প্যাগাসাস ভাইরাস করোনাকালে আরেক মানসিক যন্ত্রণা

  • ড. মতিউর রহমান
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের আবিষ্কার বিশ্বকে ব্যাপক পাল্টে দিয়েছে। বলা হচ্ছে কম্পিউটার ও ইন্টারনেটকে কেন্দ্র করেই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সূচনা হয়েছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে গোটা দুনিয়ার তথ্য এখন হাতের মুঠোয়। কম্পিউটারে সংযুক্ত হবার পর ইন্টারনেট এখন মোবাইল ফোনেও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশেষ করে অ্যাপল ও অ্যান্ড্রয়েড বেসড স্মার্ট মোবাইল ফোনে বিভিন্ন প্রয়োজনে এর ব্যবহার বহুগুণ বেড়েছে। বর্তমান দুনিয়ায় তথ্য হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার যার মাধ্যমে যে কোন ব্যবসা-বাণিজ্য, সরকার পরিচালনা, উন্নয়ন কর্মসূচি প্রণয়ন গ্রহণ করা হয়ে থাকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্প্রতি প্যাগাসাস নামক এক ভাইরাস মোবাইল ফোন থেকে মানুষের যাবতীয় তথ্য হাতিয়ে নিয়ে বিপদে ফেলছে।

তাঁদের মতে, ২০১৬ এর আগস্টে ‘প্যাগাসাস’ নামক স্পাইওয়ার ভাইরাস প্রথম আবিস্কৃত হয়। শাব্দিক অর্থে ‘প্যাগাসাস’ অর্থ ‘পক্ষীরাজ’ বা ‘উড়ন্ত অশ্ব’। ইসরাইলের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এনএসও গ্রুপ কর্তৃক উদ্ভাবিত এটি একটি ভয়ংকর ম্যালওয়ার যার কারণে এর নামকরণ ‘প্যাগাসাস’ স্পাইওয়্যার দেওয়া হয়। এটি অ্যান্ড্রয়েড ও আইফোনের অপারেটিং সিস্টেমে ঢুকে ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করে। এটি এমন একটি স্পাইওয়্যার যা কি-না কোনো ব্যক্তির ফোনে ঢুকে গেলে ব্যক্তিগত ছবি, ভিডিও, ব্যাংক কার্ড থেকে আরম্ভ করে যাবতীয় তথ্য হাতিয়ে নিতে সক্ষম।

বিজ্ঞাপন

২০২১ সালের জুলাই পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাইবার সিকিউরিটি দল তদন্ত করে দেখে যে, ‘প্যাগাসাস স্পাইওয়্যার’ প্রতিনিয়ত বিশ্বব্যাপী ব্যবহৃত হচ্ছে এবং বিশ্বের প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের ফোনে অধিকতর আক্রমণ করছে, সাথে রাষ্ট্রীয় সকল প্রকার কার্যক্রম ট্র্যাক করছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তদন্ত অনুযায়ী এটি ইন্টারনেট অপারেটিং সিস্টেম ১৪.৬ পর্যন্ত অনায়াসেই সিকিউরিটি লঙ্ঘন করে ফোন ব্যবহারকারীর সকল প্রকার তথ্য হাতিয়ে নিতে সক্ষম।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই স্পাইওয়্যার এতটাই অপ্রতিরোধ্য যে, অনায়াসে অ্যাপলের সিকিউরিটি সিস্টেম ভেদ করে ঢুকে যেতে পারে এবং কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তি বা রাষ্ট্রীয়, দলীয়, আন্তর্জাতিক যাবতীয় পরিকল্পনা, কার্যকলাপ ট্র্যাক করতে সক্ষম। অ্যান্ড্রয়েড ফোনেও আক্রমণ করে এটি। হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউব ভেনসেড, স্প্যাম মেসেজ ইত্যাদির মাধ্যমেও এটি ঢুকতে পারে যে কোনো ব্যক্তির ফোনে।

বিজ্ঞাপন

তাঁদের মতে, ‘প্যাগাসাস স্পাইওয়্যার’ কারো ছদ্মবেশে সামান্য একটা মিসড কল বা টেক্সট মেসেজ বা লিংক পাঠানোর মাধ্যমেই সেটি তৎক্ষণাৎ উক্ত ব্যক্তির ফোনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইনস্টল হয়ে যাবতীয় তথ্য হাতিয়ে নিতে পারে। ফোন ব্যবহারকারীর সেই মিসড কলটি রিসিভ করা বা টেক্সট মেসেজটি পড়ারও প্রয়োজন নেই। নজরদারি চালানোর জন্য ফোনে শুধু মেসেজ বা মিসড কলটি ছদ্মবেশে ঢুকলেই যথেষ্ট। অনেক সময় প্রলোভনযুক্ত যেমন ইন্টারনেটে অর্থ আয় এ জাতীয় কোনো লিংকের মাধ্যমেও এটি যে কারো ফোনে ঢুকতে পারে।

আবার যদি সেই ব্যক্তি অ্যান্ড্রয়েড ফোন ব্যবহারকারী হন তবে প্লেস্টোর ব্যতীত অন্য কোনো তৃতীয় পক্ষের সফটওয়্যার সোর্স থেকে কোনো অ্যাপ্লিকেশন ইনস্টল করেন বা ইউটিউব ভিনসেন্ট এর মতো ওয়েবসাইট থেকে ভিডিও দেখার চেষ্টা করেন, তবে সেক্ষেত্রেও তার ফোনে খুব সহজেই এটি ঢুকে তথ্য হাতিয়ে নিতে পারে।

অনুরূপভাবে, কোনো আইফোন ব্যবহারকারী যদি তার ফোনের অ্যাপল অ্যাপ স্টোর ছাড়া অন্য যে কোনো তৃতীয় পক্ষের লাইসেন্স যুক্ত সফটওয়্যার সোর্স থেকে অ্যাপ ইনস্টল করেন তাহলেও তার আইফোনে সিকিউরিটি সিস্টেম ভেঙে ‘প্যাগাসাস স্পাইওয়্যার’ এর উৎপত্তি ঘটতে পারে।

আরও ভয়ংকর বিষয় হলো, এই স্পাইওয়্যার আক্রমণের শিকার ফোনের মালিক কোনোভাবে বুঝেও উঠতে পারবেন না যে তার ফোনে ‘প্যাগাসাস’ নামক একটি স্পাইওয়্যার অযাচিতভাবে অনুপ্রবেশ করেছে। এই ভাইরাসের কোডিং প্রসেস এতটাই শক্তিধর। বিবিসি’র এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের প্রায় পঞ্চাশটি দেশে ‘প্যাগাসাস স্পাইওয়্যার’ এর মাধ্যমে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির ফোনে নজরদারির অনুসন্ধান পাওয়া গেছে।

এই ভাইরাসের আক্রমণের ফলে ব্যক্তিগত মোবাইল থেকে নিজের ব্যক্তিগত কার্যকলাপ, ছবি, অডিও, ভিডিও, কল রেকর্ড, ব্যাংক অ্যাকাউন্টের হিসাবসহ যাবতীয় তথ্য পৌঁছে যায় গুপ্তচর হ্যাকারদের হাতে। এখনও পর্যন্ত এটি প্রতিরোধে কার্যকর কোনো সফটওয়্যার বা কোনও মাধ্যম তৈরি হয়নি যা দিয়ে এই ভাইরাসের কবল থেকে মোবাইল ফোনে ফলপ্রসূ এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়। প্রযুক্তি গবেষকরা এই স্পাইওয়্যার প্রতিহত করার জন্য বা শনাক্তকরণ ব্যবস্থা নিয়ে ক্রমাগত গবেষণা করে চলেছেন।

‘প্যাগাসাস স্পাইওয়্যার’ কারো ফোনে ঢুকে গুপ্তচর হিসেবে কাজ করে। কে কার সঙ্গে কী কথা বলছে, কী মেসেজ দিচ্ছে, কে কোথায় আছে, কার সাথে কী বিষয়ে যোগাযোগ হচ্ছে সব তথ্যই তৃতীয় পক্ষের কাছে পৌঁছে দিতে সক্ষম। কারো একান্ত ব্যক্তিগত তথ্য থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ যাবতীয় তথ্য, অডিও ও ভিডিও তৃতীয় পক্ষ হেফাজতে নিয়ে নিচ্ছে। কাজেই করোনাকালে ‘প্যাগাসাস’ ভাইরাস এখন অনেকের জন্য আরেক মানসিক যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মতিউর রহমানগবেষণা পরামর্শকহিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার (এইচডিআরসি), ঢাকা