৭২'র সংবিধান ধরেই লড়াই অব্যাহত রেখে ডা. জামিলকে স্মরণ করতে হবে

  • নুর আহমদ বকুল
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

নুর আহমদ বকুল

নুর আহমদ বকুল

এক অনন্য শহীদি মৃত্যু ঘটেছিল স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৮৮ সনের ৩১ মে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে। তৎকালীন ছাত্র শিবিরের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা স্লোগান দিয়ে তরবারি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দিনদুপুরে মেডিকেল ক্যাম্পাসে হত্যালীলা চালিয়ে ছিল। শহীদ কমরেডের নাম ডা. জামিল আকতার রতন। প্রকৃত অর্থে যিনি এদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের শহীদদের রক্তঋণ রক্ষা করতে গিয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বাংলাদেশের সংবিধান- মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষার লড়াইয়ে ‘রাষ্ট্রধর্ম বিল’ নামে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী বিশ্বাসঘাতকতার একটি অবৈধ সাংবিধানিক দলিলকে জীবন দিয়ে রুখে দিতে চেয়েছিলেন। জামিলের মৃত্যুর সময় বাংলাদেশের বয়স ছিল ১৬ বছর। জামিলের বয়স ছিল ২৪ বছরের কাছাকাছি। জামিল একটি নতুন জাতি এবং দেশের প্রসব বেদনা প্রত্যক্ষ করেছিল। বয়স কম থাকলেও স্মৃতিতে তার মুক্তিযুদ্ধ ছিল। ফলে সে ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম। জামিলের বয়সের পরম্পরায় বাংলাদেশের রাজনীতির পরিবর্তনে তার বেড়ে উঠা এমনি সবকিছুই তাকে আলোড়িত করতো। ‘৭৫ এ বঙ্গবন্ধু হত্যার মাধ্যমে এবং আমাদের ‘৭১ এর গণযুদ্ধের বিজয় যখন প্রতিবিল্পবের দ্বারা পরাজিত হলো তখন এক নিদারুণ দুঃসময় এবং দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়ার ধারা উম্মোচিত হতে থাকলো ― গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে।

জামিল আকতার রতনের মৃত্যু এদেশের জন্ম ঘোষণার যে প্রস্তাব ‘প্রস্তাবনা’ মূল সংবিধানের মুখবন্ধে রয়েছে সেটি রক্ষা করার এক প্রয়াস বলেই অনুধাবন করতে হবে। আজকের এই লেখায় স্মৃতি জাগরিত করতে আমি প্রস্তাবনাটির কয়েকটি কিছু অংশ উদ্বৃত করছি।

বিজ্ঞাপন

আমরা বাংলাদেশের জনগণ ১৯৭১ খৃস্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি।

আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদবুদ্ধ করিয়াছিল জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে।

বিজ্ঞাপন

আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।

আমরা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করিতেছি যে, আমরা যাহাতে স্বাধীন সত্তায় সমৃদ্ধি লাভ করিতে পারি এবং মানবজাতির প্রগতিশীল আশা আকাঙ্ক্ষার সহিত সঙ্গতি রক্ষা করিয়া আন্তর্জাতিক শাস্তি ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে পূর্ণ ভূমিকা পালন করিতে পারি, সেইজন্য বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তি স্বরূপ এই সংবিধানের প্রাধান্য অক্ষুন্ন রাখা এবং ইহার রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান আমাদের পবিত্র কর্তব্য। (৪ নভেম্বর ১৯৭২ সংবিধান মুখবন্ধ)

এই প্রস্তাবনাটি যদি আমাদের সংবিধানের মৌলিক ভিত্তি হয় তাহলে প্রশ্নজাগে সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তির জন্ম কি করে হলো, স্বাধীনতা উত্তর মাত্র ৫ বছরের মধ্যে।

সংবিধানের ৩৮ ধারা অনুযায়ী রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। বাংলাদেশ বিরোধী পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্যদের কর্মকাণ্ড রহিত করা হয়েছিল।

১৯৭৩ সনে ১৫ জুলাই তৎকালীন আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর প্রথম সংশোধনী বিল উত্থাপন করেছিলেন সংসদে। যেখানে ১৯৭১ সনে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারীদের এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য পার্লামেন্টে আইন পাশ হয়েছিল।

আমাদের সংবিধান এর এত শক্তিশালী ইতিবাচক দিকগুলো বিশেষভাবে রাষ্ট্রের যে দর্শন তা হারাতে শুরু করি পঞ্চম সংশোধনীর মধ্য দিয়ে। আজকের প্রজন্মকে পরিষ্কার ভাবে ধারণা পেতে হলে ১৭ বারের সংশোধিত সংবিধানের সব থেকে নিকৃষ্ট প্রতিক্রিয়াশীল সংশোধনী ছিলো জেনারেল জিয়া, জেনারেল এরশাদ এই দুই সামরিক শাসকের আমলে সংশোধনকৃত প্রথমটি পঞ্চম সংশোধনী ও দ্বিতীয়টি অষ্টম সংশোধনী বুঝতে হবে। মর্মবস্তুর দিক থেকে পঞ্চম সংশোধনীতে যে পরিবর্তন আনা হয়েছে তা যদি পর্যালোচনা করি তাহলে দেখা যায়।

১৯৭২ এর বঙ্গবন্ধু সরকার প্রণীত মূল সংবিধানের সাথে সেনা শাসক জিয়াউর রহমান যে সব শব্দ, ধারণা ও ইতিহাস পরিবর্তন করলেন তাতে ধর্মভিত্তিক মৌলবাদ ও সংশ্লিষ্ট জঙ্গিবাদ সৃষ্টি ও পুনর্সৃষ্টির পথ প্রশস্ত করলেন। তারমধ্যে অন্যতম বিষয়গুলো হলো নিম্নরূপ-

সংবিধানের প্রস্তাবনার মাথায় ‘বিসমিল্লাহ’ বসালেন।

সংবিধানের প্রস্তাবনার প্রথম অনুচ্ছেদে ‘জাতীয় মুক্তি’ শব্দের জায়গায় বসালেন ‘জাতীয় স্বাধীনতা’ আর ‘ঐতিহাসিক সংগ্রামের’ জায়গা বসালেন ‘ঐতিহাসিক যুদ্ধের’ শব্দ।

সংবিধানের প্রস্তাবনার দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ পরিবর্তে লিখলেন ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’

মূল সংবিধানের ৮(১) ‘ধর্মনিরপেক্ষতাকে’ প্রতিস্থাপিত করা হলো ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ শব্দ সমূহ দিয়ে ৮(২) অনুচ্ছেদে এই ভালো বর্ণিত নীতি সমূহ বাংলাদেশ পরিচালনা মূল সূত্র হইবে এর জায়গায় অন্তর্ভুক্ত করলেন নতুন বাক্য ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসই হইবে যাবতীয় কার্যাবলীর ভিত্তি।

মূল সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০ সেখানে শোষণমুক্ত, ন্যায়ানুগ, সাম্যবাদী সমাজ, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ব্যবস্থার কথা উল্লেখ ছিল তা সম্পূর্ণ বাতিল করলেন।

সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করলেন মূল সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১২, সেখানে বলা ছিল “ধর্ম নিরপেক্ষতার নীতি বাস্তবায়নের জন্য সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, রাষ্ট্রকর্তৃক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার, কোন বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ন বিলোপ করা হইবে।

বাঙালি জাতীয়তাবাদ বদলে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ বসালেন। সংবিধানের এই পরিবর্তনগুলো স্পষ্টতরই প্রমাণ করে জেনারেল জিয়া মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মদতে ‘৭১ এর পরাজিত শক্তি পাকিস্তানি মতাদর্শ ও তাদের মিত্রদের ঐক্যবদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করার পথকে প্রশস্ত করেন।সংবিধানে মূল বৈশিষ্ট্য তথা রাষ্ট্রদর্শনকেই উল্টিয়ে দিলেন।একটি নব উত্থিত রাষ্ট্রের, নতুন দিগন্তের যে রেঁনেসা সৃষ্টি হয়েছিল, তাকে শেষ করে দিলেন; গণহত্যার চেয়েও ভয়াবহ কাণ্ড ঘটালেন-একটি জাতি হত্যার মধ্য দিয়ে।

সাম্রাজ্যবাদী অপর ক্রীড়নক জেনারেল এরশাদ ১৯৮৮ সনে ৭ জুন অষ্টম সংশোধনী এনে ‘রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করলেন’ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সরাসরি এক সাংঘর্ষিক অবস্থার সৃষ্টি করলেন। ধর্মের ভিত্তিতে দেশে অন্যান্য ধর্মের নাগরিকদের অবনমন করলেন। জেনারেল জিয়ার অসমাপ্ত কাজকে সমাপ্ত করলেন।

জিয়া এবং এরশাদ দুই জেনারেলই বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নস্যাৎ করে সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধ শক্তিদের রাজনীতিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করলেন। খন্দকার মোশতাক থেকে এরশাদ এই সময়কালটির রাজনীতি―বাংলাদেশের রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে, সংস্কৃতিতে পরিপূর্ণ ভাবেই তীব্র মৌলবাদী ধর্মান্ধ ধ্যান ধারণা, অর্থবিত্ত ব্যবসা, এক নতুন রূপ নেয়। রাজাকার শাহ আজিজ, সবুর খান, মৌলানা মান্নানদের জিয়া যেমন প্রতিষ্ঠা দিলেন তেমনি এরশাদ থেকে পরবর্তীতে খালেদা জিয়ার সরকারে সরাসরি ‘৭১ এর খুনি নিজামী, মোজাহিদ মন্ত্রী হয়ে বসলেন। ক্ষমতার প্রশ্নে আওয়ামী লীগও কম আপোষ করেনি ঐ অপশক্তির সঙ্গে। এবং সে ধারা এখনও চলমান। যদিও ষোড়শ সংশোধনীর মধ্যদিয়ে ৪ মূলনীতি সংবিধানে প্রতিস্থাপন হয়েছে তথাপি রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম আর সরবে বলে মনে হয় না। এবং আওয়ামী লীগের পক্ষে তা সম্ভব নয়। ইতিমধ্যে বাংলাদেশে মৌলবাদী গোষ্ঠীর হাতে অফুরন্ত পুঁজি জমা হয়েছে; বড় বড় মাদরাসার প্রিন্সিপাল হেফাজত নেতা এখন কোটি কোটি টাকার মালিক, পীরদের দলগুলো ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছে; পীরদের অগাধ সম্পত্তি, টাকা তারা রাজনীতি, ব্যবসায় বিনিয়োগ করছে। মৌলবাদি অর্থনীতি-লুটেরা অর্থনীতি সংমিশ্রণে ধর্মীয় মৌলবাদী সাংস্কৃতিক ধারা বাংলাদেশের সমাজে ও রাষ্ট্রে তীব্র প্রভাব ফেলেছে।

অন্যদিকে অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তি ক্রমান্বয়ে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়ছে এবং তাদের বিভক্তি আরও নিদারুণ অবস্থা তৈরি করেছে। সুনির্দিষ্টভাবেই বাংলাদেশের অস্তিত্ব এবং মুক্তিযুদ্ধের অর্জন রক্ষা করতে হলে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারা, ধর্মনিরপেক্ষতার ধারা সর্বোপরি জনগণের কল্যাণময় একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। শহীদ জামিলের ‘৩৪ তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাকে স্মরণ করতে হলে আমাদের ‘৭২ এর সংবিধানের ধারায় অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যবদ্ধ লড়াই অব্যাহত রাখতে হবে। শহীদ জামিল দিবস অমর হোক।

লেখক: নুর আহমদ বকুল, পলিটব্যুরো সদস্য, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পাটি।