‘রাতের ভোট’: আত্মসমালোচনা ইসির

  • কবির য়াহমদ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে নানা আলোচনা আছে। ওই ভোট দিনের বেলার পাশাপাশি রাতেও হয়েছে বলে সরকারবিরোধী অংশের জোর প্রচার। বর্তমান সরকারকে ‘রাতের ভোটের অবৈধ সরকার’ বলে অভিযুক্ত করে আসছে বিএনপি ও এর সমমনা দলগুলো। আওয়ামী লীগ বরাবরের মতো সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। জনগণ তাদের সর্বাত্মক সমর্থন দিয়ে ফের ক্ষমতায় এনেছে এমনই দাবি তাদের। আওয়ামী লীগের দাবি বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে দেশবাসী প্রত্যাখ্যান করে তাদেরকে বিপুল বিজয় উপহার দিয়েছে।

ভোট নিয়ে নানা অভিযোগ মাথায় নিয়েই বিদায় নিয়েছে সাবেক ইসি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) নুরুল হুদা বারবার রাতের বেলায় ভোটের অভিযোগ অস্বীকার করলেও আবার আকারে ইঙ্গিতে সেটা কবুলও করেছেন একাধিকবার। তবে এনিয়ে তার মধ্যে অনুশোচনা লক্ষ্য করা যায়নি, বরং নিজেকে সফল দাবিও করে গেছেন শেষ পর্যন্ত। যদিও তার নেতৃত্বাধীন কমিশনের অন্য কমিশনার মাহবুব তালুকদার তার অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন একাধিকবার এবং সিইসির সঙ্গে তার বিরোধ ছিল প্রকাশ্য। সিইসির সঙ্গে প্রকাশ্য বিরোধের কারণে হোক আবার অনুশোচনার কারণেই হোক ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে তিনি তার খেদের কথা বারবার বলেছেন। নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠানটির ব্যর্থতার কথা বললেও ব্যর্থতা স্বীকার করে পদত্যাগ করার সাহস দেখাতে পারেননি। তিনিও অন্যদের মতো সাংবিধানিক সকল সুযোগসুবিধা গ্রহণ করে মেয়াদ পূরণ করেই বিদায় নিয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

আগের নির্বাচন কমিশন (ইসি) ‘রাতের ভোট’ নিয়ে নানা কথা বলেছে, বর্তমান ইসিও। মঙ্গলবার (২৪ মে) রাজধানীর নির্বাচন ভবনে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, নির্বাচনকে প্রহসনে রূপান্তর করার কোনো ইচ্ছে আমাদের নেই। এটা আমরা অন্তর থেকে বলছি। সুন্দর নির্বাচন, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে সুস্থ ধারা অব্যাহত থাকুক। ভোট নিয়মানুযায়ী হবে, দিনের ভোট দিনেই হবে। ভোট রাতে হবে না—এটা স্পষ্ট করে বলতে চাই। সিইসির এই বক্তব্য চলমান নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে মানুষের নানা আলোচনার বিপরীতে আস্থা ফেরানোর প্রচেষ্টা হিসেবে দেখতে চাই।

আগের ভোট রাতে হয়েছে কি-না এনিয়ে প্রমাণ উপস্থাপিত হয়নি, কোন আদালতও এটা বলেনি। বিএনপি ও এর সমমনা দলগুলোসহ দেশের অনেকের ধারণা এমনই। এই ধারণার বাইরে যেতে পারেনি সাবেক ও বর্তমান নির্বাচন কমিশন। ভোট রাতে কি দিনে হয়েছে এটা এখন পর্যন্ত অমীমাংসিত বিষয়, এনিয়ে নির্বাচন কমিশন যখন কথা বলে তখন মানুষের মধ্যে প্রশ্ন জাগে। তবে সন্দেহ ও অনাস্থা থেকে আস্থা ফেরানোর যে পদক্ষেপ সেটা বর্তমান নির্বাচন কমিশন নিচ্ছে বলে ধারণা করা যায় ইঙ্গিতবহ স্বীকারোক্তি কিংবা আত্মসমালোচনা থেকে। এটাকে আমরা ইতিবাচকভাবে দেখতে বরং আগ্রহী।

বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যর্থতা একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে তাদের অভিযোগকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারেনি। গত নির্বাচনে বিপুল পরাজয়ের পর তারা সেই নির্বাচন নিয়ে কোন কাজ করেছে বলে দৃশ্যমান হয়নি। নির্বাচনের ফলাফলের বিপর্যয় কী কারণে ঘটল তা নিয়ে কিছু মেঠো-বক্তৃতা দেওয়া ছাড়া আর কোন কাজ করেনি তারা। নির্বাচনের পর আসনভিত্তিক ফলাফল নিয়ে আগের নির্বাচনগুলোর সঙ্গে সবশেষ নির্বাচনের ভোটের সংখ্যা নিয়ে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে সেগুলো দেশবাসীর সামনে উপস্থাপন করলে ওখান থেকে তারা অনেক কিছু পেতে পারত। এর মাধ্যমে তারা নির্বাচনকে বাতিল ঘোষণা করাতে পারত না ঠিক তবে মানুষের কাছাকাছি যেতে পারত। লড়াইটা হতে পারত বুদ্ধিবৃত্তিক, কিন্তু মাঠের রাজনীতিতে শক্তিহীন বিএনপি যে বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রেও শক্তিহীন একটা দল সেটাই প্রমাণ করেছে তারা।

বিএনপির এই ব্যর্থতা রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক। এর সুযোগ নিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তারপরেও ‘রাতের ভোট’ নিয়ে আলোচনা আছে। সরকার দল আওয়ামী লীগ যতই এটা অস্বীকার করুক না কেন মানুষের মনে বিভ্রান্তি আছে, নানা মত আছে ইসিতেও। নির্বাচন কমিশন এনিয়ে কথা বলার মধ্যে আত্মসমালোচনার যে পথ দেখাচ্ছে এটাকে আমরা ইতিবাচকভাবে দেখতে চাই। আগের ‘ভুল’ শুধরে নিয়মানুযায়ী ভোটগ্রহণের যে প্রত্যয় বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মধ্যে দেখা যাচ্ছে এটা দেখে আশাবাদী হতে পারে দেশের মানুষ, আশাবাদী হতে পারে রাজনৈতিক দলগুলো; নির্বাচন হতে পারে অংশগ্রহণমূলক। বিতর্ককে পাশ কাটিয়ে অস্বীকার তত্ত্ব এই নির্বাচন কমিশনের মধ্যে এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না বলেই মনে হচ্ছে আমাদের।

দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে কি-না এনিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব আছে, কারণ বর্তমান সরকারের অধীনে কোন নির্বাচনে যাবে না বলে ঘোষণা আছে বিএনপির। আবার বিলুপ্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনবে না আওয়ামী লীগ সরকার। আন্দোলনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক কিংবা জাতীয় সরকারের দাবি আদায়ের মাঠের শক্তিও নেই বিএনপি ও এর সমমনা দলগুলোর। ফলে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের চ্যালেঞ্জ আছে নির্বাচন কমিশনের। তারা পারবে কি-না এটা সময়ই বলে দেবে। তবে এখন পর্যন্ত তাদের যে অবস্থান তাতে অন্তত আশাবাদী হওয়ার চেষ্টা করতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে।

নিয়মানুযায়ী দিনের ভোট, অনিয়মের রাতের ভোট—এ আলোচনা চলতেই থাকবে। তবু মানুষকে আস্থা রাখতে হবে নির্বাচন কমিশনের ওপর। বর্তমান নির্বাচন কমিশন কতটুকু কী করতে পারবে এনিয়ে এখনই সিদ্ধান্তে পৌঁছার সময় হয়নি দেশবাসীর। তারা মানুষের আস্থা ফেরাতে কাজ করছে, আপাতত এটাই স্বস্তির। কাজের আগে কাজ নিয়ে সিদ্ধান্ত নয়, তাদেরকে সমর্থনের পাশাপাশি দিতে হবে প্রয়োজনীয় সময়। দেশবাসীর সমর্থন পেলে তারা তাদের সাংবিধানিক ক্ষমতার ব্যবহার করতে পারবে বলে বিশ্বাস রাখতে চাই।

কবির য়াহমদ: সাংবাদিক, কলাম লেখক।