দুর্নীতির বিরুদ্ধে চলমান ধরপাকড় কি আদৌ সর্বজনীন হবে!

  • আশরাফুল ইসলাম পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

দুর্নীতি নিয়ে সমাজ-রাজনীতির অঙ্গন এখন বেশ সরগরম। এই সময়ে কোনো চাঞ্চল্যকর ঘটনায় জনউত্তাপ আর আগের মতো শুধুই চায়ের আড্ডায় সীমাবদ্ধ থাকছে না। সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে মুখরোচক কোনো বিষয় ফেসবুকের মতো সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে ‘ভাইরাল’ হয়ে নিমেষেই অগণিত মানুষের ‘লাইক, কমেন্টস আর শেয়ার’-এর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে। মিনিট থেকে ঘণ্টার ব্যবধানে তা দেশের গণ্ডি ছাপিয়ে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে।

বিশ্বজুড়ে আমাদের প্রবাসীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার কারণে দুর্নীতিবাজদের ধরপাকড়ে নিজেদের প্রতিক্রিয়া জানানোর সুযোগ তারাও পাচ্ছেন। এর ফলে দুর্নীতিবাজদের অবৈধ সম্পদ দেশে কিংবা বিদেশে, যেখানে থাকুক না কেন, মুহূর্তেই তা প্রকাশ্যে চলে আসছে। তাই, ডিভাইন জাস্টিজ বা প্রকৃতির বিচার বলে যে কথাটি শোনা যেতো, তা এখন বাস্তব হয়ে উঠছে বলেই মানছেন সবাই। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বেশকিছু দুর্দণ্ড প্রতাপশালী দুর্নীতিবাজ ও তাদের ঘিরে বেরিয়ে আসা চাঞ্চল্যকর দুর্নীতির তথ্য সমাজ বিজ্ঞান গবেষণার অনেক নতুন দিক উন্মোচন করছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

আমরা দেখতে পাচ্ছি, সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ, পুলিশের  সাবেক প্রধান বেনজীর আহমেদ, এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর কিংবা সবশেষ সরকারি কর্ম-কমিশনের সাবেক গাড়িচালক আবেদ আলীসহ অন্যান্য সাবেক ও বর্তমান সরকারি কর্মচারীদের বিস্ময়কর অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার ঘটনাগুলো প্রকাশ্যে আসার পর থেকে এক বিরাট মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে।

নিজেদের দুর্নীতিবাজ চরিত্র ঢাকতে আলোচিত-সমালোচিত এই ব্যক্তিরা ধার্মিক ও সমাজসেবক সাজার চেষ্টা করেও গণমানুষের কাছে স্থান পাননি। বরং তাদের ভণ্ডামি সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। অতীতের মতো দুর্নীতিবাজদের রক্ষায় প্রভাবশালীদের প্রকাশ্য চেষ্টা-তদবিরও যে এখন খুব একটা সক্রিয় নয়, তা ভালোভাবেই টের পাওয়া যাচ্ছে। প্রভাবশালীরাও ফেঁসে যেতে পারেন এই শঙ্কায় হয়ত আগের মতো আশীর্বাদের হাত আর তারা প্রসারিত করছেন না।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কিংবা সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থাগুলো এখন যে সক্রিয়তার পরিচয় দিচ্ছে বা দিতে বাধ্য হচ্ছে, নিকট অতীতে তারা আসলে কোথায় ছিলেন! যদি ধরেও নিই ‘শত্রুর শত্রু মিত্র’ এই ফর্মূলায় হয়ত দুর্নীতিবাজদের শত্রু কেউ গণমাধ্যমে তথ্য তুলে দিয়ে সে সব বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশে প্ররোচিত করেছিলেন; কিন্তু তার আগে প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মতৎপরতা কোথায় ছিল! ‘নখদন্তহীন বাঘ’ খেতাব নিয়ে বছরের পর বছর তারা কি তবে জনগণের করের টাকায় মাছি মারছিলেন!

দুর্নীতির বিরুদ্ধের এবারের গৃহীত পদক্ষেপের মধ্যে আদালতের হস্তক্ষেপে দুর্নীতিবাজদের সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্তের দৃষ্টান্ত আপাতদৃষ্টিতে খুব আশাব্যঞ্জকই মনে হচ্ছে। কিন্তু সাধারণ জনগণের এই আশা কতদূর অবধি টিকে থাকবে, সেটাই বড় প্রশ্ন!

গেল কয়েক দিন পথে-ঘাটে চলতে-ফিরতে সাধারণ মানুষের মুখে বহু কথাই শোনা যাচ্ছে। চলমান ঘটনাপ্রবাহে তাদের যথেষ্ট সজাগ দৃষ্টি রয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। সাধারণ মানুষ বলছেন, গুটি কয়েক সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীর অবৈধ সম্পদের পরিমাণ যদি এই হয়, তবে তাদের যারা নিয়ন্তা সেই নীতি-নির্ধারকদের অর্জিত অবৈধ সম্পদ কী পরিমাণ হতে পারে! সাধারণের এই প্রশ্নের যৌক্তিকতা নিয়ে যে কোনো প্রশ্ন নেই, তা বলাই বাহুল্য। তাদের মতে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে এই ধরপাকড় যদি সর্বজনীন করা যায় এবং ধৃত সব দুর্নীতিবাজদের সম্পদ যদি রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা সম্ভব হয়, তাহলে কয়েক বছরের জাতীয় বাজেটের সমপরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করাও অসম্ভব নয়।

কিন্তু বাস্তবতা যে সাধারণ মানুষের মতের অনুকূলে সরলরেখায় চলে না, তা আমরা ভালোভাবেই অনুধাবন করতে পারি। আমরা জানি, বর্তমান বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্রে যারা প্রভাব বিস্তার করেন ও অবৈধ সম্পদ অর্জন যাদের করায়ত্ত, তারা কেবলমাত্র প্রশাসন কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যই নন, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টরেই এই ‘ক্ষমতাবানদের’ দৌরাত্ম্য আছে। সব সেক্টরেই এই রাঘববোয়ালদের সগৌরব উপস্থিতি।

সবাইকে ছাপিয়ে যারা সমাজ ও রাষ্ট্রকে নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে পরিচালনা করেন, সেই রাজনীতিবিদরাও কি এই বিতর্কের ঊর্ধ্বে! অতীত ও বর্তমানের অগণিত দৃষ্টান্ত টেনে জোর দিয়ে এটি বলা যাবে যে, কোনোভাবেই রাজনীতিবিদরাও দুর্নীতির প্রশ্নে চলমান এই বিতর্কের বাইরে নন। কিন্তু গেল কয়েক মাসের ঘটনাবলি মূল্যায়ন করলে রাজনীতির মানুষদের এই ধরপাকড়ে খুব একটা দেখা যাচ্ছে না, বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।

সে কারণেই জনগণের মনে সেই জিজ্ঞাসার উদয় হওয়া অসঙ্গত নয় যে, চলমান দুর্নীতিবিরোধী ধরপাকড় বা কঠোর অবস্থান ‘জিরো টলারেন্স’ সর্বজনীন হয়ে  ওঠেনি এখনো। তাই, আমাদের প্রত্যাশা যে, দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনে যারা পা বাড়িয়েছেন, তাদের ধরতে সর্বজনীন অভিযান হোক; কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণির বিরুদ্ধে নয়! তবেই এই তথাকথিত ‘কঠোর অবস্থান’ প্রশ্নাতীত হবে।