নারায়ে তাকবির থেকে সংগীত-নৃত্য: রূপান্তরিত বিএনপিকে অভিনন্দন

  • কবির য়াহমদ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

সিলেট সরকারি আলিয়া মাদরাসা মাঠে বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশের আগের রাতে দলটির সমবেত নেতাকর্মীরা গানে-স্লোগানে-নৃত্যে নিজেদের উজ্জীবিত করেছেন। সাংস্কৃতিক উপাদানে উজ্জীবিত হওয়ার মন্ত্র ভালো লক্ষণ। রাজনৈতিক-সামাজিক আন্দোলনে সাংস্কৃতিক উপাদান না থাকলে উজ্জীবিত হওয়া যায় না, এটা অবচেতনভাবে হলেও বিএনপি নেতাকর্মীরা অনুধাবন করছে। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হওয়া সত্ত্বেও মেকি ধর্মীয় প্রলেপে তারা তাদের স্বাতন্ত্র্য হারাতে বসেছিল এতদিন। সিলেট থেকে লুপ্ত প্রায় সে স্বাতন্ত্র্য পুনরুদ্ধারের পথ চলা শুরু হলে এটা হবে দারুণ কিছু; তাদের জন্যে, দেশের জন্যে।

দেড় দশকের বেশি সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি এবারই প্রথম নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু করেছে। এই আন্দোলনের পথ পরিক্রমায় গত তিন মাস ধরে তারা বিভিন্ন জায়গায় সভা-সমাবেশ করেছে। সরকারও দৃশ্যমানভাবে বাধা দিচ্ছে না। তবে এই সমাবেশগুলোতে সরকারের বাইরের বিভিন্ন শক্তি বিশেষ করে পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে ধর্মঘট ডাকছে। সমাবেশের আগে শুরু হওয়া এইসব ধর্মঘট শেষ হয় কর্মসূচি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই। এজন্যে বিএনপি দায়ী করছে সরকারকে, কিন্তু সরকার বলছে এখানে তাদের হাত নেই। ধর্মঘটকে উপেক্ষা করে দলীয় নেতাকর্মীরা আসছেন, মিছিল-স্লোগান দিচ্ছেন, জানাচ্ছেন তাদের দাবি; বিশেষ করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি।

বিজ্ঞাপন

চেনাজানা প্রক্রিয়ায় এই সমাবেশের বাইরে এবারের সিলেটের কর্মসূচিতে লক্ষ্য করা গেছে ভিন্ন এক ব্যবস্থা। সমাবেশের আগের রাতে বিএনপি নেতাকর্মীরা সংগীত ও নৃত্য করেছেন সমাবেশস্থলে। গান-স্লোগান ও নৃত্যে দলটির নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত হওয়ার এই প্রক্রিয়ায় কিছু লোক সমালোচনা করছেন ঠিক, তবে এটা সমালোচনার কোন অনুষঙ্গ বলে মনে করি না। কারণ এটাই মূলত আমাদের সংস্কৃতি, উজ্জীবিত হওয়ার মন্ত্র। এটাকে জায়েজ-নাজায়েজ বলে আখ্যা দেওয়ার কোন যুক্তি নাই। যারা এটাকে সমালোচনা করতে চাইছেন তাদের দাবি ‘পবিত্র সিলেটের মাটিতে’ এটা মেনে নেওয়ার মতো না। তারা বলছেন, এটা মাদরসার মাঠ, মাঠের পাশেই শাহজালালের মাজার!

বলি, সিলেটের মাটিতে সত্যি কি সংস্কৃতির অন্যতম মাধ্যম গান-নৃত্য করা নিষেধ? কেন নিষেধ? কে নিষেধ করল? প্রত্যুত্তরহীন এই প্রশ্ন নিশ্চিত। তবে এটা নিশ্চিত যে এইধরনের প্রশ্ন তোলে যারা তারা মূলত রাজনীতিতে ধর্মের খোলস পরাতে চায়, রাজনীতির সঙ্গে ধর্মকে জড়াতে চায়। এটা অনুচিত।

এটা ঠিক যে, বিএনপির রাজনীতি করা বেশিরভাগ লোকই যতটা না আচার-আচরণে ধার্মিক, তারচেয়ে বেশি ধর্মের মুখোশ পরা। দলটিকে তারা ‘ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী’ বলে প্রচার করে ভোটের রাজনীতিতে সুবিধা হাসিল করতে চায়। অথচ এই দেশে বেশিরভাগ লোকই ধর্মীয় রাজনীতির প্রতি প্রবল অনীহ। ধর্মভিত্তিক দলগুলোর ভোটের অবস্থা, সাংগঠনিক কার্যক্রম এর বড় প্রমাণ। ভোটের রাজনীতিতে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর অবস্থা এত শোচনীয় যে তাদের অধিকাংশেরই জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। বদলে যাওয়া এই সময়ের ভোটের চিত্র বাদ দিলেও আগেও এমন ছিল, নিকট ভবিষ্যতেও এটা বদলাবে না বলাই যায়।

সাম্প্রতিক সময়ে অনেককে বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারী অনেকের মাঝে অতিরিক্ত ধার্মিক হওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করছি। ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপে এলে সকলেই প্রবল ধার্মিক হয়ে যায়। গত ক’বছর ফেসবুকে-ইউটিউবে ধর্মীয় বক্তারা এত বেশি আলোচনায় এসেছে যে, ধার্মিক নয় সেও সামাজিক মাধ্যমে এসে ধার্মিক সেজে বসে থাকে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমর্থকেরাও একই পথ ধরেছে। ফেসবুক যেন এক উপাসনালয়, এবং বেশিরভাগই সেই উপাসনালয়ের একেকজন ধার্মিক। এদিকে, অনলাইনের বাইরের প্রকৃত উপাসনালয়গুলো কি সেভাবে লোক টানতে পারছে?

এমন অবস্থায় বিএনপির সমাবেশে গানের অনুষ্ঠানের আয়োজন আর সেখানে নৃত্যের সমন্বয় স্রোতের বিপরীতে ইতিবাচক এক আয়োজন। এখানে কথিত ‘পবিত্র মাটি’, পাশে মাজার বলে যারা এটাকে নিয়ে নানা কথার পসরা সাজিয়ে বসছেন এটা তারা ঠিক করছেন না। সংস্কৃতি কি অপবিত্র কিছু, কেন অপবিত্র, কেন নিষিদ্ধসম ভাবছেন? বিএনপির নেতাকর্মীরা মুখে ধর্মের নাম নেন আর সমাবেশে গানের অনুষ্ঠান করেন--এই যুক্তি সামনে এনে যারা বিরোধিতায় মেতেছেন তারাও ঠিক করছেন না। এটাও তো ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির আরেকটা রূপ।

মাদরাসার মাঠে গানের অনুষ্ঠান করা যাবে না এমন কোন বিধিনিষেধ নাই। পাশে মাজার তাতে কী! এই মাঠেও আগেও রাজনৈতিক সমাবেশে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়েছে, সরকারি অনুষ্ঠানেও ছিল/থাকে সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গের যোগ। এগুলো নতুন কিছু নয়। এটাকে নিয়ে বিরোধিতা তাই অনুচিত।

আমরা আমাদের সংস্কৃতি ভুলতে বসেছি। এর বদলে সেখানে জায়গা করে নিচ্ছে ক্রমশ আমদানি করা সংস্কৃতি। ভাষা বদলের চেষ্টা হচ্ছে, পোশাক বদলের চেষ্টা হচ্ছে, আচার বদলের চেষ্টা হচ্ছে। এগুলো যদি আমাদের এগিয়ে যাওয়ার অনুষঙ্গ হতো তবে সেখানে আপত্তি থাকত না। অথচ এগুলো আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার সেকেলে ধারণার হলেও এই সময়ে এর প্রতি ঝোঁক প্রতিটি দলেরই। ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্যের দল আওয়ামী লীগের মাঝেও এই প্রবণতা বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। বিএনপি মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা নিজেদের কথিত ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল বলে দাবি করে। পিছিয়ে থাকা মানসিকতার নেতাকর্মীর একাংশ সংগীত ও নৃত্যকে ধর্মীয় মূল্যবোধের পরিপন্থী বলেও মনে করে। সেই জনগোষ্ঠীর একাংশ যখন সিলেটের সমাবেশের আগে এমন সংগীত ও নৃত্যে মাতে তখন এটাকে আমরা স্বাগত জানাই, তাদের বোধের দরোজা খোলার পথ রচনা হচ্ছে বলে মনে করি।

রাজনৈতিক বিরোধিতার নামে এই সংগীত ও নৃত্য অনুশীলনের বিরোধিতা উচিত নয় বলে মনে করি। আমাদের রয়েছে সুবিশাল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। ভ্রান্তিতে ডুবে কেউ হয়তো ক্ষণিকের জন্যে বিপথে যেতে পারে, কিন্তু কেউ না কেউ ফিরবে, বেশিরভাগই ফিরবে; কোনো না কোনো সময়।

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী চট্টগ্রামে যে বিএনপির মহাসমাবেশে ‘নারায়ে তাকবির’ বলে আওয়াজ তুলেছিল সিলেটে সেই বিএনপির মহাসমাবেশেই সংগীত ও নৃত্যের আয়োজনে যুদ্ধাপরাধী-পুত্রের সেই ভ্রান্ত-পথের আপাত সমাধি হয়েছে। বৃহত্তর সিলেটের বিএনপি নেতাকর্মীরা বুঝে কিংবা না বুঝেই হোক সংগীত ও নৃত্যের মাধ্যমে আমাদের চেনাজানা সংস্কৃতিতে ফিরেছে; তাদেরকে অভিনন্দন!

কবির য়াহমদ: সাংবাদিক, কলাম লেখক