) প্রফেসর ড. মোঃ এনায়েত উল্যা পাটওয়ারী বলেন, 'এ সরকারকে ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না। সরকারের বিভিন্ন সংস্কার কমিশনগুলো যে রিপোর্ট এবং সুপারিশ প্রদান করছে তার দ্রুত বাস্তবায়ন চান তিনি। তিনি বলেন, এখনো অনেক বড় বড় কর্মকর্তা পদ ধরে আছেন, তাদেরকেও ধরতে হবে। তিনি বর্তমান সরকারকে সময় দেওয়ার জন্য আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বিপ্লবী সরকার ছাড়া এত সংস্কার করা খুবই কঠিন হবে। তাই রাজনৈতিক দলগুলোকে সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের বিবেককে জাগ্রত করতে হবে এবং আল্লাহর ভয় অন্তরে ধারণ করতে হবে। তিনি সকল দুর্নীতির তথ্য পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানান। একইসাথে বিপ্লবের মূল চেতনা বৈষম্যবিরোধী নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার আহ্বান জানান।
প্যানেল আলোচক ও প্রভোস্ট প্রফেসর ড. বেগম ইসমত আরা হক বলেন, নতুন বাংলাদেশ অর্জনের পর ৪০০ পৃষ্ঠায় ২৮টি বিষয়ে বিগত সরকারের দুর্নীতির চিত্র আমরা দেখতে পাচ্ছি। তিনি অর্থনীতি বিষয়ক শ্বেতপত্র জাতির সম্মুখে প্রকাশের জন্য সরকারের নিকট দাবি জানান। তিনি বলেন, বিভিন্ন সংষ্কার কমিটির সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করতে না পারলে দেশ আরও সংকটে পড়বে। বর্তমানে বিভিন্ন জায়গায় লুটপাট, চাঁদাবাজি হচ্ছে। সরকারকে অতিসত্বর কঠোর হস্তে এগুলো বন্ধ করতে হবে।
বিগত সরকার ডাটা ম্যানিপুলেশনের মাধ্যমে ব্যাপক দুর্নীতির বিষয়কে আড়াল করেছে। সরকার প্রদত্ত ডাটা এক, কিন্তু বাস্তবতা অন্যরকম বলে মন্তব্য করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর। আরেকজন শিক্ষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীত দুর্নীতি নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ ও দোষীদের শাস্তি দাবি করেন। কয়েকজন শিক্ষার্থী সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন।
সংলাপে বলা হয়, এ দেশে ব্রিটিশরা জনপ্রশাসন তৈরি করেছে। সেখানে দক্ষ লোক নিয়োগ দেওয়া হতো। তাদের কাজ ছিল ব্রিটিশদের রাজত্ব স্থায়ী করা। তাদের উত্তরাধিকার এখনো আমরা দেখতে পাই। আমাদের দেশে যে উদ্দেশ্য নিয়ে জনপ্রশাসন তৈরি করা হয়েছে, তা এখনো পূরণ করতে পারেনি। কারণ, আমাদের প্রশাসনে এখনো দালালি স্বভাব আছে। আমাদের মধ্যে ইতিবাচক মানসিকতা থাকতে হবে। এটি কেবল প্রশাসনের মধ্যে থাকবে না। কেন্দ্রীভূতকরণ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয়করণ করা যাবে না।
এ কথা সত্য যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রশাসনে মেধাভিত্তিক নিয়োগ বন্ধ হয়ে গেছে। আমাদের পচন সেখান থেকেই শুরু। কখনো এটি একটু ঠিক করা হলেও পরে তা আবার নষ্ট করে দেয়। আসলে জনপ্রশাসনের ইতিহাসে অনেক উত্থান-পতন হয়েছে। সময়ের সঙ্গে জনগণের সব জায়গায় প্রশাসন যুক্ত। সরকারি প্রশাসনের কাজগুলো ঠিক করে দিতে হবে। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। এই দেশে প্রতিটি সরকার প্রশাসনের পরিবর্তনের জন্য কমিশন করেছে; কিন্তু এর প্রয়োগ কখনো হয়নি। এজন্য, জনপ্রশাসনের পুনর্গঠন দরকার। কারণ, আমদের ঔপনিবেশিকব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এর বিরুদ্ধে গণ-ঐকমত্য তৈরি করতে হবে। সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত হলো জনপ্রশাসন, এরপর রাজনীতিকরা। তথ্য বলছে, একজন আমলা একটি সই দিয়ে যেই পরিমাণ সম্পদের মালিক হতে পারেন, একজন কৃষকের চৌদ্দ পূর্বপুরুষ একটি টিপসই দিলেও এত সম্পদের মালিক হতে পারবে না। আমলার সীমাবদ্ধতা আছে, কারণ সে মানুষ। কিন্তু আমলাতন্ত্রের সীমাবদ্ধতা নেই।
অনেকে রাজনীতিবিদদের দাপট, দখলধারী এবং আমলাতন্ত্রের বাড়-বাড়ন্ত দেখে বলছেন, যেই স্পিরিট নিয়ে জুলাই অভ্যুত্থান হয়েছে, তা আমরা ধরে রাখতে পারিনি। এখানে সুযোগ ছিল অভ্যুত্থানকে বিপ্লবে পরিণত করার। সচিব ও জনপ্রশাসনদের জিজ্ঞাসা করা দরকার স্বৈরাচারকে এত বছর ক্ষমতায় কেন রেখেছেন তারা। জনপ্রশাসনে যারা ফ্যাসিবাদীকে ক্ষমতায় রাখার জন্য সাহায্য করেছেন, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা, যেন ভবিষ্যতে ফ্যাসিবাদ আর তৈরি না হয়।
অতএব, দুর্নীতিমুক্ত, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ বিনির্মাণের আহ্বান বন্ধ করে দেওয়া যাবে না। কর্তৃত্ববাদী শক্তির পরাজয়ের মধ্য দিয়ে একটি সুশাসিত, অসাম্প্রদায়িক ও বৈষম্যমুক্ত স্বদেশ বিনির্মাণের যে সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, সেই সুযোগকে বাস্তবে রূপ দিতে সরকার, রাজনৈতিক দল, জনসাধারণ ও তরুণ প্রজন্ম, বিশেষ করে শিক্ষার্থীসহ সকলের দায়িত্ব রয়েছে। দেশের স্বাধিকার থেকে শুরু করে সর্বশেষ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র দেশ যেভাবে একসঙ্গে লড়েছে, একটি সুশাসিত ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে সেই বন্ধন যেন সুদৃঢ় ও অটুট থাকে, সেই প্রত্যাশা সমগ্র জাতির।
চরম স্বেচ্ছাচারী শাসন কাঠামোতে সর্বস্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতিতে দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছিল। দুদকসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার কারণে দুর্নীতির সিন্ডিকেট এতটাই শক্তিশালী যে, সাধারণ জনগণ জিম্মি হয়ে দুর্নীতিকে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। এরকম বাস্তবতায়, সম্প্রতি দুদকে নতুন চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে। তাই শুধু নেতৃত্বের পরিবর্তন নয়, বরং প্রতিষ্ঠানটিকে জনবান্ধব ও দুর্নীতিমুক্ত করার জন্য সম্পূর্ণরূপে ঢেলে সাজাতে হবে।
তা অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব হলো, কর্তৃত্ববাদের বিদায়ের মধ্য দিয়ে জনমনে মুক্ত গণমাধ্যম এবং স্বাধীন ও অসংকোচ মত প্রকাশের যে প্রত্যাশার সঞ্চার হয়েছে, তা পূরণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং সকলেই যাতে চিন্তা, বিবেক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার চর্চা করতে পারে, তার উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিতকরণ। বিগত কর্তৃত্ববাদী শাসন কাঠামোর ন্যায় স্বাধীন মত ও সাংবাদিকতার কারণে কেউ যেন হয়রানি, দোসর আখ্যায়িত বা ট্যাগিং এর শিকার না হয়, সে ব্যাপারে সকলকে উদার ও সহিষ্ণু আচরণ করার আহ্বান জানান তারা।
কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ বিনির্মাণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ খাতসমূহ সংস্কারের উদ্দেশ্যে ১১টি কমিশন গঠন করেছে। তবে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা চিরস্থায়ী করণের অপপ্রয়াস থেকে রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, বহুমুখী দুর্বৃত্তায়ন ও বিচারহীনতার সংস্কৃতির যেভাবে বিস্তার ঘটানো হয়েছে, তা থেকে পরিত্রাণ পেতে সকল সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনভাবে কাজ করার উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করাসহ এসব প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও সদস্যদের নিয়োগে দলীয়করণ বন্ধ করতে সুনির্দিষ্ট যোগ্যতা ও অযোগ্যতার শর্ত অন্তর্ভুক্ত ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সংস্কার করতে হবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও মর্যাদা রক্ষায় বিচার বিভাগের পরিপূর্ণ ক্ষমতায়িত নিজস্ব সচিবালয় স্থাপন এবং সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে যুগোপযোগী শৃঙ্খলা ও আচরণ বিধিমালা প্রণয়ন করাও জরুরি।
এজন্য, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকার রক্ষায় সকল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ঢেলে সাজাতে হবে। সর্বোপরি সার্বিক সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকারকে একটি সুস্পষ্ট রোডম্যাপ প্রণয়ন করা দরকার, যাতে করে পরবর্তী সময়েও সংস্কার কার্যক্রম স্তিমিত হয়ে না পড়ে এবং এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলসমূহকেও অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়া অপরিহার্য। আমরা বিশ্বাস করি, শুধু রাজনৈতিক চাপ দেশ শাসনের শেষ কথা হতে পারে না। এতে নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম, শিক্ষার্থী সমাজের আকাঙ্ক্ষার বাস্তব প্রতিফলনও জরুরি।
লেখক ও কলামিস্ট।
আরাকান আর্মির মতো নন-স্টেট অ্যাক্টরের সঙ্গে বিভিন্ন ফ্রন্টে মিয়ানমারের সরকারি সেনাদের পরাজয়ে মিয়ানমার পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে। বিশেষ করে দেশটির রাখাইন প্রদেশের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী সবশেষ নিরাপত্তা চৌকির পতনের পর নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বৃদ্ধি পাওয়ায় উদ্বেগ বাড়ছে। বিরাজমান অবস্থায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতায় বহুপক্ষীয় সংলাপে এই সংকটের সমাধান খুঁজতে বাংলাদেশকে তৎপর হওয়ার তাগিদ এসেছে।
ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার’র মঙ্গলবারের সম্পাদকীতে উঠে এসেছে এমন পর্যবেক্ষণ।
সম্পাদকীয়তে দৈনিকটি বলছে, ‘মিয়ানমারে সামরিক জান্তা, আরাকান আর্মি এবং অন্যান্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীর মধ্যে চলমান সংঘাত বাংলাদেশের জন্য নতুন উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। আরাকান আর্মি সম্প্রতি দাবি করেছে যে তারা কৌশলগত পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর মংডুতে মিয়ানমারের শেষ সেনা ফাঁড়িটি দখল করেছে, যার ফলে বাংলাদেশের সাথে ২৭১ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পেয়েছে। এই পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ মিয়ানমারকে রাখাইন রাজ্যে তার সীমান্তে চলমান সংকট মোকাবেলার আহ্বান জানিয়ে জোর দিয়ে বলেছে যে তারা আরাকান সেনাবাহিনীর মতো নন স্টেট অ্যাক্টরদের সাথে আলোচনা করতে পারে না।’
‘পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা মোঃ তৌহিদ হোসেন গত ১৯ ডিসেম্বর থাইল্যান্ডে একটি অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় মিয়ানমারের পরারাষ্ট্র মন্ত্রীকে এই তাগিদ দেন। তিনি এ অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার প্রতি জোর দেন। তিনি মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে মনে করিয়ে দেন, রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান না করে এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। পররাষ্ট্র উপদেষ্টার মতে, মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ এবং রোহিঙ্গাদের নিপীড়নের কারণে গত সাত বছরে অন্তত ১২ লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ নিষিদ্ধ করার সত্ত্বেও অনানুষ্ঠানিক মাধ্যমে ৬০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে। এর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সীমান্তে দুর্নীতিকে দায়ী করা হয়েছে। স্পষ্টতই, পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল এবং বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে। সীমান্তে সংঘবদ্ধ চক্রের দুর্নীতি রোহিঙ্গাদের আগমনকে সহজতর করে এবং মাদক, অস্ত্র ও মানব পাচারের ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তা হুমকিকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। অতএব, সরকারের জন্য এই সমস্যাগুলি আরও বাড়ানোর আগে জরুরিভাবে সমাধান করা জরুরি।’
সম্পাদকীয়তে আরও বলা হয়েছে, ‘বর্তমান সীমান্ত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার অগ্রগতি সম্পূর্ণভাবে থমকে গেছে। কিন্তু বাংলাদেশ কতদিন তাদের আশ্রয় দিতে পারে? বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা। রোহিঙ্গাদের থাকার জন্য বাংলাদেশ যে অর্থনৈতিক, পরিবেশগত এবং সামাজিক বোঝা বহন করছে তা দিন দিন আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। সংঘাতের কারণে বাংলাদেশ এবং বৃহত্তর এ অঞ্চলের জন্য আরও অস্থিতিশীলতার সম্ভাবনা বাড়াচ্ছে। রাখাইনে সাম্প্রতিক সহিংসতা বৃদ্ধি আবারও মুসলিম রোহিঙ্গা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে সংগঠিত সহিংসতার পুনরুজ্জীবনের শঙ্কা তৈরি করেছে। যেটি ২০১৭ সালে তাদের বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছিল। এই পরিস্থিতিতে, বাংলাদেশকে অবশ্যই তার সীমান্ত সুরক্ষিত করার বিষয়ে অতিরিক্ত সতর্ক থাকতে হবে।’
বহুপক্ষীয় সংলাপের প্রয়োজনীয়ার প্রতি গুরুত্বারোপ করে এতে আরও বলা হয়েছে, ‘একই সময়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তায়, সরকারের উচিত আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারের স্বার্থে মিয়ানমারের জান্তা এবং বিভিন্ন বিদ্রোহী দলকে সংলাপের মাধ্যমে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌঁছাতে রাজি করানো।’
রাজনৈতিক দলগুলোই বর্তমান অন্তবর্তী সরকারকে দুর্বল করে রেখেছে বলে মন্তব্য করেছেন কবি, সমাজ চিন্তক ও মানবাধিকারকর্মী ফরহাদ মজহার। তিনি বলেছেন, ‘তারা (রাজনৈতিক দলগুলো) বলছে, নির্বাচিত সরকার ছাড়া এটা বা ওটা করা যাবে না। আমি তো বলি ড. ইউনূসের সরকার নির্বাচিত। আমাদের ছেলেরা শহীদ হয়ে তাঁকে নির্বাচিত করেছে।’
প্রথম আলো’কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন ফরহাদ মজহার। সাক্ষাৎকারে সমসাময়িক বিভিন্ন প্রসঙ্গেও খোলামেলা কথা বলেছেন এই চিন্তাবিদ। বার্তা২৪.কম এর পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত কিছু অংশ প্রকাশিত হলো:
বাংলাদেশে তো কোনো সরকারই রাষ্ট্র নিয়ে জনগণের সঙ্গে চুক্তির তোয়াক্কা করেনি। রাষ্ট্রকে তারা দখল ও পদানত করেছে। আপনি ভালো একটা গঠনতন্ত্র বা সংবিধান করলেন। ভবিষ্যৎ সরকারগুলো যে সেটা লঙ্ঘন করবে না, সেই গ্যারান্টি আমরা কোথায় পাব?
ফরহাদ মজহার: আমি যাকে গঠনতন্ত্র বলি, সেটা কিন্তু ওপর থেকে চাপিয়ে দিলে হবে না। আমি যে সংবিধান চিন্তা করছি, সেটা মাত্র কয়েক পৃষ্ঠার। সংক্ষিপ্ত, সহজ, জনগণের বোধগম্য কিন্তু পরিসর ব্যাপক। এমন কোনো আইন প্রণয়ন করা যাবে না, যা নির্বিশেষে কোনো ব্যক্তির স্বাধীনতা, মর্যাদা ও অধিকার হরণ করে কিংবা প্রাণ–প্রকৃতি–পরিবেশ ধ্বংস করে। এ ছাড়া রাষ্ট্রের ক্ষমতার বিভাজনটা কীভাবে হবে, প্রেসিডেন্ট না প্রধানমন্ত্রী পদ্ধতির সরকার চাই, আইনসভা দুই কক্ষ না এক কক্ষের হবে, এক কক্ষের হলে কি সেখানে বিকেন্দ্রীকৃত জেলাগুলোও থাকবে, যাদের অনুমতি ছাড়া কোনো অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করা যাবে না, স্থানীয় সরকারের চরিত্র কেমন হবে, সেটিকে বিকেন্দ্রিত করলে বিভাগগুলোকে কী বলব—সংবিধান এভাবেই করতে হবে। যাদের নদী, হাওর, জলমহাল বেদখল হয়ে গেছে, আপনাকে গ্রামে–গ্রামে ইউনিয়নে–ইউনিয়নে কাউন্সিল করে সেসব মানুষের কথা শুনতে হবে। এসব সম্পদ জনগণের অধীনে রেখে তার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার জন্য উপযুক্ত স্থানীয় সরকারব্যবস্থা লাগবে। অথচ সরকার তো আবারও ওপর থেকেই সংবিধান চাপিয়ে দিচ্ছে। আলী রীয়াজের বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই, তিনি তো অন্তত সংবিধান পুনর্লিখনের কথা বলেছেন। বদিউল আলম মজুমদারেরও হয়তো কিছু ভালো আইডিয়া আছে। কিন্তু সব তো ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। দুর্নীতির একটা শ্বেতপত্র তৈরি করা হয়েছে। খুব ভালো একটা কাজ। কিন্তু পড়লে মনে হয়, এটি করা হয়েছে দুদকের জন্য। তাঁরা এখনো পুরোনো নয়া–ধ্রুপদি অর্থনীতির বাজার ও চাহিদার মধ্যে আছেন। এটাই তো আমার সমস্যা।রাষ্ট্রের ওপর আন্তর্জাতিক বাজারের বহুজাতিক কোম্পানির নিয়ন্ত্রণের কারণে আমাদের অর্থনীতির বিকাশ ঘটাতে পারছি না, আমাদের সম্পদ বাড়াতে পারছি না। ট্যাক্স তুলতে পারছি না। আমাদের ভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা হাজির করতে হবে। এই শ্বেতপত্র খুবই সুন্দর, কিন্তু রাষ্ট্র গঠনে কোনো কাজে আসবে না। অথচ দরকার গণসার্বভৌমত্বের ধারণার ওপর দাঁড়িয়ে, অবাধ বাজারব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে জাতীয় অর্থনৈতিক বিকাশের নীতি ও কৌশলের প্রস্তাব করা।
প্রশ্নটা অন্যভাবে করি। পুনর্গঠন বা সংস্কারের মাধ্যমে যে রাষ্ট্রব্যবস্থাই আমরা গড়ে তুলি না কেন, সেটা তো চালাবে রাজনৈতিক দলগুলোই। তাদের স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠা আমরা ঠেকাব কী করে? তারা রাষ্ট্রের সংস্কারের কথা বলছে, কিন্তু নিজেদের সংস্কারের কথা তো বলছে না।
ফরহাদ মজহার: রাজনৈতিক দলগুলো গণ–অভ্যুত্থানকেই পূর্ণ স্বীকৃতি দিক না। গণ–অভ্যুত্থানের অধীনে অন্তর্বর্তী সরকারকে পূর্ণ ক্ষমতা দিক না। তাহলেই দেখবেন রাজনৈতিক দলগুলোকে কীভাবে মোকাবিলা করতে হয়। রাজনৈতিক দলগুলো সরকারটা দুর্বল করে রেখেছে। তারা বলছে, নির্বাচিত সরকার ছাড়া এটা বা ওটা করা যাবে না। আমি তো বলি ড. ইউনূসের সরকার নির্বাচিত। আমাদের ছেলেরা শহীদ হয়ে তাঁকে নির্বাচিত করেছে। আমরা অবশ্যই এই সরকারের সমালোচনা করব। তিনি সরকার চালাচ্ছেন, গ্রামীণের মতো কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। হয়তো সেখানে দুর্বলতা আছে কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো যে বলছে, তিনি নির্বাচিত নন—তা শুনতে আমরা রাজি নই। তিনি রক্ত দিয়ে নির্বাচিত। আমরা বরং তাঁকে পূর্ণ ক্ষমতা দিইনি। পূর্ণ ক্ষমতা দিলে তিনি সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে পারতেন। জলমহাল, নদী, খাল উদ্ধার করা যেত। এলাকায় এলাকায় বিএনপির দখলবাজির শায়েস্তা করতে কম সময় লাগত। একটি পূর্ণ ক্ষমতাসম্পন্ন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করাই এখন প্রধান কাজ। সেটি করতে পারলে বাকি সমস্যার সমাধান সহজ হয়ে যাবে। আপনি যে রাজনৈতিক দলগুলোর কথা বলছেন, তারা আসলে রাজনৈতিক দল কি না, তা আমরা ঠিক করব নতুন গঠনতন্ত্রের মধ্য দিয়ে। এই যে গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশে আইন করা হয়েছে, সেই আইনই তো বলে দেয় কে রাজনৈতিক দল আর কে নয়? তাহলে নতুন গঠনতন্ত্রই সাব্যস্ত করবে কারা রাজনৈতিক দল আর কারা নয়। তারপর কথা। তা ছাড়া ফ্যাসিস্ট দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে কি রাজনীতি করতে দেওয়া উচিত? কিংবা যে দল ১৯৭১ সালে পুরো জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, তাকে কি এই নামে রাজনীতি করতে দেওয়া উচিত? ইসলাম গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এটি আমার ইতিহাসের অংশ। কিন্তু সেটি কীভাবে থাকবে, তা তো আলাপ-আলোচনার বিষয়। ইসলামি রাষ্ট্র বানালে তো ইসলাম কায়েম হবে না। ইসলাম আমার দৈনন্দিন বাস্তবতা, নৈতিকতা, সংস্কৃতি এসব ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। সেটিকে আমার আত্মস্থ করতে হবে। এ জন্য আমি গঠনতন্ত্র শব্দটা বলি।
গণ–অভ্যুত্থানের সময়কার বাস্তবতা এখন আর নেই। আপনি যে প্রস্তাবগুলো দিচ্ছেন, সেগুলো এখন কতটা বাস্তবায়নযোগ্য? আপনাকে কি আমি কল্পনাবাদী বলব?
ফরহাদ মজহার: গণ–অভ্যুত্থান ও গঠন: বাংলাদেশে গণরাজনৈতিক ধারার বিকাশ প্রসঙ্গে বইটি কিন্তু আমি ২০২৩ সালে লিখেছিলাম। তখনই গণ–অভ্যুত্থানের ইঙ্গিত দিয়েছি। সব রাজনৈতিক দলকে বোঝানোর জন্য মানবাধিকার মঞ্চ তৈরি করে বলেছিলাম, গণ–অভ্যুত্থানই করতে হবে। গণ–অভ্যুত্থান তো হয়ে গেল। এটি করে ফেলার পর তো আমার মধ্যে প্রচুর আত্মবিশ্বাস। বাংলাদেশ হবে পুরো উপমহাদেশকে পুনর্গঠন করার কেন্দ্র। নেতৃত্ব আমাদের তরুণদেরই নিতে হবে। আমি নিশ্চিত, আমি যে কথাগুলো বলছি তা বাস্তবায়িত হবে।
অন্য একটা প্রসঙ্গে যাই। শেখ হাসিনার সরকার তাদের সব অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতির ন্যায্যতা দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের একটা সংকীর্ণ বয়ান হাজির রেখে। ফলে তাদের পতনের পরে অনেকে আশঙ্কা করছেন, মুক্তিযুদ্ধই প্রশ্নের মধ্যে পড়ে গেল কি না...
ফরহাদ মজহার: দেখুন, ১৯৪৭ সালে আমাদের লড়াইটা কী ছিল? জমিদার আর মহাজন শ্রেণি আমাদের শোষণ করছে। আমাদের জমিহারাদের রক্ত ও ঘামের ওপর কলকাতা শহর গড়ে উঠেছে। এটাই ইতিহাস। আমরা তো সাতচল্লিশে দেশভাগ চাইনি; চেয়েছি একটি ইউনাইটেড বেঙ্গল নেশন। ইউনাইটেড স্টেটস অব ইন্ডিয়া হতে পারলে ইউনাইটেড বেঙ্গল হতে পারবে না কেন? সোহরাওয়ার্দী, শরৎ বোস প্রমুখ তাই চেয়েছিলেন, জিন্নাহরও সম্মতি ছিল। আমরা তো দেশভাগ করতে চাইনি। আমাদের শেখানো হয়েছে মুসলমানরা নাকি দেশভাগ চেয়েছে। এখন ঐতিহাসিকদের গবেষণায় প্রমাণিত এই কাজ উচ্চবর্ণের বাবুরা করেছেন। দেশভাগের পর কী হলো? আমরা একটা ধর্মবাদী রাষ্ট্র গঠন করলাম। ভারতও ধর্মবাদী ছিল, যেটা এখন হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র আকারে পরিগঠিত হয়েছে। আমাদের জমির সমস্যা যখন মিটে গেছে, তখন বায়ান্নতে আমরা সংস্কৃতি ও ভাষা দিয়ে লড়েছি। আমরা রক্ত দিয়ে বাঙালি হয়েছি। আমরা নিছক ভারতীয় নই, পশ্চিমবঙ্গের ভারতীয়ও নই। বাঙালি হওয়ার জন্য আমাদের শহীদ হতে হয়েছে। বাংলা ভাষায় কথা বলার জন্য, রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়ার জন্য আমাদের রক্ত দিতে হয়েছে। ফলে মুক্তিযুদ্ধ যেকোনো প্রশ্নের একেবারে ঊর্ধ্বে। তাই কেউ যদি বলে চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থান দিয়ে একাত্তরকে বাদ দিচ্ছি, সেটা একেবারে বাজে কথা। তাহলে ঘটনাটা কী ঘটল? একাত্তরে আমরা একটা স্বাধীন ভূখণ্ড আদায় করেছি। কিন্তু এর পরে অনেকগুলো ভাবাদর্শগত প্রশ্নের মীমাংসা আমরা করতে পারিনি। এ কারণে শেখ হাসিনার মতো ফ্যাসিস্ট সরকার পেয়েছি। সেসব ভাবাদর্শগত প্রশ্নের মীমাংসার জন্যই চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থান হয়েছে। এবার গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠন করবার পালা।
এর মধ্য দিয়ে সাতচল্লিশ থেকে পরবর্তী ইতিহাসের ধারাবাহিকতা দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করলাম, এই দেশ শুধু বাঙালির নয়, সকলের, ছোট–বড় সকল জাতিসত্তার, সকল ধর্মের সকল বিশ্বাসের, আস্তিক কি নাস্তিক সকলের ইত্যাদি। এই বাংলাদেশ পুরো উপমহাদেশ পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেবে। প্রাক্-ঔপনিবেশিক অভ্যস্ত চিন্তা থেকে এ জন্য সবাইকে বেরিয়ে আসতে হবে। বাংলা এখন বিভিন্নভাবে আসবে। বখতিয়ারের ঘোড়া আকারে নয়, কিন্তু ইসলাম উপমহাদেশের ইতিহাসের অঙ্গাঙ্গি অংশ। উপমহাদেশের ইতিহাস ইসলামেরও ইতিহাস। অর্থাৎ আমরা একটি বুদ্ধিবৃত্তিক-সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। জুলাই গণ–অভ্যুত্থান তার প্রমাণ। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান আমাদের সেদিকে নিয়ে যাবে। এটা করতে গিয়ে আমাদের অনেক দুর্বলতা বের হবে। অনেক ব্যর্থতা থাকবে। কিন্তু আমরা তা কাটিয়ে উঠব। আমরা ইতিহাসের আরেকটা স্তরে উপনীত হতে পারব।
আমাদের নদীবিধৌত বাংলার তো নিজেরই একান্ত বহু ধর্মীয় ভাব আছে—নাথ, বৈষ্ণব, শাক্ত, বাউল, মারেফতপন্থা। এদেরও তো বিরাট দাবি আছে
ফরহাদ মজহার: অবশ্যই। আমাদের মধ্যে এসব ভাব তো একাকার হয়ে আছে। ফকির লালন সাঁই, জালালউদ্দীন খাঁ, রাধা বল্লভ, খালেক দেওয়ান, আবদুল হালিম বা ফকির–দরবেশ–বয়াতিদের হাতে এটা হয়েছে। সুফিরা করেছেন। তারও আগে বৌদ্ধ সহজিয়ারা করেছেন। আশ্চর্যজনকভাবে পূর্ব বাংলাতেই এটা হয়েছে। বাংলা সব সময় সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ধর্মের সঙ্গে মোকাবিলা করেছে। নামাজ হচ্ছে; আবার তার পাশেই গান হচ্ছে, ‘মানুষ থুইয়া খোদা ভজ, এ মন্ত্রণা কে দিয়েছে?’
ধর্মকে দর্শন আর আইন আকারে হাজির করা পাশ্চাত্যের অবদান। ইসলামে আল্লাহ সব সময় কোনো না কোনো রুহানির পথ আপনাকে দেখাচ্ছে। কোনো ব্যক্তি সত্যের দাবি করতে পারে না। কারণ, মানুষ মৃত্যুর দ্বারা সীমিত। স্থানকালে আবদ্ধ। আপনি নশ্বর। মহানবী (সা.) মক্কা বিজয়ের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করলেন যে মানুষের মধ্যে রক্ত, গোত্র, জাতিকেন্দ্রিক কোনো পরিচয়বাদ থাকতে পারে না। মানুষের একটাই পরিচয়, সে আদম ও হাওয়ার সন্তান। মূলে সে একটাই জাতি। নৃতাত্ত্বিক অর্থে বিভিন্ন জাতি ও ভাষা তৈরি করে আল্লাহ বলছেন, তারা যেন পরস্পরকে চেনার চেষ্টা করে। তাদের সবাইকে নিয়ে বিশ্বসমাজ গড়তে হবে। এর সঙ্গে কমিউনিজমের কী তফাত? মার্ক্স তো কমিউনিজমকে কোনো ইডিওলজি বা ধর্ম বলেননি, বিশ্বসমাজ গঠনের দিক থেকে মানবেতিহাসের অভিযাত্রা বুঝিয়েছেন। তাই না?
আমাদের লড়াইয়ের এই যে দীর্ঘ পথ, এখানে দাঁড়িয়ে আপনি বাংলাদেশের কী ভবিষ্যৎ দেখেন?
ফরহাদ মজহার: আমি মনে করি, বাংলাদেশ হিসেবে আমরা সাংঘাতিক ভালো করেছি। পশ্চিমকে কত শতাব্দী পার করে এখানে পৌঁছাতে হয়েছে ভেবে দেখুন! আমরা তো মাত্র ৫০ বছরে এত দূর চলে এলাম। আমরা এখন ঢাকায় বসে সাহস করছি পশ্চিমকে মোকাবিলা করার। বায়ান্নতে রফিক, জব্বাররা শহীদ হলেন। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি,’ এর মধ্য দিয়ে নতুন চেতনার যে বীজ পোঁতা হলো, সেটি দিয়েই তো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা বাংলাদেশ পেয়েছি। চব্বিশে আমরা আরেকটা বড় বীজ বুনেছি। এটি মহিরুহ হবেই। তার কাছে আগামী আরও ৫০ বছরও কিছু না। এখনকার তরুণ প্রজন্ম অদ্ভুত সব চিন্তা করছে, স্বপ্ন দেখছে। এই বাংলাদেশ তো পরাজিত হতে পারে না। আপনি মারপিট করতে পারেন, গৃহযুদ্ধ বাধাতে পারেন, কিন্তু বাংলাদেশ কখনোই সিরিয়া হবে না। মধ্যপ্রাচ্যে তো আমাদের তরুণদের মতো এমন চিন্তা বিকশিত হয়নি। মধ্যপ্রাচ্যে কী ঘটনা ঘটছে, তার তো কিছু খোঁজখবর রাখি আমি। আর ইসলাম মধ্যপ্রাচ্যে এসেছে দেড় হাজার বছর আগে। আমরা এখানে তারও বেশি সময়ের দীর্ঘ ইতিহাস বহন করে চলেছি। বিভিন্ন ধর্মভাব, ভাবান্দোলন, কাব্য, সাহিত্য—নানাভাবে আমাদের সমৃদ্ধ করেছে।
এই পুরো মন নিয়েই আমাদের দাঁড়াতে হবে। এ জন্য যে রাজনৈতিক পরিসর দরকার, সেটা আমরা বাংলাদেশে তৈরি করতে চাই। ভারত এখানে বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে পড়েছে। হিন্দুত্ববাদের কারণে দৌড়ে সে আমাদের সঙ্গে পারবে না। বাংলা ভাষার মধ্যেই এখানে বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবটা ঘটবে। আমাদের চেতনার মূল বীজটা রোপিত হয়ে গেছে। পাটাতন তৈরি হয়ে গেছে। আমি এক ফোঁটাও হতাশ নই।
২০২৪ সালের বিদায়ের লগ্নে প্রশ্ন উঠেছে: গণতন্ত্র কি "নির্বাচনের বছর" টিকে আছে? কারণ, বছরটি ছিল নির্বাচনের। বিশ্বের অর্ধেক জনগোষ্ঠী ভোট দিয়েছেন। সিংহভাগ দেশে নির্বাচনও সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু নির্বাচনের বছরে গণতন্ত্র কতটুকু সুসংহত হয়েছে, এমন প্রশ্ন পণ্ডিতদের মনে সঞ্চারিত হয়েছে।
কেন নির্বাচনের বছরে গণতন্ত্রের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন? কারণ একাধিক। নির্বাচন বহু দেশে গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত করার বদলে স্বৈরতন্ত্রকে পাকাপোক্ত করেছে। গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে একনায়কতন্ত্র দখল করেছে রাজনীতি। যার প্রতিফল হলো গণঅসন্তোষ। গণআন্দোলন। রক্তাক্ত পথে ক্ষমতার পালাবদল। ফলে নির্বাচনের বছরে প্রধান চরিত্র হয়েছে স্বৈরাচার বিরোধী গণআন্দোলন। বছরের মধ্য থেকে শেষার্ধে বাংলাদেশ থেকে সিরিয়া পর্যন্ত দেখা গেছে এমনই দৃশ্যপট। ইকোনোমিস্ট বছরের সেরা দেশের তকমা দিয়েছে রক্তাক্ত জুলাই গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতিবাহী বাংলাদেশকে।
নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী মারিয়া রেসা কিছুদিন আগে এক সাক্ষাৎকারে সতর্ক করে দিয়েছিলেন, "২০২৪ সালের শেষ নাগাদ বিশ্ব জানবে গণতন্ত্র বেঁচে আছে নাকি মরেছে।" তার মতে, ২০২৪ সালে, "নির্বাচনের বছর"-এ বিশ্বের অর্ধেক জনসংখ্যা ভোট দেবে। কিন্তু ভোটারদের এই ঢেউ ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জ হিসাবে ব্যালট বাক্সের দিকে যাবে, নাকি বৈশ্বিক কর্তৃত্ববাদী প্রভাব, বিদেশী তথ্যের কারসাজি এবং প্রযুক্তির নতুন ফর্ম-এর মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী নির্বাচন এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিপন্ন করার জন্য "একটি নিখুঁত ঝড়" হিসাবে বিবেচিত হবে? বছরটি শেষ হওয়ার সাথে সাথে প্রশ্ন করার সময় আসবে পারে: গণতন্ত্র কেমন চলছে? আর তখনই বলা হবে, গণতন্ত্র কি "নির্বাচনের বছর" টিকে আছে বা ছিল? যেমনটি জার্নাল অব ডেমোক্রেসিতে প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন ইন্টারন্যাশনাল ফোরাম ফর ডেমোক্রিটিক স্টাডিজ-এর পরিচালক জন কে গ্যালেন Is Democracy Surviving the “Year of Elections”? শিরোনামের এক প্রবন্ধে।
গণতন্ত্র ক্ষুন্ন হয়েছে এজন্য যে, ২০২৪ সালের নির্বাচনগুলো স্বচ্ছ ও অবিতর্কিত চরিত্র ধরে রাখতে পারে নি। এর নেপথ্যে রয়েছে তিনটি প্রবণতা:
প্রথমত, গণতন্ত্রের নামে কর্তৃত্ববাদী শাসন বৈধতার বিভ্রম তৈরি করতে জাল নির্বাচনের উপর নির্ভর করেছে।
দ্বিতীয়ত, ভোটের মাঠে গণতন্ত্রগুলো বিদেশী তথ্যের কারসাজির চ্যালেঞ্জ থেকে প্রভাব মুক্ত থাকতে পারে নি।
তৃতীয়ত, নির্বাচনের উপর নতুন জেনারেটিভ-এআই সরঞ্জামগুলোর প্রভাব সম্পর্কে উদ্বেগ ব্যাপক হয়েছে এবং এটিও স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে AI এর আসল হুমকি তাদের ভোট পরিবর্তন করার জন্য লোকেদের প্রতারণা করার ক্ষমতা, যা নির্বাচন এবং গণতন্ত্র সংক্রান্ত বিশ্বাসকে দুর্বল করেছে।
এসব কারণেই ইন্টারন্যাশনাল আইডিইএ-র একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, জরিপ করা উনিশটি দেশের মধ্যে এগারোটিতে, অর্ধেকেরও চেয়েও অনেক কম লোক বিশ্বাস করে নি যে, তাদের দেশে সাম্প্রতিকতম নির্বাচন "অবাধ ও সুষ্ঠু" হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ২০২৪ সালের নির্বাচনগুলো কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার দ্বারা নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করার এবং জোরপূর্বক নিজেদের বৈধতা দেওয়ার প্রচেষ্টাগুলো প্রত্যক্ষ করেছে, যা প্রকারান্তরে গণতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
অধিকাংশ নির্বাচনেই বিরোধী, মধ্যপন্থী এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেওয়া হয় নি। সরকারে আসীন কর্তৃত্ববাদীরা নিজেদের শুধুমাত্র একতরফা নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সীমাবদ্ধ রাখে নি। বরং তারা নির্বাচনকে "তথ্যের কারসাজির জন্য যুদ্ধক্ষেত্র" হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তদুপরি, সরকারিভাবে প্রশাসনিক শক্তি এবং বেসরকারিভাবে ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক শক্তি প্রতিপক্ষকে এমনভাবে চেপে ধরেছিল যে, নির্বাচন প্রহসনে পরিণত হতে বাধ্য হয় এবং গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়। ফলে নির্বাচনের পথ ধরে গণতন্ত্রের বা জনমনের বিকাশের বদলে কর্তৃত্ববাদের পুনর্বাসন হয়েছে। যেজন্য বিশ্বব্যাপী এই প্রশ্ন শোনা যাচ্ছে যে, গণতন্ত্র কি "নির্বাচনের বছর" টিকে আছে?
সামগ্রিকভাবে, নির্বাচনী বছর ২০২৪ সালে গণতন্ত্রের ছবিটি খুবই ধূসরিত ও ঝাপসা। কর্তৃত্ববাদ, স্বৈরতন্ত্র ও একনায়কবাদ কবলিত হয়ে নির্বাচনের পবিত্রতা এবং গণতন্ত্রের শক্তির ব্যাপক পতন হয়েছে ২০২৪ সালে। এমন ন্যাক্কারজনক তথ্যও ফ্রিডম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড-এর রিপোর্টে দেখা যায়, একটি বিরোধী দল অপ্রত্যাশিতভাবে সংসদ নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি অংশ জিতেও ক্ষমতাসীনদের দ্বারা সরকারে প্রবেশ বাধাগ্রস্ত হয়।
ফলে নির্বাচনের বছরটি বাস্তব পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়েছে বলা যাবে না। এটি নিছক নির্বাচনের বছর এজন্য যে এ বছর অনেকগুলো নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু নির্বাচনগুলো গণতন্ত্রের বিকাশ ও শক্তি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখার বদলে কর্তৃত্ববাদীদের দ্বারা লুণ্ঠিত হয়েছে। প্রার্থীদের বিপদের পাশাপাশি নাগরিকদের ভোটদানের মুহুর্তগুলো ছিল আক্রান্ত আর গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল বিপন্ন, যা নির্বাচন ও গণতন্ত্রের প্রতি আস্থার সঙ্কট সৃষ্টি করেছে। বহু ক্ষেত্রে সহিংসতাকে উৎসাহিত করা হয়েছে এবং এমন সব কাজ করা হয়েছে, যা মৌলিক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থী।
অতএব, গণতন্ত্র কি "নির্বাচনের বছর" টিকে আছে বা ছিল মর্মে যেসব প্রশ্ন বছর শেষে উঠতে তা বহুলাংশেই যথার্থ। তবে এসব প্রশ্নের উত্তর এবং নির্বাচন ও গণতন্ত্র সংশ্লিষ্ট সমস্যাগুলো থেকে উত্তরণের পথ দেখানো বিদায়ে পথে চলা ২০২৪ সালের পক্ষে দেওয়া আর সম্ভব হবে না। উত্তর ও উত্তরণের পথ ও পন্থা পাওয়া সম্ভব হবে আগত ২০২৫ সালে এবং সামনের অনাগত বছরগুলোতে।
ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; প্রফেসর ও চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।