কোটাবিরোধী আন্দোলন

‘কোটা’ কী, কেন, আদালতের বাইরে কি সমাধান সম্ভব!

  • মবিনুল ইসলাম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪, কোটাবিরোধীদের আন্দোলনের কারণে স্থবির ঢাকা

ছবি: বার্তা২৪, কোটাবিরোধীদের আন্দোলনের কারণে স্থবির ঢাকা

অনগ্রসর ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিতে বিশ্বের অনেক দেশে কোটাসহ নানান সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। কোটা একটি আপৎকালীন ব্যবস্থা। এটি অনন্তকাল চলতে পারে না আবার এটিকে অধিকার হিসেবেও দাবি করা যায় না।

বাংলাদেশের সরকারি চাকরিতে কোটাপদ্ধতি চালুর ইতিহাস বেশ পুরনো। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত ৮০ শতাংশ পদে কোটায় নিয়োগ দেওয়া হতো। বাকি মাত্র ২০ শতাংশ নিয়োগ হতো মেধার ভিত্তিতে।

বিজ্ঞাপন

১৯৭৬ সালের পর মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের সংখ্যা বাড়িয়ে ৪০ শতাংশ করা হয়। ১৯৮৫ সালে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে মেধার ভিত্তিতে ৪৫ শতাংশ ও বাকি ৫৫ শতাংশ অগ্রাধিকার কোটায় নিয়োগ দেওয়া হতো। শুরু থেকেই মুক্তিযোদ্ধা কোটা বিদ্যমান ছিল।

অগ্রাধিকার কোটার মধ্যে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, ১০ শতাংশ নারী, ১০ শতাংশ জেলা কোটা ও ৫ শতাংশ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটা বিদ্যমান ছিল। পরে অবশ্য ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী কোটা চালু হয়। দেশের সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদেরও বয়স বাড়তে শুরু করলে মুক্তিযোদ্ধার ৩০ শতাংশ পদের অধিকাংশই খালি পড়ে থাকতো।

বিজ্ঞাপন

খালি থাকা এসব পদে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হতো। পরে এ কোটায় মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এবং তারপর নাতি-নাতনিদের যুক্ত করা হয়।

দেশের সরকারি চাকরির অধিকাংশ পদ কোটাভিত্তিক নিয়োগ হওয়ায় মেধাবীদের মধ্যে ক্ষোভ অনেকদিনের। দেশে মেধার মূল্যায়ন না হওয়ায় তারা বিভিন্ন দেশে গিয়ে সেদেশের শিক্ষা-সংস্কৃতি, বিজ্ঞান তথা অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন।

আমার মতে, কোটা নিয়ে বিতর্কের কোনো কারণ নেই। সরকারি চাকরিতে ৮০ শতাংশ কিংবা ৫৬ শতাংশ কোটা যেমন কাম্য নয়, তেমনি অনগ্রসর কিংবা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা পদ্ধতি তুলে দেওয়াও অযৌক্তিক।

কোন জনগোষ্ঠী, কোন বিষয়ে কতটুকু পিছিয়ে আছে, তার হিসাব করে করে প্রতি ৫ বছর পরপর কোটা পদ্ধতি সংস্কার করা প্রয়োজন।

বীর মুক্তিযোদ্ধারা দেশের সূর্য সন্তান! তাদের জন্য কোটা থাকবে তাতে কারো আপত্তি নেই; থাকার কথাও নয়। ৩০ লাখ বীর মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। এর কারণে তার পরিবার, সন্তানরা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধা কোটা পূরণ করতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের দিয়ে শূন্য কোটা পূরণ করা পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু তাদের নাতি-নাতনিরাও এ সুবিধা পাবেন এটা কাম্য নয়।

দেশ চালাতে মেধাবী ও দক্ষ জনশক্তি প্রয়োজন। মেধাবী ও দক্ষ জনশক্তি অবমূল্যায়ন করে কোটায় স্কুল-কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়ে কোটায় চাকরি পাওয়া অপেক্ষাকৃত কম মেধাসম্পন্ন জনশক্তি দিয়ে দেশকে কতটুকু এগিয়ে নিতে পারবেন। বংশ পরম্পরায় রাজা হওয়া যায় কিন্তু বংশ পরম্পরায় মেধাবী ও দক্ষ হওয়া যায় না।

আজকাল কোটাবিরোধী আন্দোলনে নারীদের হাতে প্ল্যাকার্ড দেখে এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়, তারাও আজকাল নারী কোটায় চাকরি চান না। এটা তারা ‘অবমাননাকর’ মনে করেন। তারাও মেধারভিত্তিতে চাকরি পাওয়ার পক্ষে সোচ্চার।

সরকারি চাকরিতে কোটার বিন্যাস
বর্তমানে সরকারি চাকরির নিয়োগে মুক্তিযোদ্ধা ৩০ শতাংশ (ছেলে-মেয়ে ও নাতি-নাতনি), নারী ১০ শতাংশ, জেলা কোটা ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য ৫ শতাংশ। এই ৫৫ শতাংশ কোটায় পূরণযোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে সেক্ষেত্রে ১ শতাংশ পদে প্রতিবন্ধী নিয়োগের বিধান রয়েছে। বাকি ৪৫ শতাংশ সাধারণ মেধাবীদের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়।

কোটাবিরোধী শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর সরকারি চাকরিতে নারী কোটা ১০ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ এবং জেলা কোটা ১০ শতাংশ বাতিল করে পরিপত্র জারি করে সরকার।

ওই পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাতজন। আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ৫ জুন হাইকোর্ট ‘মুক্তিযোদ্ধা’ কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন।

এরপরই সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করে ২০১৮ সালে জারি করা পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে রাজধানীর শাহবাগ, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, নীলক্ষেতসহ বিভিন্ন এলাকায় নেমেছেন শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রত্যাশীরা।

রোববার (৭ জুলাই) ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি পালনকালে আন্দোলনকারীরা রাস্তায় নামলে এসব এলাকার আশপাশের রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ে অসহনীয় যানজট। এতে সাধারণ মানুষের চলাচলে সৃষ্টি হয় চরম ভোগান্তি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘২০১৮ সালে যখন কোটাবিরোধী আন্দোলন হলো, তখন সরকারের পক্ষ থেকে কোটা রহিত করা হলো। বিগত কয়েক বছর সেভাবেই সরকারি নিয়োগগুলো হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা কোটা বিষয়ে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান রিট করায় আবারও সেই কোটা কার্যকর করার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। কোটা প্রথা রহিত করার সিদ্ধান্ত যেহেতু সরকারের, তাই সরকারের সিদ্ধান্ত বহাল রাখতে সরকার সুপ্রিম কোর্টে আপিলও করেছে।

আন্দোলনকারীরা কোটা সংস্কারের কথা বলছেন। সংস্কার হতে পারে। কিন্তু যেহেতু বিষয়টি এখনও বিচারাধীন, তারা অপেক্ষা করতে পারতো।’

কোটার যথাযথ প্রয়োগের উদাহরণ তুলে ধরে অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আছেন, ছাত্র আছেন; যারা কোটার সুবিধা নিয়েছেন। যে একবার ভর্তির ক্ষেত্রে সুযোগ পান, তাহলে চাকরির ক্ষেত্রে আবার চান, সেটা ঠিক হবে না।

যদি কেউ ভর্তির ক্ষেত্রে ব্যবহার করেন, তাহলে চাকরির ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারবেন না। মেধাবীরা চাকরি পাক, সেটা আমরা অবশ্যই চাইবো। একইসঙ্গে সমাজে যারা পিছিয়ে পড়া, তারা যেন সামনে আসতে পারেন, সেটাও দেখা দরকার।’

মুক্তিযোদ্ধা কোটা প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই উপাচার্য বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মুক্তিযোদ্ধারা কোটার সুবিধা পাননি। সে কারণে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আবার মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা চালু করা হলো। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের তখন আর বয়স ছিল না। তাই তাদের সন্তানদের জন্য উন্মুক্ত করা হলো। পরবর্তী সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিদের কোটা সুবিধার আওতায় আনা হলো। এখন যদি মুক্তিযোদ্ধাদের কোটার প্রয়োজন না পড়ে কিংবা মুক্তিযোদ্ধারা আর্থিকভাবে সচ্ছল হয়ে থাকেন, তাহলে সেই সুযোগ প্রয়োজন নেই। তবে যারা আর্থিকভাবে অসচ্ছল, তাদের প্রয়োজন আছে। তবে কোটার বিন্যাস বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে হওয়া উচিত।’

আদালতের বাইরে কি এর সমাধান সম্ভব
সরকারি চাকরিতে কোটাবিরোধীদের রোববারের (৭ জুলাই) ‘বাংলা ব্লকেড’ আন্দোলনে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন এলাকায় সড়ক, মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন শিক্ষার্থীরা। তাদের কথা, আদালতের মাধ্যমে নয়, আন্দোলনের মাধ্যমেই দাবি আদায় করবেন।

কোটাবিরোধীদের আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘এটা হাইকোর্টের রায়। এটার বিরুদ্ধে এভাবে আন্দোলন করা, এটা তো সাবজুডিস। কারণ, আমরা সরকারে থেকে কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো কথা বলতে পারি না। হাইকোর্ট রায় দিলে সেটা হাইকোর্ট থেকেই আবার আসতে হবে’।

সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘বিষয়টি আদালতের বাইরেও সমাধান সম্ভব। আদালতের রায় সরকার মানতে বাধ্য। কিন্তু কোটার পক্ষে বিপক্ষের নেতৃবৃন্দ সরকারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে এর সমাধান করতে পারেন।

আমার মনে হয়, যারা কোটাবিরোধী, তারা কোটা পদ্ধতি সম্পূর্ণরূপে বাতিল হোক, তা তারা চান না। সুতরাং আদালতের বাইরেও আলোচনার মাধ্যমে এটি সমাধান উভয়পক্ষের জন্যই মঙ্গলজনক হবে’!

এ বিষয়ে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন,‘পূর্ণাঙ্গ রায় দেখার আগে মন্তব্য করা ঠিক হবে না। তবে সাদা চোখে দেখলে, সরকার এর আগে প্রজ্ঞাপন জারি করে কোটা পদ্ধতি বাতিল করেছিল। ফলে, এটা স্পষ্ট যে, সরকারের হাতে কোটা বাতিলের ক্ষমতা আছে। এখন যেহেতু আদালতের রায়ে কোটা আবার বহাল হয়েছে আর এটা তো সত্য যে, প্রতিবন্ধী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, সত্যিকার অর্থে যারা অনগ্রসর, তাদের জন্য কোটা রাখা প্রয়োজন। তাই, সরকার কিছুদিন পরে কোটা পদ্ধতি সংস্কার করে আবার প্রজ্ঞাপন জারি করতে পারে। আদালতের ব্যাপারে সরকার তো কিছু বলতে পারে না। কিন্তু তার প্রজ্ঞাপন জারি করার ক্ষমতা রাষ্ট্রের আছে।’

তবে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘বিষয়টি এখন আদালতে বিচারাধীন। এখন তো কারো কিছু করার নেই। আমরা হাইকোর্টের রায়ের পর পরই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছি। আদালত কী সিদ্ধান্ত দেয়, সেটা দেখতে হবে। বিচার-প্রক্রিয়া চলাকালে তো কিছু করা যাবে না’!

কোটা-বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কারী আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘আমরা কোটা সমস্যার একটা স্থায়ী সমাধান চাচ্ছি। আমাদের সংবিধানে কোটা আছে। তাই, প্রতিবন্ধী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, সত্যিকার অর্থে যারা অনগ্রসর, তাদের জন্য কোটা রাখা যায়। এটা ৫ শতাংশের মধ্যে রাখতে হবে। কোটা সংস্কার করে এর স্থায়ী সমাধান করতে হবে।’

তবে মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন বলেন, ‘আমরা আদালতের রায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ৩০ শতাংশ কোটা ফিরে পেয়েছি। সরকারকে এখন কোটা বহালের প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে। কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপন বাতিল করতে হবে। সরকার যদি আদালতের রায়ের ওপর কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা, করে তাহলে আমরা সারাদেশে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলবো’!

লেখক: আইনজীবী ও সাংবাদিক