ভিসি উদ্ধারে শিক্ষার্থীর রক্ত ঝরানো অমানবিক
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মামুলি ঘটনার জেরে তুলকালাম কাণ্ড জাতির বিবেককে নাড়িয়ে তুলেছে। অভিযাগ এসেছিল ছাত্রীদের পক্ষ থেকে। তারা তাদের হলের প্রভোস্টের বিরুদ্ধে নানা কারণে পদত্যাগ দাবি করেছিলেন ভিসির কাছে। এরকম অভিযোগ ও সমস্যা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে হরদম হয়ে থাকে। এর চেয়েও বড় সমস্যার প্রেক্ষিতে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধান করার বহু নজির রয়েছে। ভালভাবে যুক্তি দিয়ে শিক্ষার্থীদেরকে বুঝানো হলে তারা সব সময় শিক্ষকদের কথা মান্য করে। কারণ, শিক্ষার্থীরা তাদের বাবা-মায়ের পর শিক্ষকদেরকে পিতৃ-মাতৃতুল্য শ্রদ্ধার আসনে বসিয়ে থাকে।
শিক্ষার্থীরাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাণ। তারা অনেক সময় ভুল করলেও নিজের ভুল বুঝতে পেরে নিজেরাই অনেক সমস্যার সমাধান করতে এগিয়ে আসে। কিন্তু শাবিপ্রবি-র ঘটনা সামান্য আন্দোলন থেকে কেন এতবড় সমস্যা হয়ে মামলা মোকদ্দমার দিকে গড়িয়ে ভিসি পতনের আন্দোলনের দিকে গেল তা এক কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি করে তুলেছে জাতিকে।
দেশের স্বনামধন্য ও সুনামধারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি নিজস্ব গৌরব রয়েছে। যেখানে এই লেখকও বহুদিন শিক্ষকতা করেছিলেন। তখনকার ছাত্র-শিক্ষক মধুর সম্পর্কের জন্য আজকের এই ন্যাক্কারজনক ঘটনা সেই মধুর স্মৃতিকে যেন বার বার দুমড়ে মুচড়ে তুলছে। শিক্ষার্থীরা মনে হচ্ছে তাদের কর্তৃপক্ষের ওপর চরমভাবে নাখোশ। তারা ভিসির বাসভবনের সামনে জটলা করছে, স্লোগান দিচ্ছে, হাততালি দিয়ে নিজেদের দাবিগুলো জোর গলায় পেশ করছে। শিক্ষার্থীরা এ ধরনের দাবি দাওয়া মাঝে মধ্যে বড় -ছোট সব বিশ্ববিদ্যালয়েই করে থাকে। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পর একটা গ্রহণযোগ্য সমাধান পেয়ে যায় ও তাদের কণ্ঠস্বরও ঠান্ডা হয়ে পরিস্থিতি স্বাভবিক হয়ে উঠে। এটাই অলিখিত নিয়ম।
ঘটনার প্রথমদিন আমরা টিভি ও বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আন্দেলানের ভাষা ও গতি দেখে এটাই ভেবেছিলাম যে পরদিন সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে। কিন্তু না। পরের দিনের ঘটনাবলী দেখে মনে হলো শাবিপ্রবি-র পবিত্র অঙ্গন যেন একটি মিনি যুদ্ধক্ষেত্র। প্রথমে একদল মানুষ কর্তৃক ঠেলাঠেলি, ধাক্কাধাক্কির পর লাঠির খটাখট বাড়ি পড়ার পর বৃষ্টির মত ইট-পাটকেলের নিক্ষেপ। এরপর শক্ত পেশাদারী লাঠির দমাদম পিটুনি, বন্দুকের রাবার গুলি, সাউন্ড গ্রেনেডের মুহুর্মুহু বিকট শব্দ, দৌড়াদৌড়ি, কান্নাকাটি ইত্যাদির দৃশ্য টিভিতে দেখে মনে হলো পরিস্থিতি আসলে ভয়ানক মোড় নিয়েছে। ফিলিস্তিনে যেমন বাচ্চাদের ইট-পাটকেলের বিরুদ্ধে ইসরাইলি সেনারা কামানের গোলা ছুঁড়ে চারদিকে ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন করে ক্যামেরার গ্লাস ঘোলা করে দেয় ঠিক তেমনি একটি দৃশ্যপট। মোটেও বেশি বললাম না। যারা খবর দেখেছেন তারা আমার কথা কিছুতেই অবিশ্বাস করতে পারবেন না।
দৈনিক পত্রিকায় দেখলাম শিক্ষার্থীদেরকে ভবনের দরজা থেকে তাড়ানোর জন্য লাঠিপেটা করার পাশাপাশি ২১টি গুলি ও ২৩টি সাউন্ড গ্রেনেড ছোঁড়া হয়েছে সেদিন। উদ্দেশ্য ভিসিকে ‘উদ্ধার’ করতে হবে। এই শব্দটিই ব্যবহার করা হয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদে। কই, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে তখনকার ভিসি শিক্ষার্থীদের দ্বারা সারাদিন তালাবদ্ধ থেকে পুলিশ ডেকে শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি-গ্রেনেড ছুঁড়তে বলেননি। একজন ভিসিকে অনেক সময় ধৈর্য্যের পরীক্ষা দিতে হয়। তিনি কেন অধৈর্য্য হবেন? শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের কাছে আদরের নিজ সন্তানতুল্য। একথা যদি মনে ধারণ না করতে পারেন তাহলে তিনি ওই পদে দায়িত্ব নিতে যাবেন কেন? আজকাল অনেক ভিসি যথার্থ জ্ঞান ও যুক্তি দিয়ে মেধাবী বা বুদ্ধিমান ছাত্রদের সাথে কথাও বলতে অপারগ। সেটাই আজকাল অনেক ভিসির চরম দুর্বলতা।
আজকাল সবাই সব জায়গায় প্রশাসক হতে চান। একজন ভালো গবেষক হতে সবার দ্বিধা। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ শুধু শিক্ষক নন। তাঁরা একাধারে শিক্ষক ও বিশিষ্ট গবেষক। এটাই এই চাকরির বিশেষত্ব বা সবিশেষ নিয়ম। কিন্তু আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক গবেষক হতে চান না। তারা নিজেদেরকে প্রশাসক ভাবতে ভালবাসেন-অথচ সেকাজে অনেকে অযোগ্য বা অনেকেরই কোন প্রশিক্ষণ ও নৈতিক গুণাবলী থাকে না। আজকাল বেশিরভাগ শিক্ষক কোন না কোন রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থাকেন। অনেকের রাজনৈতিক নেতাদের সাথে থাকে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। আবার অনেক শিক্ষক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকেন। একটি ক্লাস নিয়েই ব্যবসার তাগিদে দেন দৌড়। এদের অনেকেই নিয়ম অমান্য করে একটি প্রশাসনিক পদের জন্য সরকারি নানা দফতরে দৌড়াদৌড়ি করে নিজের মর্যাদাকে হেয় প্রতিপন্ন করে ভিসি নামক সোনার হরিণ লাভে তৎপর হন। কেউ কেউ এক মেয়াদ শেষ হলে আরও এক-দুই মেয়াদ বেশি থাকার জন্য তদবির শুরু করেন। দেখা গেছে, যারা দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার ভিসিপদ লাভ করেছেন তারা বেশি দুর্নীতি করতে তৎপর ছিলেন। তারা অনেকে বেপরোয়া ভাব দেখিয়ে চলাফেরা ও বিভিন্ন একপেশে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বিভিন্ন অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতি করেছেন। এজন্য অনেকের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। অনেককে মেয়াদপূর্তির আগেই পদত্যাগ করতে হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, শাবিপ্রবি-তে যা ঘটেছে তার নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদের নেই। পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে উপাচার্য যে ব্যর্থ হয়েছেন, তা-ই নয় বরং শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার নির্দেশ দিয়ে ফৌজদারি অপরাধ করেছেন তিনি। (প্রথম আলো ১৯.০১.২০২২)।
শাবিপ্রবি-র দুঃখজনক ঘটনার প্রতিবাদে ঢাবি, রাবি, জাহাঙ্গীরনগর, খুলনা ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদ মিছিল ও পথসভা হয়েছে। ঢাবি ও রাবি-তে হয়েছে মশাল মিছিল। কুবিতে মানববন্ধন হয়েছে। এই ঘটনার প্রতিবাদে বাসা বাড়িতে থাকা ও মেসের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে এসে জমায়েত হয়ে আন্দেলানে যোগ দিয়েছে। অনেকেই ব্যঙ্গচিত্র এঁকেছে ও কুশপুত্তলিকায় আগুন দিয়েছে। তারা এখন একটি দাবি তুলছে। তারা উপাচার্যের পদত্যাগ চায়। এজন্য গতকালই ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছে । অন্যদিকে শাবিপ্রবি-র ঘটনায় ‘২০০-৩০০ জন অজ্ঞাতনামা লোককে আসামি করে’ জালালাবাদ থানায় মামলা করা হয়েছে এবং রাষ্ট্রপতির উদ্দেশ্যে শিক্ষার্থীদের খোলা চিঠি পাঠানো হয়েছে। উপাচার্যের অপসারণের দাবিত শিক্ষার্থীরা আমরণ অনশনের ঘোষণা দিয়েছে (দৈনিক ইত্তেফাক ১৮.০১.২০২২)। এছাড়া বিষয়টির সুরাহা নিয়ে বিভিন্ন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের হস্তক্ষেপ চলছে।
গত মঙ্গলবার (১৮ জানুয়ারি) রাত সাড়ে ১০টায় শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের পদত্যাগের জন্য বুধবার (১৯ জানুয়ারি) দুপুর ১২টা পর্যন্ত সময় বেঁধে দেন। অন্যথায় আমরণ অনশনের ঘোষণা দেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী (২০ জানুয়ারি) বলেন, অনশনকারীদের কয়েকজন অসুস্থ পড়েছেন। তারপরও উপাচার্য গদি ছাড়ছেন না। এই ২৪ জনের কিছু হলে আরও ২৪ জন আসবে। এরপর আরও ২৪ জন। দেখি তিনি পদত্যাগ না করে কিভাবে থাকেন।
বুধবার সকাল থেকে শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে তার পদত্যাগের অপেক্ষায় ছিলেন। তবে উপাচার্য পদত্যাগ না করায় শিক্ষার্থীরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে আমরণ অনশন শুরুর সিদ্ধান্ত নেন। অনশনকারী একজন বলেন, উপাচার্য পদত্যাগ না করা পর্যন্ত আমরা অনশন চালিয়ে যাবো। এতে যদি আমাদের মৃত্যু হয় তাহলে দায়ভার উপাচার্যের ওপরই বর্তাবে।
এদিকে, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রায় আড়াইশ শিক্ষকের সঙ্গে জুম মিটিং করেন উপাচার্য। মিটিং শেষে রাত ৮টার দিকে শতাধিক শিক্ষক আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের কাছে গিয়ে তাদের আন্দোলন স্থগিত করার অনুরোধ করেন। তবে আন্দোলন স্থগিতে রাজি হননি শিক্ষার্থীরা। (জাগো নিউজ ২০.০১.২০২২)।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি) উদ্ভূত পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন। ফেডারেশন বলছে, কয়েকদিন ধরে শাবিতে শিক্ষার্থীরা কিছু ন্যায্য দাবি—দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করছেন। তাদের আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সর্বোচ্চ এ ফোরামের নেতাদের জোর দাবি, শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক সব দাবি—দাওয়া মেনে নিয়ে দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনা হোক। (জাগো নিউজ ২১.০১.২০২২)।
তবে যাই হোক না কেন, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন প্রভোস্টের পদত্যাগের দাবিতে ছাত্রীদের আন্দোলন ভিসি পতনের আন্দেলনের মত এতদূর গড়াবে তা কারো কাম্য ছিল না। এখন সামনে আরও কী জটিলতা তৈরি হতে যাচ্ছে তা এই মুহূর্তে বলা মুশকিল। করোনার জমজ ভ্যারিয়্যান্ট ডেলমিক্রনের ঊর্ধ্বগতির এই কালো সময়ে সামনে কী ঘটবে তার জন্য কেউ গভীরে চিন্তা করছেন না। করোনাভীতি ছাড়াও একটি মামুলি ঘটনার জেরে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন নষ্ট হোক এটাও কারো কাম্য হতে পারে না।
শিক্ষক হতে হবে শিক্ষাবান্ধব, গবেষণাবান্ধব ও শিক্ষার্থীবান্ধব। শিক্ষক-শিক্ষার্থী কেউই হঠাৎ বিগড়ে গেলে চলবে না। পারস্পরিক ভালবাসা ও শ্রদ্ধাবোধের যথার্থ প্রকাশের মাধ্যমে শাবিপ্রবি-র মতো একটি পবিত্র শিক্ষাঙ্গন হয়ে উঠুক জ্ঞানার্জনের পবিত্র বাগান-এই প্রত্যাশা শাবিপ্রবি-র একজন সাবেক শিক্ষক হিসেবে আমার। আর শিক্ষার্থীদের একটি সুন্দর ভবিষ্যতের স্বার্থে একই চাওয়া সবার হওয়া উচিত।