সর্বোচ্চ পুরস্কার, সর্বোচ্চ বিতর্ক

  • কবির য়াহমদ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার স্বাধীনতা পুরস্কার নিয়ে বিতর্ক লেগেই আছে। প্রকৃত যোগ্যরা যেমন এ পুরস্কার পেয়েছেন, পাচ্ছেন তেমনি এই পুরস্কারের সঙ্গে আছে প্রকৃত অযোগ্য ও বিতর্কিতদের যোগ। ১৯৭৭ সালে প্রবর্তিত এই পুরস্কারের প্রথম বছরেই যেমন ‘জাতির পিতা হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রকারী’ মাহবুবুল আলম চাষীর নাম যোগ আছে, তেমনি ওই বছরেই আছে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের নাম। এছাড়া আরও অনেক নাম আছে যারা যোগ্য।

একইভাবে স্বাধীনতা পুরস্কারের নামে স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরোধিতাকারী শর্ষিনার পির নামে পরিচিত মওলানা আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহের নাম। এই পুরস্কারের সঙ্গে নাম আছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম, আবার একই বছরের (২০০৩) আছে মেজর জিয়াউর রহমানের নামও। যদিও জিয়ার নাম পরে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রত্যাহার করা হয়। জিয়ার নাম প্রত্যাহার হলেও বিতর্কিত শর্ষিনার পির-চাষীসহ আর অনেকের নাম প্রত্যাহার করা হয়নি।

বিজ্ঞাপন

রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক স্বাধীনতা পুরস্কার ও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক একুশে পদক প্রদান অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী। এরবাইরে ২০১৯ সালের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী আরও আছে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরষ্কার, বেগম রোকেয়া পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার ও জাতীয় ক্রীড়া পুরষ্কার। এ ছয়টিই রাষ্ট্রীয় আয়োজনে প্রদানকৃত রাষ্ট্রীয় পুরস্কার।

স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ; বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি; চিকিৎসাবিদ্যা; শিক্ষা; সাহিত্য; সংস্কৃতি; ক্রীড়া; পল্লি উন্নয়ন; সমাজসেবা/জনসেবা; জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ; জনপ্রশাসন; গবেষণা ও প্রশিক্ষণ এবং সরকার কর্তৃক নির্ধারিত অন্য যেকোনো ক্ষেত্রে গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সরকার স্বাধীনতা পুরস্কার দিয়ে থাকে। নাম মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকে সরকারের সকল মন্ত্রণালয়/ বিভাগ, জেলা প্রশাসক, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে অধিদপ্তর/দপ্তর/সংস্থা এবং ইতোপূর্বের স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ।

বিজ্ঞাপন

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাধ্যমে পাওয়া এসব নামের প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করে ‘প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটি’। যাচাই-বাছাইয়ের পর প্রস্তাব জাতীয় পুরস্কার সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর বিবেচনা ও সিদ্ধান্তের জন্য উপস্থাপন করা হয়। মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ ১০ সচিব এই কমিটির ‘সহায়তাদানকারী কর্মকর্তা’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

এই নাম প্রস্তাব থেকে শুরু করে বাছাই প্রক্রিয়ায় যারা থাকেন তাদের কেউই পুরস্কারের জন্যে নির্ধারিত বিভিন্ন ক্ষেত্রের যোগ্য, প্রাজ্ঞ ও উপর্যুক্ত ব্যক্তিত্ব নাও থাকতে পারেন, তবে তারাই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ এই বেসামরিক পুরস্কার প্রদানের জন্যে রাষ্ট্র কর্তৃক নির্ধারিত দায়িত্বশীল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কারের জন্যে এটা কি ‘সর্বোচ্চ পর্যায়ের অবহেলা’ নয়?

আমলারা সুপারিশ করবেন, আমলারা বাছাইপর্ব সম্পন্ন করবেন, আমলারা মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-উপমন্ত্রীর সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় পুরস্কার সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে ‘সহায়তাদানকারী কর্মকর্তা’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন; এটা ভারসাম্যপূর্ণ কোন প্রক্রিয়া নয়। এখানে কি সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে পারে না সরকার? এজন্যে পৃথক বিশেষজ্ঞবোর্ড গঠন করে তাদের মতামত নিয়ে পরবর্তীতে সরকার নির্ধারিত প্রক্রিয়ায় ত এগোনো সম্ভব।

স্বাধীনতা পুরস্কারই কেবল নয়, প্রতিবছর একুশে পদকসহ জাতীয় পর্যায়ের দেওয়া বিভিন্ন পদক নিয়ে বিতর্ক উঠে। বিতর্ক কেবলই যে বিতর্কের খাতিরে হয় এমন না। যৌক্তিক বিরোধিতার মুখে দুইবছর আগে সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কার ঘোষিত এস এম রইজ উদ্দিন আহম্মদের পুরস্কার বাতিলের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে সরকারকে। এর এক বছর বিরতি দিয়ে এবারের স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া হয়েছে মো. আমির হামজা নামের এক ‘চারণ কবি’-কে। অভিযোগ উঠেছে উপসচিব পদমর্যাদার পুত্রের চেষ্টায় তার নামে জুটেছে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক এই পদক।

মো. আমির হামজা জীবিত নন। নাম ছাড়া এই পুরস্কারের সঙ্গে তার কোন প্রত্যক্ষ সংযোগ নেই। এমনটা থাকে না কারও। ব্যতিক্রম কেবল কবি নির্মলেন্দু গুণ যিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহপাঠী পরিচয়ে এই পুরস্কারের জন্যে প্রকাশ্যে নিজের চাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন। যদিও নির্মলেন্দু গুণ তার কীর্তির কারণেই আগে থেকেই পুরস্কারের যোগ্য ছিলেন, তবু তাকে চেয়ে সেটা পেতে হয়েছে।

নির্মলেন্দু গুণ পুরস্কার চেয়ে পেয়েছেন, কারণ তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার পরিচয়কে সামনে এনেছিলেন। এখানে যদিও তার কবি-প্রতিভার যথাযথ সম্মান প্রদর্শন হয়নি তবু তিনি পেয়েছেন—এটাও কম নয়। এরবাইরে যারা পান তারা আমলাদের সুপারিশে, আমলাদের বাছাইয়ে মন্ত্রীসভা কমিটির বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনে পেয়ে থাকেন। এখানে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের যোগ সামান্যই, আছে কেবলই আমলা-প্রাধান্য। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক এই পুরস্কারের সঙ্গে এভাবে আমলাদের এত-এত যোগ, এত-এত প্রভাবে প্রকৃত যোগ্যদের মূল্যায়ন কতখানি সম্ভব?

স্বাধীনতা পুরস্কার কেবল সাহিত্য ক্ষেত্রেই দেওয়া হয় না, তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সব আলোচনা কেবলই সাহিত্যকেন্দ্রিক। এস এম রইজ উদ্দিন আহম্মেদ থেকে শুরু করে মো. আমির হামজা—সাহিত্যঘনিষ্ঠজনদের বিরোধিতা এসেছে প্রকাশ্যে। শুরুর প্রতিবাদ যতটা না সাহিত্যকেন্দ্রিক ছিল তারচেয়ে ছিল—‘আমি চিনি না, নাম শুনিনি আগে’ এমন! যেন করপোরেট কবি-সাহিত্যিক ও মিডিয়ায় চেহারা দেখানো কবি-সাহিত্যিক ছাড়া রাষ্ট্রীয় পুরস্কার কেউ পেতে পারে না!

শুরুর প্রতিক্রিয়ায় মনে হচ্ছিল—এই সময়ে টেলিভিশনে চেহারা প্রদর্শনই তবে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার প্রাপ্তির একমাত্র যোগ্যতা! শিল্প-সাহিত্যের সবজান্তা ভাব থাকে যখন কেউ বলে উঠে ‘তাকে আমি চিনি না, তার নাম শুনিনি আগে, কীভাবে পেল পুরস্কার’। বলে রাখি, এইধরনের প্রতিক্রিয়া শোভন নয়। এই প্রতিক্রিয়া এভাবে না হয়ে অন্যভাবেও হতে পারত।

‘চারণ কবি’ মো. আমির হামজা তাৎক্ষণিক গান লিখতে ও সুর করতে পারতেন বলে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন; এমনও শুনছি আমরা। বঙ্গবন্ধুর নাম যখন প্রকাশ্যে মুখে না যেত না বিরুদ্ধ-সময়ে তখন তিনি সরকারি অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর নামে গান করেওছিলেন—এমনই বলছেন অনেকেই। আবার একইসঙ্গে অনেকে এও বলছেন জিয়াউর রহমানের সময়ে, এরশাদের সময়ে ওই দুই সামরিক সরকারের স্তুতিমূলক গানও তিনি করেছেন।

এসব শোনা কথা, সত্যাসত্য নির্ধারণ অনেকটাই অসম্ভব! এখন জানা যাচ্ছে, প্রয়াত মো. আমির হামজা একটা খুনের মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। খুনের মামলার দণ্ড পাওয়া কেউ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পুরস্কার পাওয়ার বিষয়টি নৈতিকতার মানদণ্ডে টেকে না। এরবাইরে এই পুরস্কারের জন্যে নামপ্রস্তাব থেকে শুরু করে বাছাই হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্র যে ‘সর্বোচ্চ পর্যায়ের অবহেলা’ করেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অবহেলা না হলে স্রেফ কোন উপসচিবের প্রস্তাব ও সচিবের সুপারিশে অচেনা এবং স্বীয় ক্ষেত্রে অনুল্লেখ্য কেউ এভাবে এত বড় পুরস্কার পেয়ে যায়!

মো. আমির হামজা প্রয়াত। তাকে নিয়ে কটূক্তি শোভন নয়। তবে তার পুত্র স্রেফ নিজের উদ্দেশ্য হাসিলে যা কিছু করেছেন সেটা উচিত হয়নি। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার নীতিমালার দুর্বল দিকটিকে তিনি নিজের স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার করেছেন। শুরুতে তিনি সফল হলেও দিনশেষে স্বরূপ যেমন উন্মোচিত হয়েছে তার, তেমনি এর মাধ্যমে তার প্রয়াত পিতাকেও অপমান করেছেন। মো. আসাদুজ্জামান নামের ওই উপ-সচিবের কাছে তার পিতা পরমপূজ্য হলেও তার যতটুকু অর্জন তা রাষ্ট্রীয় অসামান্য ও গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার জন্যে যথেষ্ট ছিল না।

এস এম রইজ উদ্দিন আহম্মেদ থেকে মো. আমির হামজা—এই বিতর্কের সমাধানকে স্রেফ একটা সরকারি সিদ্ধান্তের কাছে সমর্পণ করা উচিত হবে না। সরকারের উচিত হবে রাষ্ট্রীয় পুরস্কারের চলমান প্রক্রিয়া নিয়ে ভাবার। আমলানির্ভরতায় যোগ্যদের মূল্যায়ন কঠিন—এটা বারবার প্রমাণিত। এই আমলানির্ভরতা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কারকে সর্বোচ্চ বিতর্কের পর্যায়ে নামিয়ে দিচ্ছে। প্রমাণ ত হাতের কাছেই!

লেখক: কবির য়াহমদ, সাংবাদিক, কলামলেখক
ইমেইল: [email protected]